শয়তানকে কেউ বন্ধু মনে করে না। এমন কি চোর- ডাকাত-বদমাইশরাও স্বার্থের হানি হলে একে অপরকে গালি দিয়ে বলে, শয়তানটা আমাকে ঠকিয়েছে। মানুষ তার কাজে-কর্মে-আচরণে অজ্ঞাতসারেই শয়তানের ভাই-বন্ধু হয়ে যায়। আজকে আমরা শয়তানের এক ভাইয়ের পরিচয় জানার চেষ্টা করবো। আল্লাহপাক নিজেই শয়তানের ভাইয়ের পরিচয় প্রদান করেছেন এভাবে-
‘বাজে খরচ করো না। যারা বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি বড়ো অকৃতজ্ঞ’- সুরা বনী ইসরাঈল ২৬-২৭। ‘তোমার হাত গলার সাথে বেঁধে রেখো না, আবার একেবারে ছেড়েও দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে পড়বে’- সুরা বনী ইসরাঈল ২৯।
আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের বাজে খরচ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহর কোনো নেক বান্দা কখনই বাজে খরচ করতে পারে না। সাথে সাথে বলেছেন, যারা বাজে খরচ করে তারা তাঁর বান্দা নন, বরং শয়তানের সহচর ও ভাই। শেষে শয়তানের পরিচয় দিয়ে বলেছেন, সে তার রবের প্রতি বড়ো অকৃতজ্ঞ।
২৯ নং আয়াতে মধ্যম পন্থা অবলম্বনের তাগিদ দিয়ে বলেছেন, তোমরা কার্পণ্য করো না আবার বাহুল্য খরচ করে নিজেকে বিপদগ্রস্তও করো না। সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এই বলে যে, লাগামছাড়া খরচ করলে নিন্দিত ও অক্ষম (পরমুখাপেক্ষি) হয়ে পড়বে।
আল্লাহর রসুল সা. দুই প্রান্তিকতার মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বনের তাগিদ দিয়েছেন। অর্থাৎ নিজের, পরিবারের, আত্মীয়-পরিজন, সমাজ ও আল্লাহর পথে খরচ না করে যক্ষের ধনের মতো সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখাকে নিন্দা করেছেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘কৃপণ জান্নাতে যাবে না।’ মলিন বেশে ছেঁড়া কাপড়-চোপড় পরিহিত এক ব্যক্তিকে দেখে মুহাম্মদ সা. বলেন, ‘আল্লাহপাক তোমাকে যে নেয়ামত দিয়েছেন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাও।’ উসকু-খুসকু, মলিন চেহারা ও জীর্ণ পোশাক-পরিচ্ছদকে অনেক সময় ধার্মিকতার পরিচায়ক বলে মনে করা হয়। এর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
কার্পণ্যকে যেমন ঘৃণা করা হয়েছে, তেমনি বেহুদা খরচ ও অপচয়কে তীব্রভাবে নিন্দা জানানো হয়েছে। আল্লাহর রসুল সা. নিজে যেমন মিতব্যয়ী ছিলেন, সাথে সাথে সাহাবাদেরকেও মিতব্যয়ী হতে উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা খাও, পান করো, অপচয় করো না।’ আল্লাহর এই নির্দেশনা তিনি তাঁর নিজের জীবনে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেছেন। কোনো ধরনের অপচয়কে তিনি প্রশ্রয় দেননি। তিনি খাওয়া শেষে প্লেট পরিষ্কার করে ও আঙ্গুলগুলো চেটে খেতেন এবং কোনো খাদ্যকণা পড়ে গেলে তা উঠিয়ে খেতেন। তাঁর সাহাবিরাও রা. তাঁকে পুরোপুরি অনুসরণ করেছেন।
আল্লাহর রসুল সা. ও তাঁর সাহাবিরা রা. দানের ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত উদার। রসুল সা.এর আহবানে সাহাবিরা রা. সবকিছু নিয়ে হাজির হতেন। যেমন, আবু বকর রা. সবকিছু নিয়ে হাজির হন এবং বাড়িতে কী রেখে এসেছেন জানতে চাইলে বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-কে রেখে এসেছেন। ওমর রা. অর্ধেক নিয়ে হাজির হন। অথচ তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী।
খলিফা হওয়ার পর আবু বকর রা. রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে সামান্য পরিমাণ ভাতা গ্রহণ করতেন। তাঁর স্ত্রী তা থেকে অল্প অল্প করে বাঁচিয়ে একদিন একটু ভালো খাবার তৈরী করেন। জানার পর খলিফা তাঁর ভাতার পরিমাণ কমিয়ে দেন। হযরত উছমান রা. তৎকালে সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ধনাঢ্যতার কারণে তাঁকে গণি বলা হতো। অথচ তাঁর ঘরে বাতি জোরে জ্বলার কারণে তিনি তাঁর চাকরকে ভর্ৎসনা করেছেন।
শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সমাজে বিশেষ করে সরকারি পর্যায়ে মাত্রাহীন বিলাসিতা ও অপচয় এবং সীমাহীন দুর্নীতি প্রমাণ করে, আমরা বিশ্বাসবর্জিত একটি জাতিতে পরিণত হয়েছি। মনে হয় না, আমরা মুহাম্মদ সা.-এর উম্মত। অবশ্য ব্যতিক্রমও রয়েছে। অনেক রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে যাদের কার্যক্রমে আখিরাতে বিশ্বাসের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সমাজের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের আসনে তাঁরা নেই। রাষ্ট্রীয় অপচয়ও একটি দুর্নীতি।
আমাদের সমাজে অপচয়কে ঘৃণা করেন এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের মিব্যয়িতার কথা আমরা জানি। সকালে বঙ্গভবনে নিজ হাতে বাতি নেভানোর কথা পত্র- পত্রিকায় এসেছে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অকারণে বাতি জ্বালিয়ে রাখা, পানি ও গ্যাসের অপচয়, বাড়তি পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যখানায় অপচয় একটু চেষ্টা করে বন্ধ করতে পারি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মধ্যম পন্থা অবলম্বনের তৌফিক দান করুন।