মিশরে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শীতকালীন ভ্রমণ

এবারের আয়োজন ছিল মিশরের ঐতিহাসিক ফাইয়্যুম অঞ্চল।

বিশেষ দ্রষ্টব্য
  • লেখক: আবদুর রহমান ও তাওহীদুল ইসলাম

প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্যের দেশ মিশর। সমগ্র মিশর জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান যা সারা পৃথিবীর ভ্রমণপ্রেমীদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়সহ মিশরের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকারী শিক্ষার্থীগণও এর ব্যতিক্রম নন ৷

প্রতি বছরই অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভ্রমণের হিড়িক পড়ে যায়। সাধারণত এসব মৌসুমি ভ্রমণের অধিকাংশই হয়ে থাকে বিভিন্ন দেশের ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে। এসব সংগঠনের মধ্যে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন হলো আযহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি কায়রো।

এবারের আয়োজন ছিল বহু নবি ও সাহাবিদের স্মৃতি বিজড়িত মিশরের ঐতিহাসিক ফাইয়্যুম অঞ্চলে। চারটি ভ্রমণ বাসে শিক্ষার্থী, ফ্যামিলি ও বিদেশী অতিথি সহ প্রায় ২০০ ভ্রমণার্থীকে নিয়ে গঠিত হয়েছিলো এ কাফেলা।

মিশরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সম্মানিত রাষ্ট্রদূত জনাব মনিরুল ইসলাম স্যারের অংশগ্রহণে এ শীতকালীন ভ্রমণটি হয়ে উঠেছিলো আরো প্রাণবন্ত। ১৩ ই ফেব্রুয়ারি সূর্যোদয়ের পূর্বেই শুরু হয় যাত্রা। কায়রোতে আল-আযহারের বিদেশী শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস ‘মাদিনাতুল বুউসে’র প্রধান গেইট সংলগ্ন জায়গা থেকে বাস গুলো একে একে ছেড়ে যায় একদিনের এই রোমাঞ্চকর ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।

নানান সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে কায়রো অতিক্রম করে আমাদের ভ্রমণ কাফেলা যখন ফাইয়্যুমের সীমানায় প্রবেশ করে তখন মিশরের আকাশে সূর্যোদয়ের আয়োজন প্রায়ই সম্পন্ন হয়ে গেছে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিলো কারূন লেক।

পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ইউসুফ আ. এর শহর, তিউনিস ভিলেজ, কসরু কারূন ও ওয়াদিউর রাইয়্যান, ওয়াদিউল হিতান, জাবালুল মুদাওয়ারাহ (বৃত্তাকার পর্বত), বুহাইরা উলইয়া, বুহাইরা ছুফলা ও জলপ্রপাতসমূহ।

কারূন লেক : মিশরের ফাইয়্যুম জেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক কারূন লেক পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ও বৃহত্তম ন্যাচারাল লেক। প্রাচীন ফিরআউন আমল থেকে যুগ যুগ ধরে এ লেক বিদ্যমান থাকায় ইসলামি আমলে আরবগণ এ লেকটিকে ‘বুহাইরাতুল কুরুন’ বা ‘বহু শতাব্দীর লেক’ নাম দেন। আজকের কারূন লেক সেই “কুরুন” শব্দের বা প্রাচীন নাম ‘বারুন লেক’ এরই অপভ্রংশ। কারূন লেক ছিলো আমাদের কাফেলার সর্ব প্রথম ভ্রমণ স্পট। প্রায় এক ঘন্টা আমরা লেকের তীরে অবস্থান করি।

নবি ইউসুফ আ. এর শহর : এটি ফাইয়্যুম জেলার ৬ টি থানার অন্যতম একটি থানা। বলা হয়ে থাকে এ অঞ্চলে ইউসুফ আ. দীর্ঘদিন বসবাস করেছেন। চলার পথে আমরা পনেরো মিনিটের জন্য গ্রামটি পরিদর্শনে নেমেছিলাম। রাস্তাজুড়ে বিশাল তোরণে লেখা ছিলো, ‘নবি ইউসুফ আস-সিদ্দিক আ. এর শহরে আপনাদের স্বাগতম’!

