প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো পুণ্যের কাজ পছন্দ করা। নেক কাজের প্রচেষ্টা করা। পাপাচার ও অশ্লীলতাকে ঘৃণা করা। তা ছাড়া ভালো কাজের সুযোগ ও আগ্রহ থাকা মুমিনের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের ভালো ও পুণ্যের কাজে প্রতিযোগিতার নির্দেশ দিয়ে বলেনঃ وَفِي ذَٰلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ অর্থাৎ – ‘এ বিষয়ে প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক।’ (সুরা : মুতাফফিফিন, আয়াত : ২৬)
তবে নেক আমল ও পূণ্য কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে হলে মুমিনের কয়েকটি কাজ ধারাবাহিক করতে হবে। নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো—
১. আল্লাহর প্রতি বান্দার মুখাপেক্ষিতাঃ
আল্লাহর ওপর একজন মুমিন বান্দার ঈমান আনার অর্থ হলো, এ কথার ওপর বিশ্বাস করা যে আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর অমুখাপেক্ষিতার কথা তুলে ধরে বলেনঃ يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ অর্থাৎ – ‘হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর কাছে মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ১৫)
তাই মুমিনের জাগতিক সব আয়োজন ও প্রয়োজনে আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়ার বিকল্প নেই। এক হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! তোমরা সবাই ছিলে দিশাহারা, তবে আমি যাকে সুপথ দেখিয়েছি সে ব্যতীত। তোমরা আমার কাছে হিদায়াত প্রার্থনা করো, আমি তোমাদের হিদায়াত দান করব।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৪৬৬)
২.আল্লাহর অনুগ্রহের উপলব্ধিঃ
ভালো ও পুণ্যের কাজে তাওফিক প্রাপ্ত হওয়ার আরেকটি করণীয় হচ্ছে, সর্বদা আল্লাহর অনুগ্রহ স্বীকার করা এবং অন্তরে এই উপলব্ধি নিয়ে আসা যে ভালো ও পুণ্যের কাজ করার তাওফিক একমাত্র আল্লাহ তাআলাই দান করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ يَمُنُّونَ عَلَيْكَ أَنْ أَسْلَمُوا ۖ قُلْ لَا تَمُنُّوا عَلَيَّ إِسْلَامَكُمْ ۖ بَلِ اللَّهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ أَنْ هَدَاكُمْ لِلْإِيمَانِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ অর্থাৎ – ‘তারা মুসলমান হয়ে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ মনে কোরো না। বরং আল্লাহ ঈমানের পথে পরিচালিত করে তোমাদের ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাকো।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ مَا زَكَىٰ مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ أَبَدًا وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يُزَكِّي مَنْ يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ অর্থাৎ – ‘যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া তোমাদের প্রতি না থাকত, তবে তোমাদের কেউ কখনো পরিশুদ্ধ হতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পরিশুদ্ধ করেন। আল্লাহ সব কিছু শোনেন, জানেন।’ (সুরা : আন-নুর, আয়াত : ২১)
৩. অন্তরের পরিশুদ্ধিঃ
মানবদেহের চালিকাশক্তি হলো অন্তর। তাকে যেদিকে পরিচালিত করে, তা সেদিকে পরিচালিত হয়। তাই আত্মা পরিশুদ্ধ না হলে মানুষ ভালো ও পুণ্যের কাজ করতে পারে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেনঃ قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا ‘ وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا অর্থাৎ – ‘সে-ই সফল, যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে এবং যে তার আত্মাকে কলুষিত করেছে, সে ক্ষতিগস্ত।’ (সুরা : আশ-শামস, আয়াত : (৯-১০)
আর অন্তর পরিশুদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ أَلاَ وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ. أَلاَ وَهِيَ الْقَلْبُ ”. অর্থাৎ – ‘সাবধান! নিশ্চয়ই মানবদেহে একখণ্ড গোশতের টুকরা আছে, যখন তা সুস্থ হয়ে যায়, গোটা শরীরটাই সুস্থ হয়ে যায় এবং যখন তা অসুস্থ হয়ে যায়, গোটা শরীরই অসুস্থ হয়ে যায়। জেনে রেখো! এটাই হচ্ছে কলব।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪১৭৮)
৪. কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনঃ
সুখে-দুঃখে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন মুমিনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। অত্যন্ত উঁচু ও মহৎ এই গুণ সবাই অর্জন করতে পারে না। তাই মহান আল্লাহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীর জন্য তাঁর অনুগ্রহ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছেঃ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ অর্থাৎ – ‘তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের (আমার নিয়ামত) আরো বাড়িয়ে দেব আর অকৃতজ্ঞ হলে (জেনে রেখো) আমার শাস্তি কঠোরতম।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৭)
আর ভালো কাজের তাওফিকপ্রাপ্ত হওয়া, এটা মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় অনুগ্রহ।
৫. পূণ্যবানদের মজলিসঃ
