”তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)
আমাদেরকে সৃষ্টি-ই করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ করার জন্য অথচ আজ আমরা কি করছি?মানবজাতির কল্যাণ তো দূরে থাক বরং সুযোগ পেলেই ক্ষতি করি বা করার চিন্তা মাথায় আসে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে আজ ছিনতাই-খুন-ধর্ষণ- ইভটিজিং-প্রতারণা ও অশ্লীলতায় ছেয়ে গেছে। দেখে কেউ বলবেই না যে এটা একটা মুসলিম অধ্যুষিত দেশ অথবা এটাই বলবে যে দেখ মুসলিমদের চরিত্র!
যদি আমরা সত্যিই মানবজাতির কল্যাণ করতাম তাহলে কি আজ এই দুর্দশা দেখতে হতো? এতো গেল আইন-শৃংখলার অবনতি। এবার আসুন দেখে নেয়া যাক সামাজিক অবক্ষয় কতখানি?
আজ রাস্তা-ঘাটে চলতে গেলে রাস্তার পাশে, ফুটওভার ব্রিজে, বাস স্ট্যান্ডে ও স্টেশনে সর্বত্র অসহায় ও পঙ্গুদেরকে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। অনেকসময় তাদের অবস্থা এতটাই মর্মান্তিক থাকে যে দেখার মতো অবস্থা থাকে না। সমাজের কিছু অসৎ ও ধান্দাবাজ ব্যবসায়ীরা পরিকল্পিতভাবে তাদেরকে পঙ্গু বানিয়ে পাবলিক সিমপ্যাথি দেখিয়ে ব্যবসা করে। আমরা তাদের এমন অবস্থা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে টাকা পয়সা দিয়ে থাকি কিন্তু এতে তাদের কোনো উপকার হয় না বরং তারা যে তিমিরে থাকে সে তিমিরেই পড়ে রয়। এখানে যদি তাদেরকে উপকার করতে চাই তাহলে তাদেরকে ঐসব চক্র থেকে উদ্ধার করে প্রোপার ট্রিটমেন্ট করিয়ে একটি সুস্থ জীবন এবং আয়ের একটি ব্যবস্থা করতে হবে।
আমরা কেন মানুষের পাশে দাঁড়াবো?
আল্লাহ ও রসুল (সা.) এর নির্দেশ:
ইসলামের প্রধান কাজই হলো মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা এবং গরিব-মিসকিন-অভাবীদের খাবার খাওয়ানো। ইসলামে জাকাতের মূল স্পিরিট-ই কিন্তু মানুষকে এমনভাবে স্বাবলম্বী করা যেন সে নিজেই নিজের খরচ চালাতে পারে এবং সময়ের ব্যবধানে সেও মানুষকে একইভাবে সাহায্য করতে পারে। মানুষের বিপদে কেন পাশে দাঁড়াবো সেই বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের কিছু কথা এখানে তুলে ধরছি –
• ”তাদের (বিত্তশালী) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” (সুরা যারিয়াত-১৯)
• ”তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা তার আহবানে সাড়া দিয়ে দরিদ্র, ইয়াতিম ও বন্দিদের খাদ্যদান করে।” (সুরা দাহর-৮)
• যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ১০০টি প্রয়োজন পূরণ করবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন। (সহিহ মুসলিম-২৫৬৬)
• আল্লাহ তায়ালা বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন যতক্ষণ সে তার অপর ভাইয়ের সাহায্যে থাকে। (সহিহ মুসলিম-২৩১৪)
কুরআন ও হাদিসের কথাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, গরিব-মিসকিন-অভাবী ও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের স্বাবলম্বী করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ যার জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। এসব অসহায় মানুষদের সাহায্য করার মধ্য দিয়েই মূলত আল্লাহকেই সাহায্য করা হয় এবং তার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
কিভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি?
