মাতাপিতার সন্তুষ্টির মাঝেই রয়েছে জান্নাত
জুমার খুতবা ১৭.০৯.২০২১
- মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য বিষয়ে ধারাবাহিক আলোচনার দ্বিতীয় দিন, শ্রুতিলিখন: প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য বিষয়ে ধারাবাহিক আলোচনার দ্বিতীয় দিনে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার প্রসঙ্গে সুরা বনি ইসরাইল ২৩ ও ২৪, সুরা নিসার ৩৬, সুরা ইব্রাহিমের ৪১, সুরা নুহের ২৮ নং আয়াতসমূহ এবং প্রাসঙ্গিক অনেকগুলি হাদিস উদ্ধৃত করেন। খুতবা মূলত নসিহত ও কল্যাণের পথে উদ্বুদ্ধকরণ। ব্যবহারিক জীবনে মানুষের আচার-আচরণ সুন্দর করা ও ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলী মানুষকে অবগত করা খতিব মহোদয়ের বক্তব্যে পাওয়া যায় এবং তাঁর ভাষাও প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। ৫০ মিনিটের তাঁর বক্তব্যের সারাংশ সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁর বক্তব্য ভিডিও করা হয় এবং সেটি ইউটিউবে পাওয়া যায়।
খতিব মহোদয় গতদিনের মতো আজও সুরা বনি ইসরাইলের ২৩ ও ২৪ নং আয়াত উদ্ধৃতির মাধ্যমে তাঁর আলোচনা শুরু করেন- ‘তোমার রব আদেশ করেছেন, তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো; তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদের সাথে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং কখনো তাদের ধমক দিয়ো না, তাদের সাথে সম্মানজনক ভদ্রজনোচিত কথা বলো। অনুকম্পায় তুমি তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো, তুমি বলো, হে আমার রব, তাদের ওপর দয়া করো, যেমনি করে শৈশবে তারা আমাকে লালন পালন করেছেন।’
এখানে প্রথমত বলা হয়েছে আল্লাহর ইবাদতের সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। অর্থাৎ কেবল আল্লাহরই হুকুম পালন করতে হবে। তাঁর হুকুমের সাথে সাংঘর্ষিক কারো হুকুম মানা যাবে না। এর পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আল্লাহপাকের নির্দেশ হলো মাতাপিতার সাথে সর্বোত্তম ব্যবহার করা। এই সর্বোত্তম ব্যবহার প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন মাতাপিতা উভয়ই বা কোনো একজন যদি বার্ধক্যে উপনীত হন তাহলে তাঁরা কষ্ট পান এমন কোনো আচরণ করা যাবে না, এমনকি তাঁদের উদ্দেশ্যে ‘উহ’ শব্দটিও উচ্চারণ করা যাবে না। সন্তান বড় কিছু হয়ে পড়ে এবং আয় উপার্জন করে এমতাবস্থায় মাতাপিতা অনেক সময় সন্তানকে ভয় করে চলে। না, এমনটি কখনোই নয়, সন্তান সবসময় অনুগত হয়ে চলবে এবং ধমকের সুরে বা উচ্চস্বরে বাবা-মার সাথে কথা বলবে না। সর্বদা সম্মান ও ভদ্রতা বজায় রেখে চলবে এবং সন্তান তাঁদের প্রতি বিনয়াবনত থাকবে। মাতাপিতার জন্য সর্বদা সন্তানের দোয়ার হাত প্রসারিত থাকবে এবং দোয়া করার ভাষাও মহান আল্লাহ শিখিয়ে দিয়েছেন; যে দোয়া ব্যর্থ হওয়ার নয়।
খতিব মহোদয় সুরা নেসার ৩৬ নং আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, আল্লাহপাক এখানেও তাঁর ইবাদতের পাশাপাশি মাতাপিতার প্রতি ভালো ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন। তাঁর বাণী, ‘তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো, কোনো কিছুকে তাঁর সাথে শরীক বানিয়েও না এবং পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো, যারা (তোমাদের) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, ইয়াতিম, মিসকিন, আত্মীয় প্রতিবেশী, কাছের প্রতিবেশী, পাশের লোক, পথচারী ও তোমার অধিকারভুক্ত (দাস-দাসী, তাদের সাথেও ভালো ব্যবহার করো), অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এমন মানুষকে পছন্দ করেন না, যে অহঙ্কারী ও দাম্ভিক।
এখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার সকল সৃষ্টি বিশেষ করে সকল মানুষই সদাচরণের হকদার। সদাচরণের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। তন্মধ্যে সদাচরণে যাঁদের হক সর্বাগ্যে পালনযোগ্য তাঁরা হলেন আপন পিতা-মাতা। এখানেও আল্লাহর ইবাদতের সাথে আর কাউকে শরীক না করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। শিরক হলো সবচেয়ে বড় জুলুম। তওবা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা শিরকের অপরাধ ক্ষমা করেন না। মাজারকেন্দ্রিক মানুষের যে জীবন যাপন খতিব মহোদয় তার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, কারো কিছু দেয়ার ক্ষমতা নেই, সকল ক্ষমতা কেবল আল্লাহর। আল্লাহর সাথে শিরক না করার পররপরই মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে প্রথমেই আল্লাহ নিয়ে এসেছেন পিতামাতার অধিকার আদায় অর্থাৎ তাদের সঙ্গে সর্বোত্তম ব্যবহার করার।
খতিব মহোদয় কয়েকজন নবির আল্লাহর কাছে দোয়া করার ভাষা তুলে ধরেন। হজরত ইব্রাহিম আ. ছিলেন মিল্লাতের পিতা এবং তাঁর বর্ণনা কুরআন মজিদে বিভিন্নভাবে এসেছে। আল্লাহর কাছে তাঁর দোয়া করার ভাষা খুবই সুন্দর এবং দোয়ার মাঝে প্রশস্ততা রয়েছে যা কুরআন এভাবে উল্লেখ করেছে, ‘হে আমাদের রব, যেদিন (চূড়ান্ত) হিসাব কিতাব হবে, সেদিন তুমি আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সকল ইমানদার মানুষদের ক্ষমা করে দাও’- সুরা ইব্রাহিম ৪১।
নিজ পিতাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ইব্রাহিম আ. আল্লাহর কাছে তাঁর পিতার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করেছিলেন। কিন্তু পরে যখন অনুভব করলেন তাঁর পিতা আল্লাহর দুশমন তখন তিনি দোয়া করা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
‘হে আমার রব, তুমি আমাকে, আমার পিতামাতাকে, তোমার ওপর ইমান এনে আমার ঘরে আশ্রয় নিয়েছে, এমন সব ইমানদার পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষমা করে দাও, জালেমদের জন্য চূড়ান্ত ধ্বংস ছাড়া তুমি কিছুই বৃদ্ধি করো না’- সুরা নুহ ২৮।
হজরত নুহ আ. নবি হিসেবে সুদীর্ঘকাল মানুষকে দাওয়াত দান করেছেন। কিন্তু স্বল্পসংখ্যক ছাড়া কেউ দাওয়াতে সাড়া না দেয়া এবং নবির বিরোধীতার কারণে আল্লাহপাক প্লাবন দিয়ে তাঁর কওমকে ধ্বংস করে দেন। তাঁর নৌকার স্বল্পসংখ্যক আরোহী থেকে মানবজাতির আবার সূচনা। হজরত নুহ আ. দোয়ার মাঝে তাঁর ও তাঁর পিতামাতার সাথে সকল মোমিনের জন্য দোয়া করেছেন। সেইসাথে যারা জালেম ও আল্লাহর দুশমন তাদের ধ্বংসও কামনা করেছেন।
খতিব মহোদয় উল্লেখ করেন যে, এই তিনটি দোয়ায় পিতামার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব দোয়ার মাঝে রয়েছে প্রশস্ততা। আমাদের সমাজে অনেকে বলেন, আমার ছেলের জন্য খাস করে দোয়া করবেন। কিন্তু ইমাম সাহেব দোয়া করার সময় অনেকের নাম উচ্চারণ কারার সাথে সকল মুসলিমের জন্য দোয়া করেন এবং তাদের সাথে দোয়াপ্রার্থীর নামও উল্লেখ থাকে কিন্তু এতে দোয়াপ্রার্থীর অনেক সময় অতৃপ্তি কাজ করে। আসলে দোয়ার এটিই নিয়ম। দোয়ায় নিজের, পিতামাতার এবং সকল মোমিনকে শামিল করে নেয়াটাই উত্তম যেটি আমরা কুরআন থেকে পাই।
