রসুল সা.-এর মর্যাদা

‘আর তোমরা তার আনুগত্য করলে সৎ পথ পাবে’

বিশেষ দ্রষ্টব্য
  • ১৪.০৯.২০২২। প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রসুলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন। হে ঈমানদারগণ! নিজেদের আওয়াজ রসুলের আওয়াজের চেয়ে উঁচু করো না এবং উচ্চস্বরে নবির সাথে কথা বলো না, যেমন তোমরা নিজেরা পরস্পর বলে থাকো। এমন যেন না হয়, তোমাদের অজান্তেই তোমাদের সব কাজ-কর্ম ধ্বংস হয়ে যায়’- সুরা হুজুরাত ১-২।

এই সুরার ৪র্থ আয়াতের হুজুরাতকে নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। মাদানি সুরা। তবে পূর্ণ সুরা একত্রে নাজিল না হয়ে বিভিন্ন সময়ে অংশবিশেষ নাজিল হয়েছে। বিষয়বস্তুর সাদৃশ্যের কারণে এখানে একত্রিত করা হয়েছে। ৪র্থ আয়াত সম্পর্কে সিরাত গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়, হিজরি ৯ম সনে বনি তামিম গোত্রের এক প্রতিনিধি দল এসে রসুল সা.-এর পবিত্র স্ত্রীগণের হুজরা বা গৃহের বাইরে থেকে ডাকাডাকি করে।

এই সুরার বিষয়বস্তু হচ্ছে মুসলমানদের এমন আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও আচরণ শিক্ষাদান, যা তাদের ইমানদারসুলভ চরিত্র ও ভাবমূর্তির উপযুক্ত এবং মানানসই।

ব্যাখ্যা : মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজের ভিত্তি হবে সুরা হুজুরাতের প্রথম আয়াত। সকল কাজের শুরুতে মুসলিম ব্যক্তি, দল বা সমষ্টি প্রথমেই দেখবে আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর হুকুম। সর্বদা অনুগামী হবে এবং কখনোই অগ্রগামী হবে না। ইসলামকে আল্লাহ তায়ালা পূর্ণ করে দিয়েছেন এবং পূর্ণাঙ্গ দীন হিসেবে মেনে চলার জন্য আল্লাহর আনুগত্যের সাথে রসুল সা.-এর আনুগত্যকে অপরিহার্য করে দিয়েছেন। কুরআন সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়াত কিন্তু এই কুরআন থেকে কেবল মুত্তাকিরাই হেদায়াত লাভে সক্ষম হবে।

আল্লাহপাক এই কিতাবের সাথে রসুল প্রেরণ করেছেন কিতাবের ব্যাখ্যাকারী হিসেবে। আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, তিনি তাদের মাঝ থেকে একজন ব্যক্তিকে রসুল করে পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে আল্লাহর কিতাবের আয়াতসমূহ পড়ে শোনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করে এবং সে তাদের আল্লাহর কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়, যদিও এরা সবাই ইতোপূর্বে স্পষ্ট গোমরাহ ছিল’- সুরা আলে ইমরান ১৬৪।

রসুলুল্লাহ সা.-এর আনুগত্য প্রসঙ্গে কুরআনের কিছু আয়াত:

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর ও আনুগত্য করো রসুলের’- সুরা নেসা ৫৯।

‘যে রসুলের আনুগত্য করলো, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করলো’- সুরা নেসা ৮০।

‘আর রসুলের আনুগত্য করো যাতে তোমরা রহমত প্রাপ্ত হতে পারো’- সুরা নূর ৫৬।

রসুল সা.-এর নাফরমানদের সতর্ক করেছেন, ‘সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের সতর্ক হওয়া উচিৎ যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হতে পারে অথবা তাদের উপর এসে যেতে পারে মর্মন্তুদ শাস্তি’- সুরা নূর ৬৩।

‘বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন’- আলে ইমরান ৩১।

রসুল সা.-এর আনুগত্যকে আল্লাহ তায়ালা হেদায়াত ও তাঁর নাফরমানিকে গোমরাহী বলেছেন, ‘আর তোমরা তার আনুগত্য করলে সৎ পথ পাবে’- সুরা নূর ৫৪।

রসুল উম্মতের জন্য আদর্শ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’- সুরা আহজাব ২১।

কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে মৌলিক বিধান। রসুল সা.-এর আনুগত্যের মাধ্যমেই কেবল সৎ পথ প্রাপ্তি সম্ভব (সুরা নুর ৫৪)। আল্লাহ ও রসুল সা.-এর আনুগত্য শর্তহীনভাবে করতে হবে (শুনলাম ও মেনে নিলাম)। ইবাদতের ক্ষেত্রে রসুল সা. যা নিজে করেছেন, বলেছেন ও অনুমোদন দান করেছেন তার বাইরে আর কিছু নেই, যা আছে সেটি বিদয়াত এবং তা জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।

উম্মতের কাছে রসুল সা.-এর মর্যাদা এতো উচ্চে যে আমরা পরস্পর যেভাবে কথাবার্তা বলি নবির সাথে সেভাবে কথা বলা যায় না, অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে বলতে হয়। সামান্যতম বেয়াদবি ব্যক্তিকে আমল শূন্য করে দেয়। রসুলুল্লাহ সা.-এর অবর্তমানেও তাঁর একই মর্যাদা। তাঁর নাম উচ্চারণ হলে এবং তাঁর হাদিস আলোচনাকালে যদি অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায় তাহলে সেটি হবে ব্যক্তির জন্য বড়ো দুর্ভাগ্যজনক। হাদিস মানার ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে আপত্তি থাকতে পারে এবং সেটি হবে সহিহ ও জয়িফ হাদিস প্রশ্নে। কুরআন আমার জন্য যথেষ্ট, হাদিস প্রয়োজন নেই- এ কথা বলা রসুল সা.-কে অস্বীকার করার শামিল।

রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবদ্দশায় যখন কুরআন নাজিল হচ্ছিলো তখন সাহাবায়ে কেরাম কুরআন মানার সাথে সামনে থেকে রসুল সা.-কে মানছিলেন এবং সাহায়ে কেরাম রসুল সা.-এর বাণী মুখস্থ করার সাথে সাথে অপরের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। কুরআনের সাথে হাদিসের যাতে সামান্যতম মিশ্রণ না ঘটে সেজন্য হাদিস লিপিবদ্ধ করা থেকে সাহাবায়ে কেরাম বিরত ছিলেন।

কুরআন পরিপূর্ণ এবং লিপিবদ্ধ হওয়ার পর রসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের পরে সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তীকালে হাদিসবিশারদগণ হাদিস লিপিবদ্ধ করার প্রতি মনোযোগী হন। এরপরও জাল ও দুর্বল হাদিস থাকতে পারে এবং যদি থাকে তা ইসলামের কোনো মৌলিক বিষয়ে নেই। ফলে ইসলাম মানার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। কূটবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা সেসব নিয়ে উম্মাহর মধ্যে কেবল অনৈক্য সৃষ্টি করে ও দল-উপদল গড়ে তোলে।

সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধে উঠে রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি মুহাব্বত পোষণ ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও পরিপূর্ণ মুসলমান হওয়ার তৌফিক আল্লাহপাক আমাদের দান করুন।

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

কলামিস্ট এবং সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button