হাদীস শরীফে ইসরা ও মিরাজ : প্রামাণ্য বর্ণনা ও শিক্ষা

আনা হল নবীজীকে বহন করার জন্য সওয়ারী, প্রাণীটি গাধার চেয়ে বড়, ঘোড়া থেকে ছোট নাম বুরাক রং সাদা।

বিশেষ দ্রষ্টব্য
  • মূল লেখকঃ মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর।

কিছু দীর্ঘ হাদীসে মে’রাজের বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। আবার কিছু হাদীসের বিভিন্ন পাঠ থেকে মিরাজের টুকরো টুকরো বর্ণনা পাওয়া যায়। সে হাদীসগুলো সামনে রেখে মি’রাজের ঘটনা নিম্নরূপ

হিজরতের পূর্বের কথা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একরাতে শুয়ে ছিলেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন। চোখদুটো মুদে এসেছে বটেতবে দিল ছিল জাগ্রত। এরই মাঝে আগমন করলেন হযরত জিবরাঈল আ.। তিনি নবীজীকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন যমযমের নিকট। একটি স্বর্ণের পেয়ালা আনা হল। তা ছিল ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ। তাতে যমযমের পানি। জিবরাঈল আ. নবীজীর বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করলেন। বের করে আনলেন নবীজীর হৃদয়। যমযমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে আবার প্রতিস্থাপন করে দিলেন  জায়গামত। ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ করে দেওয়া হল নবীজীর কলব

এরপর আনা হল নবীজীকে বহন করার জন্য সওয়ারী। প্রাণীটি গাধার চেয়ে বড়ঘোড়া থেকে ছোট। নাম বুরাক। রং সাদা। এটা এতটাই ক্ষিপ্রগতির যার একেকটি কদম পড়ে দৃষ্টির শেষ সীমায় গিয়ে।

এভাবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহূর্তেই পৌঁছে গেলেন বাইতুল মুকাদ্দাসে। বুরাক বেঁধে রাখা হল পাথর ছিদ্র করে। যে পাথরে অপরাপর নবীগণ নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন। নবীজী সেখানে দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। নামায পড়ে বের হওয়ার সময় জিবরাঈল আ. নবীজীর সামনে দুটি পেয়ালা পেশ করলেন। একটি দুধের অপরটি শরাবের। নবীজী দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলেন। জিবরাঈল আ. বললেনআপনি (দ্বীনের) স্বভাবসিদ্ধ বিষয়টি নির্বাচন করেছেন।

নবীজী মদের পেয়ালা নেওয়ার পরিবর্তে দুধের পেয়ালা গ্রহণ করায় জিবরীল আ. বলেনআপনি যদি মদের পেয়ালা নিতেন তাহলে আপনার উম্মত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ৩৩৯৪)

এরপর শুরু হল ঊর্ধ্বজগতের সফর। জিবরাঈল নবীজীকে নিয়ে চললেন। প্রথম আসমানে গিয়ে দস্তক দিলেন। জিজ্ঞাসা করা হলকেবললেনজিবরাঈল। জিজ্ঞাসা করা হলআপনার সাথে কেবললেনমুহাম্মাদ। জিজ্ঞাসা করা হলতার কাছে কি আপনাকে পাঠানো হয়েছেবললেনহাঁ। এরপর নবীজীকে সম্ভাষণ জানানো হল– মারহাবাউত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে! খুলে দেওয়া হল নবীজীর জন্য আসমানের দরজা।

নবীজী প্রথম আসমানে গেলেন। সেখানে ছিলেন হযরত আদম আ.। জিবরাঈল পরিচয় করিয়ে দিলেন। নবীজী হযরত আদমকে সালাম বললেন। বাবা আদম জবাব দিলেন। নবীজীকে সাদর অভিবাদন জানালেন– মারহাবানেককার পুত্র ও নেককার নবী। হযরত আদম আ. নবীজীর জন্য দুআ করলেন।

