ঈমানের অগ্নিপরীক্ষায় সফল আসিয়া (আ.)

বিশেষ দ্রষ্টব্য
  • জুমার খুতবা: ০৬.০৮.২০২১ শ্রুতিলিখন : প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

 

আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল (সা)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর নারী জাতির মডেল দুইজন নারী ফেরাউনের স্ত্রী হজরত আসিয়া (আ) ও হজরত মরিয়ম (আ) প্রসঙ্গে সুরা আত্ তাহরিমের ১১ ও ১২ নং আয়াত উদ্ধৃত করেন। ১১ নং আয়াতের সরল অর্থ-

‘আল্লাহ তায়ালা মোমিনদের জন্য ফেরাউনের স্ত্রীকে (অনুকরণযোগ্য) এক উদাহরণ হিসেবে পেশ করেছেন, (সে প্রার্থনা করেছিল) হে রব, জান্নাতে তোমার পাশে আমার জন্য একখানা ঘর বানিয়ে দিয়ো, আর তুমি ফেরাউন ও তার কর্মকাণ্ড থেকে বাঁচিয়ে রেখো, তুমি আমাকে এ জালেম সম্প্রদায় থেকে উদ্ধার করো।’

রসুলুল্লাহ (সা.) চারজন নারীকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তাঁরা হলেন মা খাদিজা (রা.), (ফাতেমা রা.), মরিয়ম (আ) ও আসিয়া (আ)- মুসনাদে আহমাদ। তাঁরাই হলেন মুসলিম নারীদের জন্য অনুকরণযোগ্য (মডেল)। দুর্ভাগ্য, আমাদের তরুণ সমাজ চরিত্রহীন, মাদকাসক্ত ও লম্পট অনেককে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে নিজেদের দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই ধ্বংস করছে। আমাদের আদর্শ ও অনুকরণযোগ্য (মডেল) তারাই হতে পারেন যারা আমাদেরকে দুনিয়ায় পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের সাথে আখেরাতে নাজাতের পথ দেখাতে পারেন। খতিব মহোদয় বলেন, পরীমণিদের মতো ভ্রষ্টা কেউ আমাদের তরুণ-তরুণীদের মডেল হতে পারে না। যাদের বাসায় মদের আড্ডা জমে, সেখান থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। মদের লাইসেন্স বাতিল করে  যুবসমাজকে রক্ষার জন্য তিনি জোর দাবী জানান। মহীয়সী চারজন নারীর মধ্যে কুরআনে বর্ণিত ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া (আ.)-এর অগ্নিপরীক্ষা তিনি তুলে ধরেন।

ফেরাউন ছিল সর্বকালের সেরা জালেম ও মিশরের স্বৈরশাসক। সে ছিল কিবতি সম্প্রদায়ের। মুসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইলের বংশধর। বনি ইসরাইলরা যাতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে না উঠে সেজন্য সে তাদের সকল ছেলে শিশুকে হত্যা করতে থাকে। মুসা (আ.)-এর জন্মের পর আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কৌশলে তাঁর লালন পালনের ব্যবস্থা ফেরাউনের ঘরেই করেন। হজরত আসিয়া (আ) ছিলেন ফেরাউনের স্ত্রী, তিনি মুসা (আ.)-কে নিজের কাছে রেখে লালন-পালন করতে চাইলে ফেরাউন না করেও স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও দুর্বলতার কারণে শেষে সম্মত হয়। হজরত আসিয়া (আ) ছিলেন পরমা সুন্দরী ও বিদুষী মহিলা। মুসা (আ.) নবি হিসেবে মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁর এই দাওয়াতে কিবতিদের মাঝে সামান্যই সাড়া পড়ে। হজরত আসিয়া (আ), তাঁর দাসী এবং এজন কোষাধ্যক্ষ বা বাবুর্চি সপরিবারে মুসা আ.-এর প্রতি ইমান আনেন- আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত মেশকাত শরিফের ৬১ নং হাদিসে পাওয়া যায়।