আমরা অনেকে মনে করি এসব কাজে প্রচুর টাকার দরকার হয় আর আমার যেহেতু সামর্থ্য নেই তাই আমার দ্বারা এসব কাজ সম্ভব নয় বা আজ টাকা থাকলে অনেকের জন্য অনেক কিছু করতে পারতাম – এগুলো না করার বাহানা ছাড়া কিছুই না। টাকা না থাকলেও মানুষকে সাহায্য করা যায়। শুধু দরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষকে সাহায্য করার মানসিকতা।
আসুন দেখে নিই কিভাবে উপকার করতে পারি –
• মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলাটাও একটা সদকা। হতে পারে সাক্ষাতের সময় আমার সুন্দর একটি হাসি দেখে তার বিষন্ন মনটাও ভালো হয়ে গেল। এটাই বা কম কিসের বলুন?
• আমাদের কাছে কেউ যদি আসে কোনো কিছু শেয়ার করার জন্য তাহলে আমাদের উচিৎ তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা যেন সে বুঝতে পারে তার কথাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর এতে সে আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।
• পরামর্শের জন্য আসলে ভালো পরামর্শ দেয়া এবং ভালো কাজে উৎসাহ দেয়া, এটাও একটা সদকা।
• নিজ নিজ পেশার জায়গা থেকে সর্বাত্মক হেল্প করা। যেমন কোনো রোগীর রিপোর্ট ১০ মিনিটে দেয়া সম্ভব হলে সেটা ১০ মিনিটেই দেয়া, তার জন্য অযথা বিলম্ব করে তাকে হয়রানী না করা। আবার যদি দেখা যায় যে রিপোর্টটা এই মুহূর্তে দেয়া সম্ভব না, সেটার জন্য আগে দু:খ প্রকাশ করে সুন্দরভাবে তাকে বুঝানো এটা বলে যে, “আমি আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি। এই মুহূর্তে রিপোর্ট দিতে পারলে আমার খুবই ভালো লাগতো কিন্তু আন্তরিকভাবে দুঃখিত যে দিতে পারছি না। তবে চেষ্টা করবো দ্রুত দেয়ার জন্য।” রোগী বা যিনি রিপোর্ট নিতে আসছেন তিনি আমাদের প্রতি অনেক খুশি হয়ে যাবেন। অর্থাৎ রোগীর সাথে এমন কোমল ব্যবহার করা যেন রোগী মনে করে যে তাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, তার কাজটাই আগে করা হচ্ছে।
• প্রত্যেকটা মানুষেরই আত্মসম্মানবোধ আছে। এই জায়গাতে আমরা সবাই ভীষণ সেনসিটিভ। মানুষকে খুব অল্পতেই খুশি করা যায় যদি তাকে তার সুন্দর নাম ধরে ডাকা হয়। মানুষকে সম্মান করার ব্যাপারে ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে। মানুষ অসম্মানিত হয় এমন কোনো কাজ যেমন মানুষের সামনে তাকে তুচ্ছ করে কথা বলা, গালমন্দ করা, খারাপ নাম ধরে ডাকা, তাকে নিয়ে উপহাস করা, আড়ালে তার দোষপ্রচার করা এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া- এসবই সুরা হুমাযায় কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এসব কাজ যদি কেউ করে তবে তার জন্য শাস্তি হিসেবে আল্লাহর আগুনের কথা বলা হয়েছে যা প্রচন্ডভাবে উৎক্ষিপ্ত।