এরপর নবীজী উঠতে থাকলেন দ্বিতীয় আসমানের দিকে। সেখানেও দরজা খুলতে প্রথম আসমানের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। এরপর নবীজীকে ইস্তেকবাল করা হল। নবীজী সেখানে দেখতে পেলেন দুই খালাত ভাই হযরত ঈসা আ. ও হযরত ইয়াহইয়া আ.কে। তাদের সাথে নবীজীর সালাম বিনিময় হল। তারা নবীজীকে স্বাগত জানালেন– মারহাবাআমাদের পুণ্যবান ভাই এবং সজ্জন নবী। তারা নবীজীর জন্য দুআ করলেন।

এরপর নবীজীকে তৃতীয় আসমানের দিকে নিয়ে  যাওয়া হল। সেখানেও দুই আসমানের মতো জিজ্ঞাসাবাদ হল এবং নবীজীকে স্বাগত জানানো হল। সেখানে গিয়ে দেখলেন হযরত ইউসুফ আ.। হযরত ইউসুফের সাথে নবীজীর সালাম ও কুশল বিনিময় হল। নবীজী বলেনহযরত ইউসুফকে যেন দুনিয়ার অর্ধেক সৌন্দর্য ঢেলে দেওয়া হয়েছে!

এরপর চললেন চতুর্থ আসমানের দিকে। সেখানেও পূর্বের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। স্বাগতসম্মান জানানো হল। সেখানে হযরত ইদরীস আ.এর সাথে  সাক্ষাৎ হল। সালাম ও কুশল বিনিময় হল। হযরত ইদরীস আ. নবীজীর জন্য দুআ করলেন।

এরপর চললেন পঞ্চম আসমানের দিকে। সেখানে হযরত হারূন আ.এর সাথে সাক্ষাৎ হল।

এরপর চললেন ষষ্ঠ আসমানের দিকে। সেখানেও পূর্বের পর্বগুলোর মতো জিজ্ঞাসা করা হল। নবীজীকে অভিনন্দন জানানো হল। সেখানে দেখা হল হযরত মূসা আ.এর সাথে। হযরত মূসা আ. নবীজীকে খুব ইস্তেকবাল করলেন।

এরপর নবীজী সপ্তম আসমানের দিকে উঠতে থাকেন। সেখানে দেখা হল হযরত ইবরাহীম আ.এর সাথে। জিবরাঈল আ. পরিচয় করিয়ে দিলেন– ইনি আপনার পিতাসালাম করুন। নবীজী হযরত ইবরাহীম আ.এর সাথে সালাম বিনিময় করলেন।

নবীজী বলেনহযরত ইবরাহীম আ. তখন বাইতুল মামুরে হেলান দিয়ে ছিলেন। বাইতুল মামুরযেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা আসে। এরপর এই সত্তর হাজার আর ফিরে আসে না। এভাবে প্রতিদিন সত্তর হাজার করে ফেরেশতাদের নতুন নতুন কাফেলা আসতে থাকে।

এরপর নবীজীকে নিয়ে যাওয়া হল সিদরাতুল মুনতাহার দিকে। সেই কুল বৃক্ষের একেকটি পাতা হাতির কানের মতো। আর একেকটি ফল মটকার মতো বড় বড়। যখন ওটাকে আল্লাহর বিধান আচ্ছন্ন করে নিল তা পরিবর্তিত হয়ে গেল। সৃষ্টির কারো সাধ্য নেই তার সৌন্দর্যের বিবরণ দেবার। জিবরাঈল বললেনএটা সিদরাতুল মুনতাহা। এখানে চারটি নহর। দুটি অদৃশ্য আর দুটি দৃশ্যমান। নবীজী জিজ্ঞাসা করলেনদৃশ্যমান নদীদুটি কোনগুলোজিবরাঈল বললেনঅদৃশ্যমান দুটি জান্নাতে। আর দৃশ্যমান দুটি হল নীল নদ ও ফুরাত নদী।