মাতাপিতা যদি মুশরিকও হয় তবুও তাদের সঙ্গে সদাচরণ করতে হবে। মাগফেরাতের দোয়া নয়, কিন্তু তাদের প্রয়োজন পূরণ, তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা, সম্মান ও মর্যাদার সাথে তাদের খেদমত করতে সন্তান বাধ্য। এ প্রসঙ্গে উম্মে সালামা রা.-এর ঘটনা খতিব মহোদয় উল্লেখ করেন। উম্মে সালামার মা মেয়ের সাথে সাক্ষাত করতে আসলে (তখন তাঁর মা ছিলেন মুশরিক) তিনি রসুলুল্লাহ সা.-কে জিজ্ঞেস করেন, তিনি তাঁর মার সাথে কেমন আচরণ করবেন? রসুলুল্লাহ সা. বলেন, মার সাথে সন্তান সর্বদা সর্বোত্তম আচরণই করবে।
ওয়ায়েস আল করণি রসুলুল্লাহ সা.-এর ওপর ইমান আনলেও সাক্ষাত করার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। তাঁর দাঁত ভেঙ্গে ফেলার যেসব কাহিনী বর্ণনা করা হয় আসলে এর কোনো ভিত্তি নেই। বৃদ্ধা মায়ের খেদমতের জন্য কোনো বিকল্প না থাকায় তিনি রসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে সাক্ষাত করতে পারেননি। আল্লাহর রসুল সা. তাঁর সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং সাহাবিদের বলেছিলেন, ওয়ায়েস আল করণি নামে কেউ মদিনায় আসলে তোমরা তাঁর দোয়া নেবে। রসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকাল এবং আবু বকর রা.-এর সময়কাল অতিবাহিত হওয়ার পর ওমর রা.-এর সময়ে ওয়ায়েস আল করণি মদিনায় আগমন করেন। এসময়ে ওমর রা. তাঁকে যথেষ্ট সমাদর করেন ও তাঁর কাছে দোয়া চান।
ইয়েমেন থেকে এক যুবক মাকে সাথে করে হজে এসেছেন। মাকে পিঠে করে তাওয়াফ করার সময় যুবক আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-কে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, আমি কি আমার মায়ের ঋণ পরিশোধ করতে পারছি? জবাবে ইবনে ওমর রা. বলেন, কোনো কিছুর বিনিময় দিয়ে তুমি তোমার মায়ের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। সন্তানের উচিত, সর্বদা বাবা-মায়ের খেদমত করে যাওয়া ও তাদের জন্য দোয়া করা।
যুদ্ধের ঘোষণা হলে জনৈক সাহাবি রসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে হাজির হলে তিনি তাঁর গৃহের খোঁজ-খবর নেন। সাহাবি রা. বলেন যে, ঘরে তাঁর বৃদ্ধা মা রয়েছেন এবং তিনি ছাড়া তাঁর খেদমতের কোনো লোক নেই। আল্লাহর রসুল সা. তাকে যুদ্ধে শরীক হওয়া থেকে অব্যাহতি দিয়ে মায়ের খেদমতের জন্য আদেশ দেন। এই হলো সন্তানের কাছে রসুল সা. প্রদত্ত মায়ের মর্যাদা। মুসলিম সমাজে বর্তমানে বা-মার প্রতি সন্তানের উদাসীনতায় খতিব মহোদয় গভীর দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শুনি এমন সন্তানও নাকি আছে, ছেলে বড় কর্মকর্তা হয়ে বাবার পরিচয় দিতে লজ্জা অনুভব করে। বাবা বাড়ি থেকে নিজের উৎপাদিত লাউ-কুমড়া নিয়ে ছেলের বাড়ি বা অফিসে হাজির হলে ছেলে বলে, বাড়ি থেকে আমাদের সার্ভেন্ট এসেছে।
খতিব মহোদয় আজকের জুমায় আলোচিত তিনটি দোয়া (বনি ইসরাইলের ২৪ নং আয়াত, সুরা ইব্রাহিমের ৪১ ও সুরা নুহের ২৮ নং আয়াত মুখস্থ করার জন্য তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন, আপনারা আমাকে যে সম্মানি দেন তা পুরোটাই মার হাতে দেই এবং তা আবার আমিই খরচ করি। তিনি বলেন, আপনারাও বাবা-মার হাতে কিছু টাকা দিন, সম্ভব হলে একদিন প্লেনে চড়িয়ে বাড়ি থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, মাঝে-মধ্যে চমকে দেয়ার মতো কোনো গিফ্ট প্রদান করুন এবং দূরে অবস্থান করলে নিয়মিত মোবাইলে কথা বলুন ও খোঁজ-খবর নিন। তিনি আরো বলেন, সন্তানের জান্নাতে যাওয়া একান্তভাবে নির্ভর করে বাবা-মার সন্তুষ্টির ওপর। বাবা-মায়ের খেদমত প্রসঙ্গে হাদিসে অনেক বর্ণনা রয়েছে। তাঁদের জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে সন্তানের জন্য আরো কী কী করণীয় তা তিনি পরবর্তী জুমায় আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করে আজকের খুতবার সমাপ্তি টানেন। সংক্ষেপিত।