তিউনিস ভিলেজ : বিংশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ কবি সাইয়্যেদ হিজাব এর স্ত্রী সুইস ভদ্রমহিলা আইফেলিন বুরিয়া ষাটের দশকে গ্রামটি আবাদ করেন। তিনি এখানে ছোট – বড় সকলকে মৃৎশিল্পের শিক্ষা দেন। ব্যাপকহারে সবুজ ফসলের চাষাবাদ করেন। মাটি দিয়ে সারি সারি সুবিন্যস্ত গৃহ নির্মাণ করেন। এভাবে এক সময়ে এ গ্রামটি বিদেশীদের দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়। সবুজ শ্যামল তিউনিসিয়ার সাথে সাদৃশ্যতা রেখে এ গ্রামের নাম রাখা হয়েছে ‘করইয়াতু তিউনুস’। তিউনিসিয়া ভিলেজ ছিলো আমাদের কাফেলার তৃতীয় স্পট।

কসরু কারূন : প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল অনুসারে কসরু কারূন রোমান আমলের গ্রিক দেবী সোবেক ও ডায়োনেসিয়াস এর উপাসনালয়। তবে ইসলামি যুগে এ অঞ্চলের অধিবাসীগণ প্রাসাদটিকে কসরু কারূন নাম দেন। কেননা, এ প্রাসাদটি বুহাইরা কারূন বা কারূন লেকের পাশেই অবস্থিত।

প্রায় একশতর মতো কামরা নিয়ে প্রাসাদটি তৈরি করা হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ফাইয়্যুম থেকে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত মাটির নীচে একটি বিরাট সুরঙ্গ আবিষ্কার করেছেন। সেই সুরঙ্গটির প্রবেশদ্বর রয়েছে এ কসরু কারূনে। আধুনিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, প্রাসাদটির অভ্যন্তরে সুরঙ্গের নিকটস্থ ‘কুদসুল আকদাস’ নামক বিশেষ একটি স্থানে প্রতি বছর ২১ শে ডিসেম্বর শুধু ২৫ মিনিট সময়ের সূর্যের আলো গিয়ে পড়ে।

দুপুর বারোটার দিকে আমাদের কাফেলা কাসরু কারূন থেকে ওয়াদিউর রাইয়্যানে প্রবেশ করে। প্রাণীদের উপত্যকা পরিদর্শন শেষে বিস্তীর্ণ মরুপথ পারি দিয়ে জাবালুল মুদাওয়ারার পাদদেশে আমরা বাঙালি বিরিয়ানির সুস্বাদু আয়োজনে দুপুরের খাবার গ্রহণ করি। সকালের নাস্তা ইতোমধ্যে গাড়িতেই পরিবেশিত হয়েছিলো। খাবার ও পর্বতারোহণসহ প্রায় দুই ঘন্টা সময় এখানে কাটিয়ে আমরা দুই লেকের মধ্যবর্তী জলপ্রপাত অঞ্চলে চলে যাই।

ওয়াদিউর রাইয়্যান : রাইয়্যান উপত্যকা মিশরের অন্যতম সুন্দর একটি সংরক্ষিত এলাকা। সম্রাট রাইয়্যান ইবনুল ওয়ালিদ তার সেনাবাহিনীসহ এ অঞ্চলে কিছু সময় অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি এ অঞ্চলটিকে নিজের নামের সাথে সম্পৃক্ত করে ওয়াদিউর রাইয়ান বা রাইয়ান উপত্যকা নাম দিলে স্থানীয় বেদুঈনরা নামটি গ্রহণ করে নেয়। তখন থেকে অঞ্চলটি ওয়াদিউর রাইয়ান নামে প্রসিদ্ধ। এ সংরক্ষিত এলাকায় সাদা হরিণ, মিশরী হরিণ, শেয়াল ও নেকড়েসহ প্রায় ১৫ প্রজাতিরও অধিক স্থলচর প্রাণী রয়েছে।

