সুন্নাতি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (২)

আবু জাফর

বিশেষ দ্রষ্টব্য
  • (অধ্যাপক আবু জাফরকে নতুন করে পরিচিত করার প্রয়োজন নেই। তাঁর চিন্তা-চেতনা-উপলব্ধি যা লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে তার ফলে যুগ যুগ ধরে ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে তিনি জাগরূক থাকবেন। তাঁর বয়স ৮০-র ঊর্ধ্বে। মহান আল্লাহর কাছে আমরা তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।)

আল্লাহপাক কারো মুখাপেক্ষী নন, তাঁর ইচ্ছাই যথেষ্ট। তবু বলা যায়, এই সুরক্ষার ব্যবস্থা আল্লাহপাক করেছেন বাহ্যত দু’ভাবে।

প্রথমত, আল কুরআনের যে-শাব্দিক ও আক্ষরিক ভাষাগত রূপ, তাকে সকল রকম বিকৃতি ও প্রক্ষেপ থেকে নিরাপদ রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কুরআনুল কারিমের যে-ব্যবহারিক রূপ ও তাৎপর্য, তাকেও রসুল সা.-এর সুন্নাহর মাধ্যমে এমন দৃষ্টিগ্রাহ্য বাস্তব দৃশ্যরূপ দান করা হয়েছে, যা-নিয়ে কোনোরূপ সূক্ষ্ণতম সংশয়েরও কোনো অবকাশ না-থাকে। এবং রসুল সা.-এর জীবন ও জীবনাদর্শের মধ্য দিয়ে অঙ্কিত আল কুরআনের এই বাস্তব রূপরেখাটিও কুরআনুল কারিমের মতই রোজ কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহপাক হুবহু অক্ষত রাখবেন।

অতএব কুরআনের মতো রসুল সা.- এর সুন্নাহর অনুসরণও যে-কোনো মুসলমানের জন্য ফরজ ও অপরিহার্য। এবং বুঝতে ভুল না হয়, এই জন্য আল্লাহপাক এই কথা একাধিকবার ঘোষণাও করেছেন। অর্থাৎ যত যা-ই বলি, সুন্নাহকে পাশ কাটিয়ে ইসলামও হয় না, মুসলমানও হওয়া যায় না। আশা করি, এই বক্তব্যের সঙ্গে কোনো মুসলমান অন্তত দ্বিমত পোষণ করবেন না। অবশ্য এই সঙ্গে এই আশঙ্কা কিছুটা হলেও বর্তমান যে, সুন্নাতি-রসুলুল্লাহ বলতে সকল বিষয় সকলের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়, সম- অর্থবোধকও নয়।

স্বীকার-অস্বীকার যা-ই করি, এটা সত্য যে, সুন্নাহর গুরুত্ব ও অগ্রাধিকারের প্রশ্নে আমরা বহুলাংশে জটিল আত্মবিভক্তি ও অনৈক্যের শিকার। অর্থাৎ গুরুত্বের হেরফের ও অগ্রাধিকারের অগ্রপশ্চাৎ নিয়ে মুসলিম মিল্লাত আজ বহুধাবিভক্ত। অনেকের কাছে মেসওয়াক, কুলুখ-ব্যবহার, লেবাস, মেঝেতে বসে আহার করা, সুগন্ধি সুরমা, লাঠি-ব্যবহার, পাগড়ি-পরিধান ইত্যাদি বিষয় এত গুরুত্বপূর্ণ যে, এর যে-কোনো একটি পরিহার করলে শুধু অগণিত সওয়াব থেকেই মাহরুম হবে না, আখেরাতে জাহান্নামের ফয়সালাও হয়ে যেতে পারে।

সত্য যে, উল্লিখিত কোনো একটি বিষয়ও গৌণ নয়; কিন্তু কেউ-তো এই প্রশ্নও উত্থাপন করতে পারেন যে, মেসওয়াক যেমন সুন্নাত, ইসলামের তরক্কীর প্রশ্নে যুদ্ধের ময়দান থেকে পশ্চাদপসরণ না-করাও সুন্নাত। চোখে সুরমা লাগানো কি সুগন্ধী-ব্যবহার যেমন সুন্নাত, জিহাদের আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত হওয়াও সুন্নাত। মেঝেতে আহার করা যেমন সুন্নাত, জননী আয়েশা সিদ্দিকার রা. বর্ণনামতে রসুল সা. যে কোনোদিনই ভালো রুটি খাননি, নরম কোনো বিছানা বালিশ ব্যবহার করেননি, নিঃসন্দেহে এগুলোও সুন্নাত।

মাঝে মাঝে মধু খাওয়া যেমন সুন্নত, কাইলুলা অর্থাৎ আহারান্তে দৈপ্রহরিক সামান্য আরাম যেমন সুন্নাত, আল্লাহর নবি যে-সারা জীবন ভূষিসমেত যবের রুটি খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করেছেন, আট ফুট বাই বারো ফুট ঘরে আমৃত্যু জীবন নির্বাহ করেছেন, নিশ্চয়ই এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। পেঁয়াজ না-খাওয়া সুন্নাত, প্রতিবেশী ক্ষুধার্থ আছে কিনা সে খবর রাখাও সুন্নাত, অট্টালিকা নির্মাণ না-করাও সুন্নত।

এবং বলাই বাহুল্য দ্বিতীয় ধরণের সুন্নাতসমূহের গুরুত্ব এত বিশাল ও ব্যাপক এবং অপরিহারর্য যে, এর কোনো কোনটি ইসলামে রীতিমত ফরজ। এজন্যই পেশাব থেকে পবিত্র হওয়া জরুরি বটে, কিন্তু পেশাবের কথা-তো অনেক লঘু, এমনকি জানাবাত অবস্থায়ই হযরত হানযালা রা. ওহুদের ময়দানে ছুটে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন। অথচ কী গুরুতর দুঃখের কথা, আমরা কেবল আমাদের আপনাপন সুবিধানুযায়ী বেছে বেছে সহজ কিছু সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে রসুল সা.-এর প্রতি আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছি। সত্যই এর চেয়ে গুরুতর বিভ্রম আর কিছু হয় না।

(চলবে)

সুন্নাতি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (১)

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

কলামিস্ট এবং সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button