‘শব’ ফারসি শব্দ যার অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ শব্দটি আরবি বারআত থেকে গৃহিত যার অর্থ বিমুক্তকরণ, সম্পর্ক ছিন্ন করা, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি। আমাদের সমাজে শবেবরাত ভাগ্যরজনী হিসেবে পরিচিত। নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বই-এ কবি গোলাম মোস্তফার লেখা ‘শবেবরাত’ নামে একটি কবিতা আমাদের পাঠ্য ছিল এবং সেখানে উল্লেখ ছিল ‘জান সালামত বন্টন করা পুণ্যরাত’। সাধারণ ধারণা, ভাগ্যরজনী হিসেবে এ রাতে বান্দার এক বছরের রিজিকসহ যাবতীয় বিষয়ে আল্লাহ কর্তৃক সিদ্ধান্ত হয়। মোটামুটি বলা যায়, বান্দার জন্য আল্লাহর এটা একটি বাজেট। তাই কথায় কথায় অজ্ঞ লোকেরা বলে থাকে শবেবরাতে তার ভাগ্যে ভালো কিছু লেখা হয়নি।
আমাদের এ অঞ্চলে শবেবরাত সাড়ম্বরে পালিত হয় এবং দিনটি থাকে সরকারি ছুটির দিন। রেডিও- টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় এবং মসজিদে মসজিদে দোয়া অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। গ্রামীণ জীবনে শবেবরাতের প্রভাব আরো বেশি ছিল। ঘরে ঘরে হালুয়া-রুটি বিতরণ ও ভালো খানার ব্যবস্থা এবং বাড়ি বাড়ি মিলাদ অনুষ্ঠান ছিল সাধারণ বিষয়। এ ছাড়া ঘর-দোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও কাপড়-চোপড় ধোয়াতো ছিলই। সময়ের প্রেক্ষিতে এ সব আচারণ- অনুষ্ঠান এখন আর নেই বললেই চলে। কুরআন-হাদিস চর্চার কারণে এর আবেদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং দ্বীনি শিক্ষার প্রসারে এখন আর মানুষ কোনো কিছু চোখ বন্ধ করে মেনে নেয় না। ইবাদতের নামে যে কোনো আচার-আচরণের পেছনে তারা দলিল তালাশ করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদত তখনই ইবাদত বলে বিবেচিত হয়, যখন তার সমর্থনে কুরআন ও হাদিসের প্রমাণ পাওয়া যায়। কুরআন ও হাদিসে সমর্থন না থাকলে তা নতুন উদ্ভাবন বা বিদয়াত হিসেবে পরিগণিত হয়। আর বিদয়াত সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট- ‘সকল বিদয়াতই গোমরাহী এবং তা জাহান্নামে যাওয়ার যোগ্য’। ইসলামে ইবাদতসমূহকে ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত/নফল তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। ফরজ- ওয়াজিব স্পষ্ট এবং উম্মাহর মধ্যে এ ব্যাপারে ক মত-পার্থক্য নেই। ফরজ-ওয়াজিব পালন করতে প্রতিটি মুসলিম নর-নারী বাধ্য এবং এর অন্যথা কবিরা গুনাহ। মূলত আখিরাতে আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হতে হবে ফরজ-ওয়াজিব সম্পর্কে।
প্রথমেই বলা যায়, শবেবরাতের আমল ফরজ-ওয়াজিব পর্যায়ের কোনো ইবাদত নয়; তাই এতো ঘটা করে পালন করা ও সরকারি ছুটি থাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় এটা নয়। পবিত্র কুরআনে শবেবরাতের কোনো উল্লেখ নেই। সুরা দুখানের -‘ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতিম মুবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুনজিরিন। ফিহা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকিম’ অর্থ ‘নিশ্চয়ই আমি এটি (আল কুরআন) এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি তো (জাহান্নাম থেকে) সতর্ককারী। এই রজনিতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’। কেউ কেউ বরকতময় রাত বলতে শবেবরাতকে (নিসফে শা’বান অর্থ মধ্য শা’বান) বুঝিয়েছেন। কুরআন থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা হলো সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। সুরা ক্বদরে আল্লাহ তায়া লা বলেছেন যে, তিনি কুরআনকে ক্বদরের রাত্রে নাজিল করেছেন। আর কদরের রাত যে রমজান মাসে তাও বুঝা যায় সুরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে উল্লেখিত রমজান মাসে কুরআন নাযিলের কথা উল্লেখ করায়। শবেবরাতে নয় কুরআন রমজান মাসে ক্বদরের রাতে নাজিল হওয়া বিষয়ে উম্মাহর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে।
