বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
মসজিদ উত তাকওয়া, ধানমন্ডিতে আজ জুমায় খতিব মুফতি সাইফুল ইসলাম আল্লাহর হামদ ও রসুলল্লাহ (সা)-এর ওপর দরুদ ও সালাম পেশের পর হিজরি সনের উৎপত্তি, মুহাররম মাসের ফজিলত ও এই মাসে ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি তাঁর আলোচনায় কুরআন-হাদিসের প্রচুর উদ্ধৃতি পেশ করেন। তিনি বলেন, হিজরি সনের সাথে আমাদের অনেক ইবাদত পালনের সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে রোজা ও হজ পালনসহ আমাদের মাঝে অনেকেই সোম ও বৃহস্পতিবার এবং আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ (আইয়ামে বিজ) রোজা পালন করেন। খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষই হিজরি সন, মাস ও তারিখ সম্পর্কে অবহিত। আরবির পাশাপাশি বাংলাও জানে না। দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে আমরা ইংরেজিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই ইসায়ী সন অনুসরণ করা হয়। আজ ০৩ মুহাররম ১৪৪৩ হিজরি।
সৃষ্টির সূচনা থেকে আল্লাহপাক দিনগণনার জন্য ১২টি মাস নির্ধারণ করেছেন এবং চারটি মাসকে পবিত্র (হারাম) বলে ঘোষণা করেছেন। হারাম মাসসমূহ হলো জিলকদ, জিলহজ, মুহাররম ও রজব। মুহাম্মদ সা.-এর পূর্বেও আরবের মানুষ এই চারটি মাসকে হারাম হিসেবে মানতো। এসময়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। মুলত হজ ও ওমরা নির্বিঘ্নে করার লক্ষ্যেই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এই বিধান। সেই সময়ে আরবের মানুষ হস্তিবাহিনীর ধ্বংস থেকে বা হাজরে আসওয়াদ পুনস্থাপন থেকে মোটামুটি বছর গণনা করতো। বলা হত, হস্তিবাহিনীর ধ্বংস এত বছর হলো। কিন্তু একটি সার্বজনীন সন না থাকায় সময় গণনা ও সরকারি কাজে নানাবিধ সমস্যা উল্লেখ করে হজরত আবু মুসা আল আশয়ারী রা. খলিফা হজরত ওমর রা.-এর নিকট চিঠি লেখেন। হজরত ওমর রা. তাঁর চিঠির বক্তব্যের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করেন। নানাদিক আলোচনা-পর্যালোচনা করে হজরত আলী রা. রসুলুল্লাহ সা.-এর হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরি সন গণনার প্রস্তাব করেন। হিজরত ছিল ইসলামের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। হিজরতের পূর্বে ইসলাম ছিল বাতিলের অধীন ব্যক্তিগত কিছু আমল-আখলাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ কিন্তু হিজরতের পরে ইসলামের বিজয় যুগের সূচনা হয়।
হিজরতকে সন গণনার সূচনা বিবেচনা করার পর প্রশ্ন দেখা দেখা দেয় কোন্ মাসটিকে প্রথম বিবেচনা করা হবে। কুরআনে হারাম ঘোষিত চারটি মাসের কোনো একটিকে প্রথম মাস হিসেবে গ্রহণের ব্যাপারে মতৈক্য হলেও কোন্ মাসটি নেয়া হবে সেটি নানা দিক আলোচনা করে মুহাররম মাসকেই বিবেচনা করা হয়। রমজানে রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে রসুলুল্লাহ সা. আশুরার (১০ মুহাররম) দিন রোজা রাখতেন। হিজরতের পরে তিনি লক্ষ করেন, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানায়, এইদিনে ফেরাউনের জুলুম-নির্যাতন থেকে রক্ষাকল্পে আল্লাহপাক নিরাপদে তাদের নবি মুসা আ. ও তাঁর সাথীদের সমুদ্র পার করে দেন এবং ফেরাউনকে সদলবলে ডুবিয়ে মারেন। নাজাত দিবস হিসেবে ইহুদিরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আশুরার দিন রোজা রাখে। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, মুসা আ. আমার ভাই, তাঁর সাথে আমার সম্পর্কটাই বেশি। আমিও আশুরার দিন রোজা রাখবো কিন্তু তাদের থেকে পার্থক্য করার জন্য তিনি তাঁর উম্মতকে আশুরার আগে বা পরের দিন মিলায়ে রাখার কথা বলেন। আশুরার রোজা বান্দার এক বছরের ছগিরা গুনাহের পরিসমাপ্তি ঘটায়।