• টাকা না থাকলেও গরিব-অসহায়-দুস্থ ও মিসকিনদের সাহায্য করা যায়। এর জন্য প্রথমে নিজের সেল্ফ ব্র্যান্ডিং ভ্যালু বাড়াতে হবে যেন আমাদের কথার ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে। এরপর কিছু ডোনার এবং কিছু প্রফেশনাল মানুষদের সাথে আমাদের ভালো যোগাযোগ রাখতে হবে। আমি মানুষের জন্য কিছু করতে চাই, কেন চাই সেটাও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। মোট কথা আমি যে কাজটা করতে চাই সেটা যে কারো মাধ্যমে প্রয়োজনটা পূরণ হলেই হলো।
• লেখালেখির মাধ্যমেও সমাজের বিত্তশালী মানুষের কাছে অসহায় মানুষের জন্য সাহায্যের আবেদন জানাতে পারি যেন তারাও তাদের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে।
• আরো কিছু ছোট খাটো কাজ করতে পারি যেমন রিক্সাওয়ালাকে বাড়তি কিছু টাকা দেয়া, কাজের মেয়ের উপর কাজের চাপ কমিয়ে দেয়া, ভিক্ষুককে সাধ্যমতো খাওয়ানো, মাঝে মাঝে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নেয়া এবং দুআ নেয়া – এসবই কিন্তু আমাদের সাধ্যের ভিতর। আমরা চাইলেই করতে পারি।
• আর যদি নিজেরা ভালো উপার্জন করতে পারি সেক্ষেত্রে তো কোনো কথাই নেই। সাধ্যমতো চেষ্টা করবো যেন মানুষকে হেল্প করতে পারি। মূলত আমরা দান সদকা বেশি করে করবো এবং মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসবো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কারণ এসব কল্যাণমূলক কাজ করলে আল্লাহ আমাদেরকে অনেক বিপদের হাত থেকে রক্ষা করবেন।
মানুষের পাশে না দাঁড়ালে কী ক্ষতি?
আমরা যদি মানুষের পাশে না দাঁড়াই তাহলে কী হবে? – এ প্রসঙ্গে প্রিয়নবি (সা.) বলেছেন, “যে মানুষকে ভালোবাসে না, মানুষের পাশে দাঁড়ায় না সে মানুষের ভালোবাসা পায় না”। আসলে ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। ইসলাম সমাজে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমাতে চায়। এ কারণেই তাদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছে। আসুন জেনে নেই অসহায়-গরিব-এতিম ও মিসকিনদেরকে খাবার না দেয়ার ব্যাপারে ইসলাম কী বলে –
• তুমি কি তাকে দেখেছ যে আখিরাতের পুরস্কার ও শাস্তিকে মিথ্যা বলছে? সেই তো এতিমকে ধাক্কা দেয় এবং মিসকিনকে খাবার দিতে উদ্বুদ্ধ করে না। (সূরা মাউন–১-৩)
• সেখানে তারা অপরাধীদের জিজ্ঞেস করবে, “কিসে তোমাদের দোযখে নিক্ষেপ করলো?” তারা বলবে, “আমরা নামাজ পড়তাম না, অভাবীদের খাবার দিতাম না, সত্যের বিরুদ্ধে অপবাদ রটনাকারীদের সাথে মিলে আমরাও রটনা করতাম এবং প্রতিফল দিবসকে মিথ্যা মনে করতাম” (সুরা মুদ্দাস্সির- ৪১-৪৬)
উপরের দুটি আয়াত পড়ার পর এবার কি অস্বীকার করতে পারবো যে ইসলামে অসহায়-অভাবী ও মিসকিনদের খাবার না খাওয়ানো কতটা গুরুতর অপরাধ? এতদিন ভাবতাম যে কিছু করা দরকার কিন্তু আজ লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এই কাজটা করতে আমরা বাধ্য। অভাবীদের খাবার না দেয়াটাকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে- চিন্তা করা যায়?
