বিপদাপদ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং দূরও করেন তিনি

জুমা আলোচনা

বিশেষ দ্রষ্টব্য
  • আমরা ঢাকায় যেসব মসজিদে নামাজ পড়ি তন্মধ্যে ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদ ও মিরপুর কাঁঠালবাগ মসজিদে সাড়ে বারোটায় গিয়ে ইমামের ফ্লোরে জায়গা পাওয়া যায় না। মসজিদ ছোট এমনটি নয় বরং সেখানকার মুসল্লিরা খুতবা শ্রবণের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং ঢাকায় অধিকাংশ মসজিদের অবস্থা এমনই। আল্লাহপাক আমাদেরকে করোনাসহ সব ধরনের বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করুন। কুচিয়ামোড়া জামে মসজিদে ২৭.০৮.২০২১ তারিখে জুমা বক্তৃতা। প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া যে, বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে দয়া করে তিনি আমাদের সুস্থ রেখেছেন এবং অগণিত তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে আমাদের বাছাই করেছেন তাঁর ঘরে হাজির হয়ে নামাজ আদায়ের জন্য। আলহামদু লিল্লাহ। সাথে সাথে দরুদ ও সালাম আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি।

সম্প্রতি আমাদের এলাকায় বেশ কিছু প্রিয় মুখ করোনায় আক্রান্ত হয়ে আল্লাহর দরবারে ফিরে গেলেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রজেউন)। তন্মধ্যে আমাদের ময়নুল ভাই (মাস্টার), কালাম ভাই (মরহুম রইস মালিথার পুত্র ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা), জাহাঙ্গীর হোসেন (মরহুম শাহাদৎ মৌলভীর পুত্র) ও আমার চাচাতো ভাই জাহিদুল ইসলাম। এই লোকগুলো বাজারে চলাফেরা করার মতো নয় এবং অত্যন্ত সতর্ক জীবন যাপন করতেন। আসলে শুধু মৃত্যু নয়, বিপদাপদ সবই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাঁর বাণী, ‘কোনো বিপদ কখনই আসে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া’- সুরা তাগাবুন ১১। আমরা আল্লাহর ফায়সালা রদবদল করতে পারবো না।  রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তাঁর উম্মতদের মধ্যে মহামারিতে যাদের মৃত্যু হয় তাদের মৃত্যু শাহাদতের। আমরা আমাদের ভাইদের মাগফেরাত কামনা করি। আল্লাহপাক যেন তাঁদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন এবং সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করেন (মুসল্লিরা জবাবে আমিন আমিন বলেন)।

করোনা সমগ্র বিশ্বকে একযোগে আঘাত হেনেছে। আসলে করোনা নিজের থেকে নয়, আল্লাহর হুকুমে। সমগ্র বিশ্ব আল্লাহর নাফরমানি ও জুলুমে ভরে গেছে। করোনা আল্লাহর সৃষ্ট একটি অতি ক্ষুদ্র ভাইরাস। কিন্তু এর ধ্বংসক্ষমতা আমাদের ধারণার বাইরে। মাত্র দেড়টা বছরে আমাদের দেশে প্রায় ২৬ হাজার এবং বিশ্বে ৪৫ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন। প্রতিদিন প্রায় ১০/১১ হাজার লোক মারা যাচ্ছেন এবং প্রতিনিয়ত করোনার রূপ পরিবর্তন হচ্ছে, এখন চলছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট; শীঘ্রই মানুষ মুক্তি পাবে বলে মনে হয় না। আমরা কুরআন থেকে একটু শিক্ষা নেই। নাফরমানির কারণে আল্লাহ তায়ালা অতীতে অনেক জাতিকে ধ্বংস করেছেন, কুরআনের ভাষায় যারা ছিল শক্তিমান। নুহ আ.-এর জাতি, লুত আ.-এর জাতি, শোয়াইব আ.-এর জাতি, মুসা আ.-এর জাতিসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধ্বংস করার ঘটনা আল্লাহপাক আমাদের সম্মুখে পেশ করেছেন হেদায়াত গ্রহণের লক্ষ্যে। দুর্ভাগ্য, আমরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। করোনা আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে একটি নিদর্শন। আপনারা লক্ষ করুন, করোনার উদ্ভব হয় চীনে কিন্তু এটি প্রথমে ছড়িয়ে পড়ে দূরবর্তী ও বিশ্ব মোড়ল খ্যাত ইউরোপ ও আমেরিকায় এবং একযোগে আঘাত হেনে তাদেরকে বিপর্যস্ত করে তুলে। চিকিৎসাশাস্ত্রসহ জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখায় তাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। আসলে করোনার দ্রুত বিস্তৃতির কোনো ব্যাখ্যা নেই। এককথায় বলবো আল্লাহর হুকুম।

