সুন্নাতি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (৪)
অধ্যাপক আবু জাফর এর ‘ইসলাম ও আত্মঘাতী মুসলমান’ বই থেকে
ধর্ম রাষ্ট্র ও পৃথিবী-নিরপেক্ষ মুদিতনেত্র মুসলমানের এই ইসলামপ্রীতি আসলে একটি তামাশা। নিশ্চয়ই তামাশা, কারণ ইসলামের যারা শত্রু, তাদের ভয়ে হোক বা তাদের প্রতি সখ্যবশত হোক, যে-মুসলমান সকল ঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদ নিরপেক্ষ থাকতে চায়, আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুল সা. তাদেরকে মুসলমান বলে স্বীকারই করেন না, বরং তারা মুনাফিক বলেই চিহ্নিত।
মুনাফিকই বটে! পৃথিবীতে রাজত্ব করবে ইবলিস ও তার অনুচর ক্রীতদাসবৃন্দ, আর ‘সুন্নাহদরদী’ মুসলমান দোয়া-দরুদের আড়ালে হল্কা-জিকিরের আবেশে- অনুরাগে আত্মগোপন করে থাকবে, ইবলিসের প্রভুত্ব মেনে নিয়ে সুখে-স্বচ্ছন্দে দিন গুজরান করবে, আল্লাহদ্রোহী শক্তির প্রতিরোধ-তো দূরের কথা, কোনরকম ঝামেলার মধ্যেই যাবে না, এর চেয়ে গুরুতর ও ক্ষমাহীন মুনাফিকী আর কী-হতে পারে!
অসংখ্য মুসলমান আজ হুবহু হামামের মতো। হামাম ছিল ফেরাউনের মুখ্যমন্ত্রী। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সে ছিল ফেরাউনী-বিধানের সমর্থক ও সহযোগী। শুধু একটি জায়গায় একটু ব্যতিক্রম ছিল; কৌতুক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দাঁড়ি টুপি পোশাকে-আশাকে সে ছিল মুসা আ.-এর অনুকারী। আমরাও ঠিক এইরকমই; জীবনের সকল পদক্ষেপে কাফের-মুশরিক-মুনাফিক পৌত্তলিকদের আইন-আদালত, নিয়ম-রীতি ও শাসন, রসম-রেওয়াজ কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহণ করলাম, শুধু ইসলামের প্রতি মহব্বতের তীব্রতায় রসুল সা.-এর টুপি পাগড়ি- দাঁড়িকে নাজাতের নির্ভুল অবলম্বন হিসাবে আঁকড়ে ধরেছি।
এটা সুন্নাত নয়, এটা হামামী তামাশা; এটা মুহব্বত নয়, এটা লঘু চালাকি ও গুরুতর বিভ্রান্তি। এই তামাশা ও বিভ্রান্তি নিয়ে পৃথিবীতে কিছু স্বার্থসিদ্ধি হলেও হতে পারে, কিন্তু আল্লাহ’র সন্তুষ্টি ও পারলৌকিক সাফল্য লাভের খুব-একটা আশা নেই।
বলাই বাহুল্য, রসুল সা.-এর সুন্নাহ অনুসরণ করেছেন তাঁর সাহচর্যধন্য সাহাবাবৃন্দ, যাঁদের সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেছেন- ‘আল্লাহ তাদের উপর রাজী, তারাও আল্লাহর উপর রাজী’ (সুরা বায়্যিনাহ)। এই সাহাবিদের সম্পর্কে রসুল সা. পরম আস্থা ও প্রীতিভরে জানিয়েছেন, তারাই পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম জামাত এবং তাঁর রসুল সা.-এর ঘোষণা থেকে বুঝা যায়, সাহাবি রা.-দের স্থান ও মর্যাদা কত অভাবনীয় সুউচ্চে প্রতিষ্ঠিত।
আল্লাহর নবি এই কথাও বলেছেন, তাদের যে-কোনো একজনকে নমুনা হিসাবে গ্রহণ করলেও আর পথভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা নেই। এবং মুসলিম মিল্লাত ক্রমশ নানা বিভক্তির শিকার হয়েছে সত্য, কিন্তু এ-বিষয়ে কোনো মতানৈক্য নেই যে, একজন নগন্যতম সাহাবির যে-মর্যাদা, পরবর্তীকালের কোনো উৎকৃষ্টতম উম্মতের পক্ষেও তার ধারে-কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এবং এই কারণেই সাহাবিদের প্রশ্নে বড়পীর রহ. দ্রুত ধাবমান অশ্বারোহীর সঙ্গে বহু-পশ্চাতে বাতাসে ভেসে-বেড়ানো একটি অতি ক্ষুদ্র ধূলিরেণুর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেছেন।
কিন্তু সাহাবিরা এই অত্যুচ্চ মর্যাদার অধিকারী হলেন কী-কারণে? রাসুল সা.-এর নির্দেশ অনুযায়ী নামাজ-কালাম ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে সাহাবিদের রা. যে-ইসলামী জিন্দিগী, সেই জীবন পরবর্তীকালেও আল্লাহপাকের অনেক রহমতপ্রাপ্ত বান্দা নিষ্ঠার সঙ্গে যাপন করেছেন। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে ব্যবধান দুস্তর ও অনতিক্রম্য। শুধু একটি যে-ক্ষেত্রে পরবর্তীকালের যত বড় ইবাদতগুজার বান্দাই হোক, সাহাবিদের এক-সহস্রাংশ কামিয়াবীও কেউ অর্জন করতে পারেননি, সেটা জিহাদ; সেটা আল্লাহ ও তার রসুল সা. ও ইসলামের প্রশ্নে হৃদয়-নিংড়ানো শাহাদাতের তামান্না।
এমন একজন সাহাবির সন্ধান কেউ পাবেন না, যার শরীরে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন নেই। সাহাবিরা খুশিমনে আল্লাহর নবির সঙ্গে দাওয়াত খেতে গিয়েছেন, কিন্তু সহস্রগুণ বেশি আগ্রহ ও আকর্ষণ নিয়ে জিহাদের ময়দানেও গিয়েছেন। অথচ পরবর্তীকালে দিনে দিনে দাওয়াত খাওয়া সুন্নাতটি যত প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরা হলো, ইসলামের স্বার্থে সর্বস্ব কুরবানির তামান্না, জিহাদ ও শাহাদাত-বরণের বিষয়টি ততটাই প্রবলভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
দাওয়াত খাওয়াা, বিবাহ করা, উপহার আদান-প্রদান, পাগড়ি পরা, ঈদের মাঠে কোলাকুলি, ফুলকে ভালোবাসা নিঃসন্দেহে এগুলিও সুন্নাত। কিন্তু এই সকল সুন্নাত তখনই মহামূল্যবান হয়ে ওঠে, যখন আল্লাহর দ্বীন ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার নিরবচ্ছিন্ন সংকল্প ও সংগ্রামে মুসলমান, তার জীবন ও সম্পদ নিঃশেষে উৎসর্গ করে হলেও, মৃত্যুঞ্জয়ী মুজাহিদদের দলভুক্ত করে রাখে। অন্যথায় এগুলি কোনো সুন্নাতই নয়; এই সকল সহজ ও বাছা বাছা সুন্নাত এমনকি কাফের-মুশরিকরাও নিষ্ঠাসহকারে পালন করে।
বলাই বাহুল্য, এই ধরনের সংগ্রাম-নিরপেক্ষ নিরাপদ সুন্নাতের পাবন্দীর মধ্যে কৃতিত্বের কিছু নেই, আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভেরও কোনো সম্ভাবনা নেই। (চলবে)
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>