মুসলিমবিশ্বের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের একটি দিক হলো, দেশে দেশে এমন কিছু দল ও সংগঠনের উদ্ভব হয়েছে, যারা নিজেদের ‘ইসলামপন্থী’ হিসেবে পরিচয় দেয় এবং বেশির ভাগ মুসলিম দেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেয়। কখনো তা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে অথবা এসব শাসনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর আচরণের মাধ্যমে। বিগত কয়েক দশকে আরব ও ইসলামী বিশ্বে এমন কিছু সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা নিজেদের নানা নামে পরিচয় দিলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় এক। তাদের কাছে জিহাদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হলো মুসলিম দেশের সেসব শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা, যারা ইসলামী বিধান প্রয়োগ করে না। অথচ আল্লাহ সব কিছুতে তাঁর বিধান মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে…’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হত্যাকৃত ব্যক্তির ব্যাপারে তোমাদের ওপর কিসাস ফরজ করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৭৮)
তাদের মতে, রোজা রাখার মতো ‘কিসাস’ বাস্তবায়ন করাও আবশ্যক। উভয়টি বান্দার জন্য আল্লাহকর্তৃক নির্ধারিত ফরজ। সুতরাং শাসক হিসেবে যারা এসব বিধান বাস্তবায়ন করছে না, তারা পাপী। তারা মনে করে, এসব শাসককে উপদেশ দেওয়া, সুপথ প্রদর্শন এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করা অর্থহীন। শক্তি ও চরমপন্থা প্রদর্শনই একমাত্র সমাধান। তারা বলে, আমরা আলোচনা করলে করতে পারি; কিন্তু তরবারি ও কলম, দাঁত ও জিহ্বা কখনো সমান নয়।
চরমপন্থীদের মৌলিক সংকট
এসব চরমপন্থীর প্রধান সংকট হলো, তাদের সংগঠন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির চিন্তাপ্রসূত দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যে ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, বোধ, দলিল ও যুক্তি আছে—যার ওপর তার অনুসারীরা নির্ভর করে। তারা নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য দলিল হিসেবে পূর্বসূরিদের আলেমদের কিছু একক মতামত উপস্থিত করে। অথবা এমন মতামত উপস্থিত করা হয়, যা থেকে তিনি পরবর্তী সময়ে ফিরে এসেছেন।
সত্য হলো, তারা বেশির ভাগ সময় মীমাংসিত বিষয় পরিহার করে অমীমাংসিত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সামগ্রিক বক্তব্য ছেড়ে খণ্ডিত বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে। শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য পরিহার করে বাহ্যিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। তারা উপেক্ষা করে সেসব বাহ্য বিষয়, প্রমাণাদি ও যুক্তি, যা তাদের বক্তব্যের বিপরীত। তারা আয়াত ও হাদিসের পেক্ষাপট উপেক্ষা করে অপপ্রয়োগ করে। তার পরও একদল আবেগী যুবক তাদের কথায় প্রভাবিত হয়, যারা মূলত প্রান্তিকতা পছন্দ করে। তারা গভীরভাবে ভেবে দেখে না। তারা কোরআন তিলাওয়াত করে; কিন্তু কোরআন তাদের কণ্ঠনালি অতিক্রম করে না।
চরমপন্থী মতাদর্শের সংকীর্ণতা
চিন্তা ও চেতনায় যারা চরমপন্থী, বেশকিছু দাবিতে তারা একমত। যেমন—
১. শাসকরা কুফরি করছে! : প্রচলিত শাসনব্যবস্থায় যারা শাসন করছে তারা কুফরিতে লিপ্ত। কেননা তারা আল্লাহর দ্বিনকে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেনি। তারা মানবরচিত শাসনপ্রণালিকে আল্লাহর দ্বিনের মর্যাদা দিয়ে মুরতাদ হয়ে গেছে, দ্বিন থেকে বের হয়ে গেছে। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ওয়াজিব। অথচ এসব শাসক বাহ্যিকভাবে ইসলামের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেন। মাদরাসা, মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে দ্বিন পালন ও প্রচারে সাহায্য করেন।
২. প্রচলিত শাসনব্যবস্থা অবৈধ! : তাদের দাবি হলো, ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত শাসনব্যবস্থা অবৈধ। কেননা এ শাসনব্যবস্থার শরিয়ত-অনুমোদিত ভিত্তি নেই। কেননা, তা বেশির ভাগ মানুষের মতামত, বিচক্ষণদের অভিমত ও সাধারণ মানুষের বাইআতের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং তা নির্ভর করে সংখ্যাধিক্য ও তরবারির ওপর। অথচ আমাদের পূর্বসূরি আলেমরা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন, যিনি আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রা.)-কে শহীদ করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণে নিরুৎসাহী করেছেন। স্বীকৃতি দানকারীদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ও আনাস ইবনে মালিক (রা.)-এর মতো মহান সাহাবিও ছিলেন। তাঁরা তা করেছিলেন রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা রোধ করতে।
৩. রাষ্ট্র হারাম জিনিসের বৈধতা দেয় : চরমপন্থীদের একটি আপত্তির জায়গা হলো, রাষ্ট্র মদ, জুয়া, ব্যভিচার, অনৈতিক সম্পর্ক, সুদসহ ইসলামী শরিয়তে নিষিদ্ধ বিভিন্ন বিষয়ের বৈধতা দেয়। আর যে ব্যক্তির শক্তি আছে, তার জন্য এসব অন্যায় প্রতিহত করা আবশ্যক। তারা মনে করে তারা পরিবর্তনে সক্ষম। তাই মুখের প্রতিবাদের পরিবর্তে শক্তি প্রয়োগ করতে চায়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় দেখে সে যেন হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। যদি সম্ভব না হয় মুখে প্রতিবাদ করে।’ আসলে এসব চরমপন্থী হাদিসের অপব্যাখ্যা করে। এরা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যায় প্রতিহত করার শর্তাবলি সম্পর্কে অমনোযোগী।
৪. কথায় কথায় কাফির আখ্যা দেওয়া : বেশির ভাগ চরমপন্থী সমাজের বেশির ভাগ মুসলিমকে কাফির মনে করে। কেননা, বেশির ভাগ মানুষ প্রচলিত শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করে অথবা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে না বা এসব ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্তদের কাফির মনে করে না। তাদের মূলনীতি হলো, যারা কাফিরকে কাফির বলে না তারাও কাফির। অথচ তারা ভাবে না, মহানবী (সা.) কালেমা পাঠকারীদের মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার ঘোষণা করেছেন।
মোটকথা, চরমপন্থীরা জিহাদ ও এর মূলনীতি এবং অমুসলিমদের ব্যাপারে ইসলামী রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি, অমুসলিমদের সঙ্গে আচরণ, অন্যায় প্রতিহত করার বিধান, শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া, কাউকে অমুসলিম আখ্যা দেওয়ার মূলনীতি বিষয়ে ভুল চিন্তা ও দর্শন লালন করে। (সংক্ষেপিত)