মহামারিতে অধিক সংখ্যক মানুষের মারা যাওয়ার কথা হতদরিদ্র, অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থা ও শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর। আমাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের ধারণা এমনই ছিল এবং মনে করা হত বাংলাদেশে আট কোটি লোক আক্রান্ত হবে ও বিশ লক্ষ লোক মারা যাবে। কিন্তু আল্লাহপাক বাংলাদেশের মতো দেশসমূহের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন।

বিপদাপদ যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং দূর করার ক্ষমতাও তাঁর। তাই একজন ইমানদারের উচিৎ সর্বাগ্যে আল্লাহর কাছেই ধর্ণা দেয়া। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনার উত্তম উপায় হলো নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া। আর আল্লাহর বাণীও তাই, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও।’ দ্বিতীয়ত, সদকা করা, সদকা আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে এবং বিপদ-মুসিবত দূর করে। তৃতীয়ত, নিয়মিত মধু ও কালোজিরা খাওয়া। আল্লাহপাক মধুকে শেফা বলেছেন আর রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, কালোজিরা মৃত্যুছাড়া সকল রোগের ঔষধ। আমার পরিচিত একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজের সাথে মোবাইলে কথা বলার সময় তাঁকে টিকা নিয়েছেন কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এখনো নেয়া হয়নি। সাথে সাথে বললেন, আমি আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে নিয়মিত মধু ও কালোজিরা খাই। হ্যাঁ, আমাদের এমন বিশ্বাসই থাকা দরকার। চতুর্থত, দাওয়া (চিকিৎসা) গ্রহণ। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, সকল রোগের ঔষধ আছে এবং ঔষধ যোগাড় হলে আল্লাহর হুকুমে সে আরোগ্য লাভ করে।

আমরা আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর গুণ ও ক্ষমতার এক অতি ক্ষুদ্র অংশ তিনি মানুষকে দান করেছেন, যাতে মানুষ যথার্থ আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং এগুলো কাজে লাগানো ইমানেরই দাবী। আমরা যেমন কেবল নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিকিৎসার ওপর নির্ভর করবো না, তেমনি সব বাদ দিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে চুপ থাকবো না। আমরা সেই হাদিসটি জানি, জনৈক আগন্তুক উটের পিঠে আরোহণ করে এসে বলে ‘তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ’। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, উটটা বেঁধে বলো, ‘তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ’। করোনার প্রতিষেধক হিসেবে ফ্রি টিকা প্রদান করা হচ্ছে। কতজন টিকা গ্রহণ করেছেন জানতে চাইলে মাত্র ১১জন হাত উঠান।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে করোনায় মৃত্যু  আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেলে আমাদের বন্ধু মাধবপুর গ্রামের হাজী আবু বকরের ছেলে ডা. আব্দুল্লাহর (করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করে) কাছে জানতে চেয়েছিলাম, করোনায় কি শ্রমজীবী মানুষ মারা যাচ্ছে বা টিকা গ্রহণ করেছে এমন লোক কি আক্রান্ত হচ্ছে? জবাবে সে জানিয়েছিল, সব শ্রেণি-পেশার মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছে এবং টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ আক্রান্ত হচ্ছে কিন্তু তারা মারা যাচ্ছে না বা তাদের অবস্থা খুব সিরিয়াসও হচ্ছে না। তার কথা, টিকা গ্রহণের ফলে করোনায় ডাক্তারদের মৃত্যু নেই বললেই চলে।

আমাদের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আব্দুল মুহিত করোনায় আক্রান্ত হয়ে সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর ছোট ভাই মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী তাঁকে দেখে এসে দেশবাসীর কাছে দোয়া চান এবং বলেন, আমার বড় ভাই দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেছেন বিধায় তাঁর ব্যাপারে আমরা একটু আশাবাদী। হ্যাঁ, টিকা গ্রহণ করলে আপনার মধ্যে আশার সঞ্চার হবে। টিকা গ্রহণ এবং সতর্কতা অবলম্বন প্রসঙ্গে বরেণ্য আলেমে দ্বীন মাওলানা কামালুদ্দিন জাফরি বলেছেন, রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে চিকিৎসা ও সতর্কতা অবলম্বন আমাদের ইমানেরই দাবী। কোনো মানুষের এখতিয়ার নেই তার নিজের ক্ষতি করার।