এরপর আল্লাহ তাআলা নবীজীর প্রতি যে ওহী পাঠানোর পাঠালেন। দিনরাতে উম্মতের জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দিলেন। নবীজী আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাতের এ হাদিয়া নিয়ে ফেরত আসছিলেনএর মধ্যে দেখা হযরত মূসা আ.এর সাথে। হযরত মূসা আ. জিজ্ঞাসা করলেনআল্লাহ আপনার উম্মতের জন্য কী দিয়েছেননবীজী বললেনপঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায। হযরত মূসা বললেনআপনার উম্মত রাতদিনে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায পড়তে পারবে না। আপনার  আগে আমি উম্মত চালিয়ে এসেছি। আপনি আল্লাহর কাছে গিয়ে কমিয়ে আনেন। নবীজী সে মতে আল্লাহর কাছে গিয়ে কম করে দেওয়ার দরখাস্ত করলেন। আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। নবীজী তা নিয়ে ফেরত আসছিলেন। আবার হযরত মূসা আ.এর সাথে দেখা হল। বললেনআপনার উম্মত তা পারবে না। আপনি আরো কমিয়ে আনুন। নবীজী আবার আল্লাহর কাছে গিয়ে আগের মতো দরখাস্ত  করে আরো পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে আনলেন। নবীজী বলেনএভাবে আমি আল্লাহ ও মূসার মাঝে আসাযাওয়া করতে থাকি। শেষবার আল্লাহ বলেনমুহাম্মদ! এই হল দিনরাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায।  প্রত্যেক নামাযের বিনিময়ে দশ নামাযের সাওয়াব। এভাবে বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের সওয়াব পাবে। কেউ কোনো ভালো কাজের ইচ্ছা করবে কিন্তু করতে পারবে নাতার জন্যও নেকী রয়েছে। এক নেকী। আর যদি ভালো কাজটি করে তাহলে তার জন্য দশ নেকী। আর কেউ কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করলে কোনো গুনাহ লেখা হবে না। তবে তা করে বসলে একটি গুনাহ লেখা হবে।

নবীজী এ সওগাত নিয়ে ফেরত আসছিলেন। হযরত মূসার সাথে দেখা হল। মূসা আ. এবার শুনে বললেনআপনি যানআরো কমিয়ে আনুন। আপনার উম্মত পারবে না। বনী ইসরাঈলের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। নবীজী বললেনআমার আর কিছু বলতে লজ্জা হচ্ছে! (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ৩৮৮৭সহীহ মুসলিমহাদীস ১৬২১৬৪)

নবীজীকে যখন বুরাকে  তোলা হচ্ছিল তখন বুরাক ঔদ্ধত্য দেখাল। তখন জিবরাঈল আ. বললেনমুহাম্মাদের ক্ষেত্রে এরকম করছিস! তোর উপর তো এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ কোনোদিন চড়েনি। এ শুনে বুরাক ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। (দ্রষ্টব্য : জামে তিরমিযীহাদীস ৩১৩১)

আল্লাহ তাআলা নবীজীর জন্য যে বিশেষ উপহার হাউযে কাউসার রেখেছেন প্রথম আসমানে নবীজীকে তা দেখানো হয়। নবীজী সেই কাউসারের বিবরণও দিয়েছেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ৭৫১৭)

নবীজী যখন প্রথম আসমানে যান দেখেন এক ব্যক্তিতার ডান পাশে কিছু রূহ  আর বাম পাশে কিছু রূহের কাফেলা। তিনি ডানদিকে তাকালে হাসেন আর বাম দিকে তাকালে কাঁদেন। তিনি নবীজীকে সম্ভাষণ জানালেন। নবীজী জিজ্ঞাসা করলেনজিবরাঈল! ইনি কেজিবরাঈল বললেনইনি আদম আ.। আর তার দুই পাশে তার সন্তানদের রূহ। ডানদিকেরগুলো জান্নাতী আর বামদিকেরগুলো জাহান্নামী। এজন্য তিনি ডানদিকে তাকিয়ে হাসেন আর বামদিকে তাকিয়ে কাঁদেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ৩৩৪২)

এ সফরে নবীজীকে জান্নাতজাহান্নামের ভ্রমণও করানো হয়। নবীজী বলেনজান্নাতের প্রাসাদগুলো মুক্তার তৈরি আর তার মাটি হল মেশকের। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ৭৫১৭)

নবীজী এ সফরে একদল লোককে দেখলেনতাদের নখগুলো তামার। নিজেদের নখ দিয়ে তারা নিজের গাল ও বুকে অঁাচড় কাটছে। জিজ্ঞাসা করলেনজিবরাঈলএরা কারা?