ফেরাউনের পেশাদার যাদুকরদের সকল যাদু মুসা (আ.)-এর মুজেজা লাঠি অজগর হয়ে গিলে ফেলায় যাদুকররা বুঝে ফেলে মুসা (আ.) যে দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করছেন তা কোনো যাদু নয়। পরিণতির কথা চিন্তা না করেই যাদুকররা তাৎক্ষণিক ইমান আনেন। ফেরাউন যাদুকরদের হত্যা করে। এই ঘটনার পর পরই আসিয়া (আ) প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, আমি ইমান আনলাম মুসা (আ.) ও হারুনের (আ.)-এর রবের ওপর। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ। ফেরাউন নিজের ঘর সামলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রথমে সতর্ক করলো এবং তাকে রব না মানার পরিণতি জানিয়ে দিল।

হজরত আসিয়া (আ)-কে ভীত-সন্ত্রস্ত করার লক্ষ্যে প্রথমে দাসীকে নিয়ে এসে রব মানার জন্য বললে সে সরাসরি অস্বীকার করে। দাসীর দুটি মেয়ে ছিল এবং বড় মেয়েকে লটকিয়ে বেত্রাঘাত করে। কোনো কিছু করে দাসীকে ইমান থেকে নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়। শেষে বড় মেয়েকে তপ্ত তেলের কড়ায়ে নিক্ষেপ করে এবং ছোট মেয়েকে এনে দাসীকে একই কথা বললে, দাসী ইমানের প্রশ্ন অবিচল থাকেন। ছোট মেয়েকেও তপ্ত কড়ায়ে ফেলার পরে পালা দাসীর। তাকে লটকিয়ে এবং পায়ে-হাতে পেরেক পুরে শাস্তি প্রদান করে। তারপরও একই প্রস্তাব দেয়। দাসী বলেন, আমার কোনো কিছু চাওয়ার নেই। একটিই চাওয়া, মেয়েদের ও আমার হাড়-হাড্ডি একই গর্তে যেন পুঁতে রাখা হয়। বায়তুল মোকাদ্দেসের সন্নিকটে তাদের পুঁতে রাখা হয়। মহানবি (সা.) মিরাজের সময় বায়তুল মোকাদ্দেসে নামাজ আদায় করেন এবং সেসময়ে জিবরাইল (আ.)-কে বলেন, আমি জান্নাতের সুঘ্রাণ পাচ্ছি। জিবরাইল (আ.) বলেন, জান্নাত তো অনেক দূরে, এখানে ফেরাউনের দাসী ও তার দুই মেয়েকে কবরস্থ করা হয়েছে।

হজরত আসিয়া (আ)-এর সম্মুখে এসব ঘটনা ঘটায়। তাঁকে বলা হয়, সামনে এই রাজপ্রাসাদ এবং তুমি রাজরানী। আমাকে রব মানলে সব পাবে অন্যথায় ঐ দাসীর মতো পরিণতি ভোগ করতে হবে। হজরত আসিয়া (আ) ইমানের প্রশ্নে অবিচল থাকেন। তখন তাঁকে রাজপ্রাসাদের দিকে মুখ করে লটকানো হয় এবং হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে দেয়া হয়। পেরেক ঠুকে শাস্তিদানের জন্য ফেরাউনকে বলা পেরেকওয়ালা। তার ওপর চলে নানাবিধ অত্যাচার। যে রাজকর্মচারীরা তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকতো তারাই তখন ফেরাউনের পক্ষ হয়ে রাজরানীর ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে এবং এই নির্যাতনের মধ্যেও একই প্রস্তাব- ফেরাউনকে রব মেনে নিয়ে আরাম-আয়েশের জীবন-যাপনের হাতছানি। এমন অবস্থায় ইমান গোপন রেখে কুফুরি বাক্য (ফেরাউনকে রব মেনে নেয়া) উচ্চারণে কোনো গুনাহ ছিল না। না, হজরত আসিয়া (আ) ফেরাউনের বন্দী জীবন-যাপনের চেয়ে শাহাদতের মর্যাদা নিয়ে তাঁর রবের কাছে ফিরে যাওয়াকে উত্তম বিবেচনা করে ইমানের দৃপ্ত ঘোষণা প্রদান করেন।