কুরআন মজিদে নবি মুসা আ. ও সর্বকালের সেরা স্বৈরশাসক ফেরাউন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। ফেরাউন তার নাগরিকদের ওপর (বনি ইসরাইল) সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চালাতো। তার অত্যাচারের সাথে আর কাউকে তুলনা করা যায় না। বনি ইসরাইলের পুত্র সন্তানদের জন্মের পরই হত্যা করা হত এবং নারীদেরকে দাসী হিসেবে রেখে দিত। এমনি পরিস্থিতিতে আল্লাহপাক মুসা আ.-কে দুনিয়াতে পাঠান এবং ফেরাউনের ঘরেই তাঁর লালন-পালনের ব্যবস্থা করেন। ফেরাউনের সেই অত্যাচারের কাহিনী আল্লাহপাক কুরআনে এভাবে উল্লেখ করেছেন,
‘(স্মরণ করো) যখন আমি তোমাদের ফেরাউনের লোকদের (গোলামী) থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম, তারা নিকৃষ্ট ধরনের শাস্তি দ্বারা তোমাদের যন্ত্রণা দিত, তারা তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করতো এবং মেয়েদের জীবিত রেখে দিত। তোমাদের মালিকের পক্ষ থেকে এতে তোমাদের জন্য বড় একটি পরীক্ষা ছিল’- সুরা বাকারা ৪৯।
ফেরাউন ভালো করেই জানতো মুসা আ. আল্লাহর নবি। সে অনেক নিদর্শন সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু তার নসিবে ইমান নেই। সে বড়ত্বের অহমিকায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী কাউকে সহ্য করতে পারতো না। ফেরাউনের অত্যাচারে টিকতে না পেরে মুসা আ. ও বনি ইসরাইলরা মিশর থেকে পালিয়ে যেতে চাইলে ফেরাউন ও তার দলবল মুসা আ. ও তাঁর সাথীদের ধাওয়া করে। সমুদ্রের ধারে পৌঁছে আল্লাহপাকের নির্দেশে মুসা আ. তাঁর লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করলে বারোটি গোত্রের জন্য বারোটি রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। মুসা আ. ও বনি ইসরাইলরা সেই রাস্তা দিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেন। ফেরাউন ও তার দলবল সেই রাস্তায় নেমে পড়লে তাদের সলিল সমাধি হয়। মৃত্যুর মুহূর্তে ফেরাউন চিৎকার দিয়ে বলে উঠে আমি ইমান আনলাম মুসা ও হারুনের রবের প্রতি। কিন্তু ইমান আনার একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেটি অতিক্রম করলে কোনো লাভ হয় না। ফেরাউনেরও হয়নি। সেই ঘটনা আল্লাহপাক কুরআন মজিদে উল্লেখ করেছেন এভাবে,
‘(স্মরণ করো) যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করে দিয়েছিলাম, অতপর আমি তোমাদের (সমূহ মৃত্যুর হাত থেকে) বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি ফেরাউন ও তার দলবলকে (সমুদ্রে) ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, আর তা তো তোমরা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছিলে’- সুরা বাকারা ৫০।
ফেরাউনের সম্মুখে মুসা আ. দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু মুজেজাও প্রদর্শন করেন। কিন্তু ফেরাউন কোনো অবস্থাতেই ইমান আনতে প্রস্তুত ছিল না এবং মুসা আ.-এর দাওয়াতে যাতে কেউ সাড়া না দেয় সেজন্য যাদু হিসেবে প্রচারণা চালায়। মুসা আ.-এর ওপর ইমান আনার কারণে সে যাদুকরদের হত্যা করে এবং তার স্ত্রীকেও সীমাহীন অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করে। আল্লাহপাক জালেমকে সহ্য করেন না। জালেমের জন্য জাহান্নাম তো রয়েছেই, তবে সীমালঙ্ঘনের কারণে দুনিয়াতেও আল্লাহপাক অনেক সময় পাকড়াও করেন। মানুষের জন্য আসল বদলা গ্রহণের জায়গা আখেরাত। জুলুম থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে শিক্ষা গ্রহণের জন্য নিদর্শনস্বরূপ আল্লাহপাক কিছু ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। ফেরাউনের ঘটনা তন্মধ্যে অন্যতম। আল্লাহর বাণী,