আমি মনে করি, করোনা একদিকে আশীর্বাদ আবার বিপরীতপক্ষে গজব। বিপদাপদ আল্লাহপাক দান করেন তাঁর বান্দাদের তাঁর পথে ফিরে আসার জন্য। এই করোনা আল্লাহর অনেক বান্দাকে নাফরমানি ছেড়ে আল্লাহর অনুগত বান্দা করেছে। সত্যিই তারা ভাগ্যবান এবং করোনা তাদের জন্য আশীর্বাদ। আল্লাহর অনুগত বান্দা হয়ে একটি দিন বেঁচে থাকা নাফরমান হয়ে শত বছর বাঁচার চেয়েও উত্তম। করোনা মানুষের মাঝে মৃত্যুভয় জাগ্রত করেছে এবং মৃত্যুভয় মানুষকে নাফরমানি ত্যাগ করে আল্লাহর অনুগত বান্দা হতে সাহায্য করে। করোনা মানুষকে তওবা করার সুযোগ দান করে। মৃত্যু দুনিয়ার জীবনের চিরসমাপ্তি এবং মৃত্যু মানে আখেরাতের যাত্র শুরু। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের জন্য জান্নাত-জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছেন। জান্নাতে আমরা পাব চিরন্তন জীবন, মৃত্যু কখনই স্পর্শ করবে না। রোগ-ব্যাধি-বার্ধক্য, অভাব- অনটন মানুষের দুঃখের কারণ কোনো কিছুই জান্নাতে থাকবে না।

জান্নাতের বিপরীতে জাহান্নাম। সেটিও চিরন্তন। জাহান্নামে প্রবেশ করে সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জাহান্নাম প্রস্তুত রয়েছে আল্লাহর নাফরমান বান্দা ও জালেমদের জন্য। করোনার কারণে আমরা মৃত্যুকে গভীরভাবে লক্ষ করছি কিন্তু আমারও মৃত্যু আসতে পারে সেই উপলব্ধি নেই। আল্লাহপাক অনেককে দয়া করে ICU থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় কেউ যদি সংশোধিত না হয় তাহলে তার চেয়ে বড় হতভাগা আর কেউ নেই। ওরাই আল্লাহর গজবে পতিত।

জান্নাত পাওয়ার জন্য খুব বেশি আমলের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন তাগুতকে অস্বীকারকারী ইমান ও আল্লাহর প্রতি বিনয় ও আনুগত্য। আল্লাহর বাণী, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও তাগুতকে অস্বীকার করো। কালিমা তাইয়েবার দাবীও তাই। আল্লাহকে ইলাহ মানো এতটুকু নয় বরং আল্লাহ ছাড়া সকল ইলাহকে অস্বীকার করো। বর্তমানে আমরা আল্লাহকে মানার পাশাপাশি তাগুতকেও মানি অর্থাৎ শিরক করি। কোনো সময় তাগুত হয় শয়তান যে আমাদেরকে আল্লাহর নাফরমানিতে প্ররোচনা দেয়, আবার কখনো নফস, কখনো ব্যক্তি বা দল বা রাষ্ট্রশক্তি অর্থাৎ যেসব শক্তি আমাদেরকে আল্লাহর নাফরমানিতে বাধ্য করে। নামাজ রোজা আদায়ের পাশাপাশি ঘুষ, ওজনে কম ও ভেজাল দেয়া, মানুষের প্রতি জুলুম করা যত রকমের আল্লাহর নাফরমানি রয়েছে তার মূলে রয়েছে তাগুতের প্রতি আনুগত্য। অন্যায়-অবিচারের পেছনে রয়েছে নফসের (তাগুত) প্রলোভন ও দুনিয়ায় বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসহীনতা।

গ্রামে মসজিদগুলোয় মুসল্লিদের উপস্থিতি বেশ বিলম্বে হয়। জুমার দিন আমাদের ঈদের দিন। সকাল সকাল গোসল করে ভালো পোশাকে সজ্জিত হয়ে মসজিদে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, মসজিদে প্রথম উপস্থিতকারীর জন্য উট কুরবানি এবং পরবর্তীতে গরু, ছাগল/দুম্বা, মুরগি কুরবানির সওয়াব লেখা হয়। খতিব মহোদয় খুতবা দানের জন্য মিম্বরে আরোহণের সাথে সাথে ফেরেশতারা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শ্রবণে মনোযোগী হন। আল্লাহর ভাণ্ডার অফুরন্ত। শুধু নেয়ার দরকার।

আল্লাহর রসুল সা. আরো বলেছেন, প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর মধ্যে কত সওয়াব মানুষ যদি জানতো তাহলে কারা দাঁড়াবে তা নির্ধারণের জন্য লটারি করতে হত। দ্বিতীয়, তৃতীয় কাতারে দাঁড়ানো প্রসঙ্গেও সওয়াবের কথা বলা হয়েছে। মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নামাজ পড়ে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে কাতার পূর্ণ করে বসা মসজিদের আদব। পরে এসে ডিঙ্গায়ে ডিঙ্গায়ে যাওয়া আদবের খেলাপ। প্রথম দিকের কাতারে জায়গা খালি রাখার ফলেই এমনটি হয়।

আল্লাহর দেয়া শাস্তি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারো নেই

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

কলামিস্ট এবং সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button