শেষে একটি বড় পাথর খণ্ড দিয়ে আঘাত করার পূর্বমুহূর্তে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, ‘হে রব, জান্নাতে তোমার পাশে আমার জন্য একখানা ঘর বানিয়ে দিয়ো, আর তুমি ফেরাউন ও তার কর্মকাণ্ড থেকে বাঁচিয়ে রেখো, তুমি আমাকে এ জালেম সম্প্রদায় থেকে উদ্ধার করো’। পাথরখণ্ড নিক্ষেপের পূর্বে আল্লাহপাক তাঁর মৃত্যু দান করেন এবং দুনিয়ায় থাকতেই তিনি জান্নাতে তাঁর ঘর দেখতে পান। পাথরখণ্ড তাঁর লাশের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। তিনি জান্নাতে তাঁর ঘর চেয়েছেন আল্লাহর পাশে। আমরাও বাড়ি-ঘর করার সময় সৎ প্রতিবেশি তালাশ করি। আর আসিয়া (আ) স্বয়ং তাঁর মহান রবকেই চেয়েছেন। আল্লাহপাক তাঁর চাওয়াকে কুরআনে আয়াত হিসেবে উল্লেখ করে তাঁকে সম্মানিত করেছেন এবং মোমিনদের জন্য উদাহরণ হিসেবে চিরস্থায়ীভাবে রেখে দিয়েছেন। শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম এবং আল্লাহপাক এই গুনাহ কখনই ক্ষমা করবেন না। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতদেরকে বলেছেন, তোমরা কখনই আল্লাহর সাথে শিরক করবে না, যদি তোমাদের হত্যা করা হয় বা আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। 

আল্লাহপাক হজরত আসিয়া (আ)-কে মোমিনদের জন্য মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সকল সুখ-সাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে আখেরাতের স্থায়ীজীবনের সুখ-শান্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। আমরা আল্লাহর জন্য সামান্য সুখ-শান্তিকে উপেক্ষা করতে পারি না। অথছ হজরত আসিয়া (আ) রাজরানীর পদমর্যাদা, কতো আরাম-আয়েশ, ক্ষমতা সবকিছু উপেক্ষা করে জেনেবুঝে জালেম ফেরাউনের শাস্তি মাথা পেতে নিলেন। মোমিনদের যথার্থই অনুকরণযোগ্য (মডেল) এবং কেয়ামত পর্যন্ত তিনি প্রেরণা হয়ে থাকবেন। তিনি Celebrated না হলে আর কে হবেন?

সমাজের অবক্ষয়ে খতিব মহোদয় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের তরুণ-তরুণীরা এমন লোকদেরকে নিজেদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে যারা তাদেরকে দ্রুত জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিবর্তন হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-সাদী দিতে একসময় মেয়ের যোগ্যতা হিসেবে তার কুরআন তেলাওয়াত, নামাজ, পর্দা ও আচার-আচরণ দেখা হতো, আর এখন জানতে চাওয়া হয় মেয়ে নাচ/গান জানে কি না। ইসলাম থেকে আমরা দ্রুত সরে যাচ্ছি। ফলে দুনিয়ার জীবনে অশান্তির পাশাপাশি আমরা আখেরাতও হারাচ্ছি।

যুবসমাজের চরিত্র ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বিদেশী চ্যানেলের মাধ্যমে অশ্লীলতার প্রসার ও মাদকের বিস্তৃতিকে দায়ী করেন। ভারতীয় চ্যানেলসমূহ আমাদের পারিবারিক জীবনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি অবিলম্বে অশ্লীলতা রোধে বিদেশী চ্যানেল ও মাদকের লাইসেন্স বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবী জানান।

করোনা বর্তমান বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। আমাদের অনেক প্রিয়জনসহ প্রতিনিয়ত প্রচুর মানুষ দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছেন। করোনা প্রতিনিয়ত আমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে দিচ্ছে। আল্লাহকে ভয় করে চলার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানার সাথে করোনার টিকা নেয়ার জন্য তিনি তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান। টিকা নেয়ার সাথে সাথে সাথে হজ ও উমরার নিয়ত করার কথাও বলেন। খতিব মহোদয় করোনাসহ নানাবিধ বিপদাপদ থেকে আল্লাহর কাছে হেফাজত কামনা করেন।

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

কলামিস্ট এবং সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button