‘আজ আমি অবশ্যই তোমাকে- তোমার দেহকে বাঁচিয়ে রাখবো, যাতে করে তুমি- (তোমার দেহ) পরবর্তী (প্রজন্মের লোকদের) জন্য একটা নিদর্শন হয়ে থাকতে পারো; অবশ্য অধিকাংশ মানুষই আমার নিদর্শনসমূহ থেকে উদাসীন’- সুরা ইউনুস ৯২।
কী দুর্ভাগ্য! পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা গ্রহণ করে জুলুম থেকে নিজেদের বিরত রাখার পরিবর্তে সেই অভিশপ্ত ফেরাউনকেই নিজেদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ইমানদারদের প্রতি সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। মিশরে ফেরাউনের লাশকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করে নতুন মিউজিয়ামে স্থানান্তর তারই উদাহরণ।
আশুরায় একদিকে ইমানদারদের জন্য মুক্তির ফায়সালা হয়েছিল অন্যদিকে জালেমের জন্য ছিল চরম জিল্লতির ফায়সালা। আমাদের বুঝতে হবে, ফেরাউনের চেয়ে সীমালঙ্ঘনকারী জালেম ও আল্লাহদ্রোহী, যে নিজে রব (খোদা) দাবী করেছিল সে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা পায়নি। যারা পৃথিবীর বুকে জুলুম করে এবং ইমানদারদের প্রতি নানাভাবে জুলুম-পীড়ন চালায় ফেরাউনের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সবধরনের জুলুম থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত। জুলুম ভয়ংকর অপরাধ। এর পরিণতি জাহান্নাম। পক্ষান্তরে ইমানদারদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কাফেরদের জুলুম-নির্যাতনের পূর্ণ প্রতিফল আখেরাতে আল্লাহপাক তাদের দান করবেন এবং সবধরনের জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে ইমানের ওপর টিকে থাকতে পারলে শেষ হাসিটা তারাই হাসবে।
আশুরা নানা ঘটনার নীরব সাক্ষী। আশুরা (১০ মুহাররম) আমাদের কাছে যে কারণে আরো গুরুত্ব বহন করে সেটি হলো কারবালা প্রান্তরে আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রা.-এর সপরিবারে শাহাদতের ঘটনা। আশুরার শিক্ষা এবং সেদিনের ঘটনায় আমাদের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় নিয়ে খতিব মহোদয় পরবর্তী জুমায় আলোচনার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তিনি আল্লাহর কাছে সবধরনের জুলুম থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক কামনা করেন।
মসজিদ উত তাকওয়ায় ঠিক সাড়ে বারোটায় খুতবা শুরু হয় এবং খুতবা শেষে আজান ও ছানি খুতবা হয়। যেহেতু মাঝে চার রাকাত সুন্নাত পড়ার সময় দেয়া হয় না সেহেতু বিপুল পরিমাণ মুসল্লি খুতবার পূর্বেই মসজিদে হাজির হয়ে যান। আমি নিজে ১২-০৫ বাসা থেকে বের হয়ে দোতলায় একেবারে শেষে স্থান পাই (নিচতলায় মহিলাদের ব্যবস্থা)। নামাজ শেষে আলাদা কোনো মোনাজাত না হওয়ায় খতিব মহোদয় ছানি খুতবায় যারা দোয়া চান তাদের এবং দেশ ও মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করেন। মুসল্লিরা তাঁর দোয়ার জবাবে আমিন আমিন বলতে থাকেন। ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদাৎ বরণ করায় তিনি তাঁদের শাহাদাৎ কবুলের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।