ভালো ও পুণ্যের কাজে তাওফিকপ্রাপ্ত হওয়ার কার্যকরী একটি আমল হলো, যেসব মজলিস বা বৈঠকে আল্লাহর স্মরণ হয়, সেসব মজলিসে বেশি উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করা। কারণ এর দ্বারা অন্তর যেমন ভালো ও পুণ্যের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়, তেমনি পাপাচার ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বাঁচা যায়। হাদীসে এসেছেঃ عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، رضى الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” إِذَا مَرَرْتُمْ بِرِيَاضِ الْجَنَّةِ فَارْتَعُوا ” . قَالَ وَمَا رِيَاضُ الْجَنَّةِ قَالَ ” حِلَقُ الذِّكْرِ ” অর্থাৎ – আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা যখন জান্নাতের বাগানগুলোর পাশ দিয়ে যাবে সে সময় সেখান থেকে পাকা ফল তুলে নেবে। লোকজন প্রশ্ন করল, জান্নাতের বাগানগুলো কী? তিনি বলেন, জিকিরের মজলিস। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫১০)
৬. তাওবার অভ্যাস করাঃ
মুমিনরা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পাপ করে থাকে। তবে পাপ করার পর তারাই সফল, যারা আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণ বা তাওবা করে। তা ছাড়া গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার বড় একটি উপকার হচ্ছে বান্দা সৎ ও ভালো কাজ করার তাওফিকপ্রাপ্ত হয়। ইরশাদ হয়েছেঃإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ অর্থাৎ – ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২২)। হাদিস শরিফে এসেছেঃ كُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ ” অর্থাৎ – ‘সব আদম সন্তানই গুনাহগার, গুনাহগারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তাওবাকারীরা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৯৯)
৭. সৎসঙ্গ গ্রহণ করাঃ
সৎসঙ্গ মানুষকে সুপথে পরিচালিত করে আর অসৎসঙ্গ অন্যায় পথে চলার সহায়তা করে। তাইতো আল্লাহর রাসুল (সা.) অসৎসঙ্গ ত্যাগ করে সৎসঙ্গ গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেনঃ الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ، فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ حسن অর্থাৎ – ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৩৩)
আর সৎ বন্ধুর বৈশিষ্ট্য কেমন হবে তার বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
অর্থাৎ – ‘আর ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। তাদের ওপর আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী সুকৌশলী। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৭১)
আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশকারীদের প্রতি হুশিয়ারি দিয়ে হাদীসে কুদছিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ -رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ-: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: «كَانَ رَجُلَانِ فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ مُتَوَاخِيَيْنِ، فَكَانَ أَحَدُهُمَا يُذْنِبُ وَالْآخَرُ مُجْتَهِدٌ فِي الْعِبَادَةِ، فَكَانَ لَا يَزَالُ الْمُجْتَهِدُ يَرَى الْآخَرَ عَلَى الذَّنْبِ فَيَقُولُ أَقْصِرْ فَوَجَدَهُ يَوْمًا عَلَى ذَنْبٍ، فَقَالَ لَهُ: أَقْصِرْ. فَقَالَ: خَلِّنِي وَرَبِّي أَبُعِثْتَ عَلَيَّ رَقِيبًا؟ فَقَالَ: وَاللَّهِ لَا يَغْفِرُ اللَّهُ لَكَ أَوْ لَا يُدْخِلُكَ اللَّهُ الْجَنَّةَ، فَقَبَضَ أَرْوَاحَهُمَا فَاجْتَمَعَا، عِنْدَ رَبِّ الْعَالَمِينَ، فَقَالَ لِهَذَا الْمُجْتَهِدِ: أَكُنْتَ بِي عَالِمًا؟ أَوْ كُنْتَ عَلَى مَا فِي يَدِي قَادِرًا، وَقَالَ لِلْمُذْنِبِ: اذْهَبْ فَادْخُلْ الْجَنَّةَ بِرَحْمَتِي، وَقَالَ لِلْآخَرِ: اذْهَبُوا بِهِ إِلَى النَّار؟
অর্থাৎ – আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: “বনি ইসরাইলে দুই বন্ধু ছিল। তাদের একজন পাপ করত, দ্বিতীয়জন খুব ইবাদত গুজার ছিল। ইবাদত গুজার তার বন্ধুকে সর্বদা পাপে লিপ্ত দেখত, তাই সে বলত বিরত হও, একদিন সে তাকে কোন পাপে লিপ্ত দেখে বলে: বিরত হও। সে বলল: আমাকে ও আমার রবকে থাকতে দাও, তোমাকে কি আমার ওপর পর্যবেক্ষক করে পাঠানো হয়েছে? ফলে সে বলল: আল্লাহর কসম আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন না, অথবা তোমাকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। অতঃপর তাদের উভয়ের রূহ কবজ করা হল এবং তারা উভয়ে আল্লাহর নিকটে একত্র হল। তিনি ইবাদত গুজারকে বলেন: তুমি কি আমার ব্যাপারে অবগত ছিলে? অথবা আমার হাতে যা রয়েছে তার ওপর তুমি ক্ষমতাবান ছিলে? আর পাপীকে তিনি বলেন: যাও আমার রহমতে তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর। আর অপর ব্যক্তির জন্য বলেন: তাকে নিয়ে জাহান্নামে যাও। (আবূ দাউদ)
এর অর্থ এই নয় যে, কেউ অন্যায় ও গুনাহ করবে আর অন্য কেউ তার প্রতিবাদ করবে না। এ ব্যাপারে প্রতিবাদ হচ্ছে তিন প্রকারের, হাতে, মুখে বা অন্তরের ঘৃণা। তাকে হাত দিয়ে বাধা, মুখ দিয়ে নিষেধ আর সক্ষম না হলেও অন্তরে তার কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করাই হচ্ছে প্রতিবাদে ভাষা। কিন্তু তার বাইরে প্রতিবাদের সীমা ছড়িয়ে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না, বলাই অগ্রহণযোগ্য কাজ। যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে।
মহান আল্লাহ আমাদের ভালো ও পুণ্যের কাজে যথাযথ প্রচেষ্টা করার তাওফিক দান করুন।