বললেনএরা ওই সমস্ত লোকযারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের সম্ভ্রমে আঘাত হানত। অর্থাৎ গীবত করত এবং মানুষকে লাঞ্ছিত করত। (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৩৩৪০সুনানে আবু দাউদহাদীস ৪৮৭৮)

নবীজী এ সফরে হযরত মূসা আ. ও হযরত ঈসা আ.এর শারীরিক গড়নেরও বিবরণ দেন। নবীজী বলেনআমি ইবরাহীমের আকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ৩৩৯৪)

হযরত ইবরাহীম আ.এর সাথে মুলাকাত হলে তিনি নবীজীকে বলেনআপনি আপনার উম্মতের কাছে আমার সালাম পৌঁছাবেন। আর তাদেরকে বলবেনজান্নাতের মাটি পবিত্র ও সুঘ্রাণযুক্তএর পানি সুমিষ্ট এবং এর ভূমি উর্বর ও সমতল। আর এর বৃক্ষ হচ্ছে

سُبْحَانَ اللهِ وَالحَمْدُ لِلهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَر.

(দ্রষ্টব্য : জামে তিরমিযীহাদীস ৩৪৬২)

এ সফরে নবীজীকে তিনটি উপহার দেওয়া হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযসূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলো এবং এই উম্মতের যারা শিরক থেকে বেঁচে থেকে মৃৃত্যুবরণ করবে তাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়ার ঘোষণা। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিমহাদীস ১৭৩)

এ সফরে নবীজীর সাথে পূর্ববর্তী নবীগণের সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি নামাযে সকলের ইমামতি করেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিমহাদীস ১৭২)

এ সফরে নবীজী দেখলেনএকদল লোকের ঠেঁাট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলেনএরা কারা?জিবরাঈল বললেনএরা বক্তৃতা করত  বটেকিন্তু নিজেরা আমল করত না।  (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদহাদীস ১২২১১১২৮৫৬)

মিরাজ থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতীমে বসা। মুশরিকরা ইসরা ও মেরাজের ঘটনা শুনে উপহাস ও কটাক্ষ করতে লাগল। বিভিন্নভাবে নবীজীর দিকে প্রশ্নের তীর ছুড়তে লাগল। তারা চাইলবাইতুল মুকাদ্দাসের পূর্ণ বিবরণ শুনবে। নবীজী এমন প্রশ্নে খুবই বিব্রত হয়ে ওঠেন। এত রাতে কি বাইতুল মুকাদ্দাসকে ওরকম নিখঁুতভাবে দেখতে গিয়েছেন নাকি! নবীজী বলেনএরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমি আগে পড়িনি। আল্লাহ তাআলা প্রিয় বন্ধুকে সাহায্য করলেন। নবীজীর চোখের সামনে মেলে ধরলেন বাইতুল মুকাদ্দাসের দৃশ্য। নবীজী দেখে দেখে তাদের প্রত্যেকটি জিজ্ঞাসার বিস্তারিত জবাব দিলেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ৩৮৮৬সহীহ মুসলিমহাদীস ১৭২)

আল কুরআনে ইসরা ও মিরাজ : প্রামাণ্য বর্ণনা ও শিক্ষা

সূত্র
মাসিক আলকাউসার।

ঈসা আহমাদ ইসহাক

সহযোগী সম্পাদক : নিউজ বিভাগ এবং প্রধান অনুবাদক: আরবী বিভাগ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button