ইসলামের সেবায় যৌথভাবে কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড পেলেন মিসরীয় শায়খ ড. হাসান আল শাফেয়ি
এক দশকে দুবার বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কার অর্জন
এ বছর ইসলামের সেবায় অনন্য ভূমিকা রাখায় যৌথভাবে কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন মিসরের বিশ্বখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ভাষাবিদ শায়খ ড. হাসান মাহমুদ আল শাফেয়ি ও তানজানিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আলি হাসান মুওয়াইনি।
ইসলামী জ্ঞানচর্চা, শিক্ষকতা, রচনা, গবেষণা, অনুবাদের পাশাপাশি পাকিস্তানের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ইসলামাবাদ প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ অবদানের জন্য ড. হাসানকে এ সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এর পাঠ্যসূচীর উন্নয়ন, আল আজহারের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন শাখা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য।
ড. হাসান আল আজহারের কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলার্স-এর সদস্য ও দ্য ইউনিয়ন অব আরব লিঙ্গুয়েস্টিক একাডেমি-এর সভাপতি।
আল আজহারের প্রথম আলেম হিসবে তিনি কায়রোর বিখ্যাত অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ একাডেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামী দর্শন, আকিদা, তাওহিদ, তাসাউফ বিষয়ে তাঁর প্রায় ১০টি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ।
অবাক করা ব্যাপার হলো, ২০১৩ সালে ড. হাসান আরবি ভাষা ও সাহিত্যে অনন্য অবদান রাখায় এ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ফলে খ্যাতিমান এ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। দীর্ঘ ৮০ বছর অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ একাডেমির দায়িত্ব পালন করে অভিধান প্রকাশের মাধ্যমে আরবি ভাষা ও পবিত্র কোরআনের ভাষা প্রসারে অনন্যা ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে ওই পুরস্কার দেওয়া হয়।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা : ড. হাসান ১৯৩০ সালে মিসরের বেনি সুয়েফ প্রদেশের বিবা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আল আজহারে পড়াশোনা করে শিক্ষকতা করতেন। পারিবারিক পড়াশোনা শুরু করে ছোটবেলায় পবিত্র কোরআন হিফজ করেন। ১৯৬৩ সালে শায়খ হাসান কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের দারুল উলুম ফ্যাকাল্টি থেকে আরবি ভাষা ও ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতক করেন। একই বছর তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও আকিদা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। অতঃপর ১৯৭৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে ইসলামী দর্শন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
দেশে-বিদেশে পড়াশোনা : ১৯৫৪ সালে জামাল আবদুন নাসেরের সময় তিনি আটক হন এবং ব্রাদারহুডে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয় বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ফলে ওই সময় তিনি স্নাতকের শিক্ষার্থী হলেও ১০ বছর তিনি স্নাতক শেষ করার সুযোগ পান। পরবর্তীতে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পরও চার বছর কারাবন্দী ছিলেন।
পড়াশোনায় মায়ের অনুপ্রেরণা : মায়ের অনুপ্রেরণায় জীবনে এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ড. হাসান তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘মাইল লাইফ ইজ মাই স্টোরিজ’-এ লিখেন, ‘আমার বয়স যখন ৬৬ বছর তখন আমার শতবর্ষ বয়সী মায়ের মৃত্যু হয়। আমার জীবনে তিনি ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনযাপন ও মন-মানসিকতা আমাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। তিনি জীবনের নানা সময়ে আমাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। ’
তাহরির স্কয়ারে অবস্থান : ব্যক্তিজীবনে শায়খ ড. হাসান রাজনীতিতে জড়িত না হলেও ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি কায়রোর তাহরির স্কয়ারে ‘ব্যর্থ বিপ্লবে’র সমর্থন জানিয়ে তাতে অংশ নেন। ওই সময়ের গণজোয়ারকে মিসরের বাস্তবতা বলে অভিহিত করে যারা একে ‘পশ্চিমা প্রকল্প’ বলেছিল তাদের তিনি ‘স্বৈরাচারীদের দাস’ আখ্যায়িত করেন। ২০১১-১৩ সালে মিসরের সববেচেয়ে কঠিন সময়ে তিনি ছিলেন শায়খুল আজহারের উপদেষ্টা। এ সময় গণজোয়ারে সমর্থন জানিয়ে তিনি ঐতিহাসিক বিবৃতি দিয়েছিলেন, ‘মিসরে কোনো স্বাধীনতা কোনো বিপ্লব নেই। ’ তাঁর এ অবস্থানের চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল শায়খ ড. হাসানের।
বিভিন্ন পদ থেকে অব্যাহতি : এ ঘটনার পর থেকে মিসরীয় সংবাদ মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি ওঠে। ২০১৫ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের দারুল উলুম ফ্যাকাল্টির অধ্যাপনা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া একসঙ্গে দুটি চাকরি করার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ড. জাবির নাসার এমনকি করেছেন বলে তিনি বলেন। এমনকি ২০২০ সালে ৮ বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ একাডেমির প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী খালেদ আবদুল গাফফারের নির্দেশে তাকে এ পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।
কিং ফয়সাল পুরস্কার লাভ : বর্তমান বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড। গত ৫ জানুয়ারি চারটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রাপ্ত বিশ্বের খ্যাতিমান সাতজনের নাম ঘোষণা দেওয়া হয়। গত চার দশকের বেশি সময় ধরে প্রতি বছর পাঁচ বিভাগে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের দেওয়া হয় এ পুরস্কার।
কিং ফয়সাল প্রাইজ হিসেবে এ বছর দুই লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ১৭ কোটি দুই লাখ আট হাজার ৬৫৬ টাকা) দেওয়া হয়। পাশাপাশি ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণপদক ও আরবি ক্যালিগ্রাফিতে লেখা একটি প্রশংসাপত্র দেওয়া হয়। কিং ফয়সাল পুরস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান মক্কা নগরীর গভর্নর প্রিন্স খালিদ আল ফয়সাল তাদের মধ্যে পুরস্কার প্রদান করেন।
১৯৭৭ সালে কিং ফয়সাল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতিবছর অসামান্য অবদানের জন্য বিশ্বের নির্বাচিত গুণী ব্যক্তিত্বদের সম্মাননায় এ পুরস্কার দেওয়া হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখা বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলিমদের সেবার উদ্দেশ্যে এ পুরস্কারের যাত্রা হয়। প্রথম বছর শুধু ইসলামের সেবা, ইসলাম শিক্ষা ও আরবি সাহিত্য- এই তিনটি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে চিকিৎসা ও বিজ্ঞানকে পুরস্কারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করে অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর বিশেষজ্ঞ কমিটি বিজয়ীদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।