বুহাইরা উলইয়া : ওয়াদিউর রাইয়্যানের উচ্চভূমিতে অবস্থিত এ লেকটির আয়তন প্রায় ৬৫ কিলোমিটার।

বুহাইরা ছুফলা : উপত্যকার নিম্নভূমিতে অবস্থিত এ লেকটির আয়তন প্রায় ১০০ কিলোমিটার।

জলপ্রপাত : ওয়াদিউর রাইয়্যানের জলপ্রপাতগুলো দুই লেকের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ নয়নাভিরাম অঞ্চলে নির্ধারিত করে বলতে গেলে মোট ৩ টি জলপ্রপাত রয়েছে।

ওয়াদিউল হিতান : রাইয়্যান উপত্যকার প্রবেশ পথের ডানদিকে বেশ কিছুদূরে এ মরু অঞ্চলটি অবস্থিত। অসংখ্য বিশালদেহী প্রাচীন প্রাণীর হাড় আবিষ্কৃত হওয়ায় এ অঞ্চলকে ‘ওয়াদিউল হিতান’ তথা প্রাণীদের উপত্যকা নাম রাখা হয়েছে। অনেকে এ অঞ্চলকে একটি উন্মুক্ত জাদুঘরও বলে থাকেন।

জাবালুল মাদাওয়ারাহ : ভৌগোলিক গঠনের দিক থেকে এ বৃত্তাকার পর্বতটি বিজ্ঞানীদের নিকট এক মহাবিস্ময়। প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণা অনুপাতে টিলাটির বয়স প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বা সাড়ে চারশত কোটি বছর! যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীরা এ টিলায় আরোহণ করে আকাশের নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে আসছেন।

বিভিন্ন প্রজাতির পশু -পাখির দর্শন, বালুতে স্কেটিং, ঘোড়ায় আরোহণ, উটে আরোহণ, নৌকায় ভেসে বেড়ানো ও খেলাধুলাসহ সকলেই এখানে ডুবে থাকি নানান বিনোদনে। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শেষ হলো ৷ যখন সূর্য আমাদেরকে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখন আমরাও ঐতিহাসিক ফাইয়্যুম অঞ্চলকে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিলাম৷

একদিনের রোমাঞ্চকর ভ্রমণের সকল পর্ব শেষ করে আমরা সকলেই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে নিজ নিজ বাসে নির্ধারিত আসন গ্রহণ করলাম। আযহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি কায়রোর ব্যানার খচিত চারটি ভ্রমণ বাস মরুময় পথ ধরে চলতে থাকে কায়রোর উদ্দেশে। এরই মধ্যে বাসে বাসে শুরু হয়ে যায় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

গাড়িগুলোকে পথিমধ্যে একটি ক্যাফে হাউজে বিরতি দেয়া হলো ৷ আমরা মাগরীবের নামায সেরে নিলাম ৷ নামাযের পর উপস্থিত সবাই সমবেত হলাম ৷ সম্মানিত রাষ্ট্রদূত জনাব মনিরুল ইসলাম স্যার আমাদের সবার সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন ৷ ভ্রমণ নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলেন এবং আযহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটির উপস্থিত উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ কয়েকজনের পুরস্কার বিতরণ করলেন ৷

সংক্ষিপ্ত বিরতি শেষে আমরা সবাই পুনরায় গাড়িতে উঠে রওনা হলাম কায়রো অভিমুখে ৷ বিখ্যাত ফাইয়্যুমের জেলার অসংখ্য স্মৃতি বুকে নিয়ে আবার ফিরে আসলাম কায়রো শহরে।

মুহাম্মদ তাওহীদুল ইসলাম

শিক্ষার্থী: আল আজহার ইউনিভার্সিটি৷

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button