শবেবরাতের বিষয়টি আমরা হাদিসে তালাশ করতে পারি। সিহাহ সিত্তাহ হাদিসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বুখারি ও মুসলিম এবং এ হাদিস দু’টিতে শবেবরাতের কোনো উল্লেখ নেই। ইবনে মাজায় আলী রা.-এর বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে, রসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন : ‘১৪ শা’বানের রাতে তোমরা বেশি বেশি করে ইবাদত করো এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা সূর্যাস্তের সাথে সাথে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন : কে আছ আমার কাছে গুনাহ মাফ চাইতে? আমি তাকে মাফ করতে প্রস্তুত। কে আছ রিজিক চাইতে? আমি তাকে রিজিক দিতে প্রস্তুত। কে আছ বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে বিপদমুক্ত করতে প্রস্তুত। কে আছ—’ এভাবে (বিভিন্ন প্রয়োজনের নাম নিয়ে) ডাকা হতে থাকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত’। ইমাম আহমদ বিন হাম্বলিসহ প্রখ্যাত হাদিস বিশারদগণ হাদিসটি যঈফ (দুর্বল) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইবনে মাজায় বর্ণিত হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. বলেন, রসুল সা. ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের মধ্যরাতে (শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত) সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত অন্য সবাইকে ক্ষমা করে দেন’। শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানি হাদিসটি সহীহ বলেছেন। তিরমিজী শরীফে রয়েছে, আয়েশা রা. বলেন ‘একদিন রসুল সা.-কে বিছানায় না পেয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে আল্লাহর কাছে দোয়া করা অবস্থায় তাঁকে পেলাম। তিনি আমাকে বললেন যে, রাতটি ফজিলতপূর্ণ তুমি ইবাদত-বন্দেগি করো’। সাধারণভাবে এ হাদিসটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত নয় এবং এ হাদিস দু’টি সম্পর্কে ইমাম বুখারিসহ অনেক হাদিস বিশেষজ্ঞ দুর্বল বলেছেন। দুর্বল বললেও ফজিলতের হাদিস বলে কিছুটা আমলে নেয়া যায়।
বুখারি ও মুসলিম শরীফে বিশেষ একটি রাতকে ফজিলতপূর্ণ না বলে প্রতিটি রাতকে বিশেষ করে রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে আল্লাহপাকের নিকটবর্তী আসমানে অবতরণের কথা বলা হয়েছে এবং বান্দা চাইলে তা পূরণের কথাও উল্লেখ রয়েছে। ইমামদের মধ্যে ইমাম মালেক র. ও তাঁর অনুসারীরা শবেবরাতের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন এবং ইমাম শাফেয়ী র. ব্যক্তিগতভাবে নিজ গৃহে ইবাদত-বন্দেগির পক্ষে। আর ইমাম আবু হানিফা র. ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলি র. এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো মতামত ব্যক্ত করেননি।