বাধ্য হয়ে কোনো কাজ করলে একটা বোঝা অনুভব হতে পারে। তার চেয়ে আসুন কাজটা ভালোবেসে করি তাহলে বোঝা তো মনে হবেই না বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি পাবো। আমার দাদাকে দেখতাম সমাজের অসহায় এসব মানুষের জন্য পাগলের মতো ছুটে চলতে। তিনি সবসময় পেরেশান থাকতেন যে তিনি আসলে তাদের জন্য কিছু করতে পারছেন কি না। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন কি না। তাদের সাহায্য করার জন্য তিনি কারো নেতিবাচক কথায় ভ্রুক্ষেপ করেননি কারণ তিনি বুঝেছিলেন এটাই আসল ইসলাম। আমার পাঠকবৃন্দদের যদি কেউ এই ধরনের সামাজিক কাজ করতে চান তাহলে আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে আমার দাদাকে নিয়ে লেখা ’মো.লুৎফর রহমান: যে জীবন প্রেরণার’ বইটা পড়ার জন্য। তাহলে আশা করা যায় কাজটা সহজ হবে। আমার সেসব মানুষের প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে যারা মানুষের জন্য কিছু করতে চায় এবং সাধ্যমতো করেও। আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে সর্বোচ্চ সম্মানিত করুন। আমিন।
অবশেষে কিছু কথা না বললেই নয়। আমরা অনেকেই সামাজিক কাজ আর পারিবারিক জীবনের ভিতরে ব্যালান্স করতে পারি না। সামাজিক কাজ করলে এমনভাবে ঝুঁকে পড়ি যে অন্যদিকে আমার উপর যে নিজের পরিবারের সদস্যদের অধিকার আছে – এটাই ভুলে যাই। তখন আমাদের ভালো কাজগুলোও আর সেভাবে মনমতো হয় না। একজন স্বামীর উপর স্ত্রীর এবং স্ত্রীর উপর স্বামীর হক রয়েছে। সামাজিক কাজ করতে গিয়ে যদি পরিবারকে অবহেলা করি তাহলে কিন্তু দুনিয়া এবং আখিরাত সবই যাবে। কারণ ইসলাম আসলে ব্যালান্স করে চলতে বলে।
আরেকটি বিষয় খু্বই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আমাদেরকে তো এসব সামাজিক কাজ করতেই হবে আর তাই বিয়ের সময় জীবনসঙ্গী পছন্দ করার ক্ষেত্রে এমন কাউকে চুজ করতে হবে যে আমার মনটাকে বুঝবে এবং আমার কাজে হেল্প করবে। একসাথে মিলে সামাজিক কাজ করা যেতে পারে। জীবনে মনের মতো একজন জীবনসঙ্গী যে কতটা প্রয়োজন সেটা যুগে যুগে প্রত্যেক মহামানবের জীবনে তাকালেই দেখতে পাবো। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মিশনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, তিনি যে একাগ্রচিত্তে তার মিশন চালিয়ে যেতে পেরেছেন সেটা শুধুমাত্র তার প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.) এর অপরিসীম ধৈর্য্য, ত্যাগ ও সাপোর্টের কারণে। আল্লাহর রসুল সা. যখন মানবজাতির মুক্তির জন্য হেরাগুহায় ধ্যান করতেন তখন তার স্ত্রী খাদিজা (রা.) তার স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। স্বামী হযরত মুহাম্মদ সা. এর জন্য মা খাদিজা রা. এর যে অবদান তা অতুলনীয়। এজন্যই কাজী নজরুল ইসলাম নারীর ভূমিকা নিয়ে কবিতায় বলেছেন,
“বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার আনিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”
কাজেই জীবনে কোনো মিশন বা শুভ কাজ করতে হলে প্রয়োজন একজন মনের মতো সঙ্গী যিনি বিপদে আপদে আপনার ছায়ার মতো সঙ্গী হবে। আর
জীবনসঙ্গী যদি মনের মতো না হয় তাহলে সামাজিক কাজ তো দূরের কথা সেই সংসারটাই জাহান্নামে পরিণত হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আল্লাহ আমাদেরকে গরিব-দুঃখী-অসহায়-মিসকিন ও অভাবীদের পাশে দাঁড়ানোর তৌফিক দিন। আমিন।