ইসলামের অনেক বিধান হিজরি বর্ষ ও চান্দ্র মাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঈদ, জুমাসহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসব সবই হিজরি বর্ষের ওপর নির্ভরশীল। মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় জীবনে হিজরি বর্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি বর্ষের আছে গৌরবময় ঐতিহ্য।
হিজরত থেকে হিজরি বর্ষ গণনার সূচনা : হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ও যুগান্তকারী ঘটনা। মুসলমানরা মক্কার কাফিরদের পাশবিক নির্যাতন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ নীরবে সহ্য করার ফলে তাদের আস্ফাালন আরো বেড়ে যায়। একপর্যায়ে তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। রাসুল (সা.) নির্যাতিত মুসলমানদের মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। হিজরতের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দ্বার উন্মোচিত হয়। হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) হিজরি বর্ষের গোড়াপত্তন করেন এবং মুসলমানদের জন্য চান্দ্র মাসের পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন। (আল-কামিল ফিত তারিখ লি-ইবনিল আসির, ১/৪)
ইসলামের দাপ্তরিক বর্ষ : হিজরি বর্ষ হলো ইসলামের দাপ্তরিক বর্ষ। ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি বর্ষ তথা চান্দ্র মাস অনুযায়ী পালন করতে হয়। যেমন—রমজানের রোজা, আইয়ামে বিজের রোজা, হজ, আশুরা, ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া জাকাতের এক বছর গণনা, সন্তানের বয়স গণনা এবং পূর্ণ দুই বছর সন্তানকে মায়ের দুধ পান করানোর হিসাব—সবই হিজরি বর্ষ তথা চান্দ্র মাস অনুযায়ী হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ তোমাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলো, এটি মানুষ ও হজের জন্য সময় নির্দেশক।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৯)
অর্থাৎ চাঁদের এই পরিবর্তন দেখে দিন-তারিখ ঠিক করা হয় এবং তার আলোকে ইবাদত পালনের সময় নির্ধারিত হয়।
কোরআন-সুন্নাহে হিজরি সনের কথা : হিজরি বর্ষের মাসগুলো কোরআন-সুন্নাহে আলোচিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে তা হিজরি বর্ষের গৌরবময় অধ্যায়। যেমন—আল্লাহ বলেন, ‘রমজান মাস—এ মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যা মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন আর সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে, তারা যেন এই মাসে রোজা রাখে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘হজ হয় সুবিদিত মাসগুলোতে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৭)
সুবিদিত মাসগুলোর ব্যাখ্যায় ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘সুবিদিত মাসগুলো হলো শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন।’ (বুখারি, হাদিস : ১৪৮৪)
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস গণনায় মাস ১২টি। এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৩৬)
চারটি নিষিদ্ধ মাসের ব্যাখ্যায় হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আবু বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘চারটি নিষিদ্ধ মাসের তিন মাস ধারাবাহিকভাবে জিলকদ, জিলহজ ও মহররম। আর রজব, যা জমাদিউস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। (বুখারি, হাদিস : ৩০২৫; মুসলিম, হাদিস : ৪৪৭৭)
সফর মাস প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘সফর মাসে অকল্যাণ নেই।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৪২৫; মুসলিম, হাদিস : ৫৯২৬)
রবিউল আওয়াল সম্পর্কে ইবনে শিহাব (রহ.) বলেন, উরওয়া ইবনে জুবায়ের (রা.) হিজরত প্রসঙ্গে বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সবাইকে নিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে বনু আমর ইবনে আউফ গোত্রে অবতরণ করেন। এ দিনটি ছিল রবিউল আওয়াল মাসের সোমবার। (বুখারি, হাদিস : ৩৬৯৪)
এভাবে হিজরি বর্ষের মাসগুলো কোরআন-সুন্নাহে আলোচিত হয়েছে।
যথাসময়ে ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের স্বার্থে চাঁদ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে হিজরি বর্ষের হিসাব রাখা সবার জন্য জরুরি। এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। মুসলমানদের জন্য গৌরবময় হিজরি বর্ষ এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই।
লেখক : ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়