রমজানের প্রস্তুতিস্বরূপ রজব ও শা’বান মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় রসুল সা. একটু বেশি ইবাদত- বন্দেগি করতেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত -‘অন্য যে কোনো মাসের তুলনায় শা’বান মাসে রসিলুল্লাহ সা. বেশি বেশি রোজা রাখতেন’। শবেবরাতের রোজা না বলে আইয়ামে বীজের তিনটি রোজা ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ যে কেউ রোজস রাখতে পারেন। আশা করা যায় অন্যান্য মাসের তুলনায় শা’বান মাসে একটু বাড়তি সাওয়াব পাওয়া যাবে। কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নিজ গৃহে নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত ও দোয়া-দরুদ পাঠ করে আল্লাহর কাছে চাওয়া যেতে পারে। শেষ রাতে (তাহাজ্জুদ নামাজ) উঠে নামাজের মধ্যে বিশেষ করে সেজদায় গিয়ে নিজের সব প্রয়োজন আল্লাহর কাছে পেশ করা যায়। এটা শুধু শবেবরাতেই নয় প্রতিটি রাতেই আল্লাহর কাছে ধর্ণা দেয়া যায় এবং প্রতিটি রাতই ফজিলতপূর্ণ। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে নফল ইবাদত-বন্দেগির সওয়াব তাদেরই জন্য যারা ফরজ-ওয়াজিবসমূহ নিষ্ঠার সাথে পালন করে। এটা এমন যে, Compulsory Subject সমূহে পাশ করার পরই কেবল Optional Subject সমূহের অতিরিক্ত নম্বর একজন ছাত্রের যোগ হয়ে থাকে।
আমাদের সমাজে খুঁটিনাটি বিষয়ে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে এবং এ সব ব্যাপারে অনেকে চরমপন্থা অবলম্বন করে থাকে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, কম গুরুত্বপূর্ণ বলেই মতপার্থক্য। ফলে এ সব বিষয়ে যে কোনো একটি মত গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাড়াবাড়ি করা, অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ও হেয় করা এবং দলাদলি করাটাই হলো গুনাহের কাজ। তাই এ সব ব্যাপারে আমাদেরকে সতর্ক হওয়া দরকার। আবার এমন অনেকে আছেন, এ সব নিয়ে আলোচনা করাটাও পছন্দ করেন না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো যে, একদিনের জন্য হলেও তো কিছু লোক মসজিদে একত্রিত হয়, আলোচনা শুনে ও ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করে- তাতে মন্দ কী? সারা বছর ফরজ- ওয়াজিব পালন না করে দ্বীনকে একটি বিশেষ দিবসের ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে নেয়াটাই হলো ত্রুটি। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় সর্বক্ষণ আল্লাহর হুকুম পালনের নামই ইবাদত। সে একটি মুহূর্তও আল্লাহর ইবাদতের (গোলামির) বাইরে থাকতে পারে না। এই সার্বক্ষণিক আল্লাহর গোলামিতে নিয়োজিত করার লক্ষ্যেই প্রস্তুতিস্বরূপ নামাজ-রোজার মতো আনুষ্ঠানিক ইবাদত ফরজ করা হয়েছে।
সূর্যোদয়ের পূর্বে ঘুম থেকে জেগেই আল্লাহর ঘরে হাজিরা দিয়ে তাকে বলতে হয়- ‘আমি তোমারই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সাহায্য চাই’ এবং কর্মব্যস্ততার মাঝে জোহর, আছর, মাগরিব ও ঘুম যাওয়ার পূর্ব দিয়ে এশায় আল্লাহর ঘরে হাজিরা দিয়ে একই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করতে হয়। প্রতিদিনই শুধু নয়, দৈনিক পাঁচবার আল্লাহর এই স্মরণ যদি বান্দাসুলভ অনুভূতি নিয়ে কেউ করে তাহলে সে পরিশুদ্ধ না হয়ে পারে না। তাইতো আল্লাহ জোর দিয়েই বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে’। তাই বছরের বিশেষ একটি দিনের নয় দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং রসুল সা. নির্দেশিত ইবাদত বন্দেগিই পারে মানুষকে পরিশুদ্ধ করতে। আল্লাহপাক আমাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ তাঁর সকল বিধি-বিধান পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন