মা-বাবার মৃত্যুর পরে তাঁদের জন্য সন্তানের করণীয় আমল

জুমার খুতবা (২৪.০৯.২০২১) শ্রুতিলিখন: প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য বিষয়ে ধারাবাহিক আলোচনার তৃতীয় ও সর্বশেষ দিনে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর মৃত্যুর পরে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের করণীয় প্রসঙ্গে ১৬টি কাজের উল্লেখ করেন এবং প্রত্যেকটি করণীয় সম্পর্কে রেফারেন্সসহ হাদিস উদ্ধৃত করেন।

খতিব মহোদয় সমাজে চলে আসা কুসংষ্কার ও বিদয়াতের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে দুটি মধুর শব্দ রয়েছে, সেটা হলো মা ও বাবা। সন্তানের প্রতি মা-বাবার অবদান ও ত্যাগ পরিমাপযোগ্য নয়। আল্লাহপাক নিজেই তাঁদের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর আনুগত্যের সাথে সাথে মাতাপিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার তাগিদ দিয়েছেন। সেই মা-বাবার প্রতি অসম্মান, অনাদর, দায়িত্ব পালনে অবহেলা ক্ষমার অযোগ্য। বিশেষ করে তাঁরা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, স্বাভাবিকভাবে তখন তারা অসহায় হয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে প্রয়োজন নিবিড় পরিচর্যা, বাড়তি আদর যত্ন। দুর্ভাগ্য, অনেক হতভাগা সন্তান এই দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা প্রদর্শন করে। খতিব মহোদয় বলেন, মানবিক কারণে যারা বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলেন তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু যে সন্তান মনে করে বৃদ্ধ মা-বাবা তাদের সুখ-শান্তির অন্তরায় এবং বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে নিজ ঘরে আরাম-আয়াশে জীবনযাপন করে তিনি কঠোর ভাষায় তাদের নিন্দা করেন। শিশু অবস্থায় সন্তান লালন-পালনে মা-বাবা যে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন, সেটি স্মরণ করে সন্তানের উচিৎ বৃদ্ধ বাবা-মার মলমূত্র পরিষ্কারসহ যাবতীয় প্রয়োজন নিজ হস্তে করা। এর মধ্যেই রয়েছে তার জান্নাত। শুধু জীবদ্দশায় নয়, বাবা-মার মৃত্যুর পরও সন্তানের অনেক করণীয় রয়েছে। তিনি পিতামাতার জন্য সন্তানের ১৬টি করণীয় উল্লেখ করেন।

১. পিতামাতার জন্য দোয়া করা। মারা গেলে মানুষের সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। হাদিসে বলা হয়েছে, তিনটি আমল জারি থাকে। এক. সদকায়ে জারিয়া দুই. উপকারী ইলম ৩. দোয়াকারী নেক সন্তানের দোয়া। বনি ইসরাইলের ২৪ নং আয়াতে একটি দোয়া আল্লাহ নিজেই শিখিয়েছেন (রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা) এবং দুইজন সম্মানিত পয়গম্বরের দুটি দোয়া আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন (সুরা ইব্রাহিমের ৪১ ও সুরা নুহের ২৮ নং আয়াতে উল্লেখিত) যেখানে নিজের, পিতামাতার ও সকল ইমানদারের জন্য দোয়া শিখিয়েছেন। আল্লাহ স্বয়ং যে দোয়া শিখিয়েছেন তা ব্যর্থ হতে পারে না। হরহামেশা বিশেষ করে নামাজ শেষে বাবা-মার জন্য বেশি বেশি করে সন্তানের দোয়া করা উচিৎ।

২. দান-সদকা করা। বিশেষ করে সদকায়ে জারিয়া করা। যে আমল থেকে মানুষ অব্যাহতভাবে উপকার পেয়ে থাকে। মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, রাস্তাঘাট ও ব্রিজ-কালভার্ট করা, টিউবওয়েল প্রদান- এসবই সদকায়ে জারিয়া। তিনি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, তাঁর আব্বা ইন্তেকাল করলে কোনো খানাপিনার ব্যবস্থা না করে তাঁরা বাড়ির পাশে মসজিদের ছাদ নির্মাণে তিন ভাই মিলে একটি বড় অংশ বহন করেছিলেন। কাঁঠালবাগ জামে মসজিদের যারা ফাউন্ডার তারা কেয়ামত অবধি সওয়াব পেতে থাকবে। পিতা-মাতার জন্য সন্তান দান-সদকা করলে এর সওয়াব পিতা-মাতার আমলনামায় যোগ হওয়ার সাথে সাথে দানকারীও সওয়াবের ভাগী হন।

৩. সিয়াম পালন। পিতামাতার জন্য নফল সিয়াম পালন করে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা।

৪. হজ ও ওমরা পালন। পিতামাতার ফরজ হজ কাজা থাকলে তা পালন করা সন্তানের কর্তব্য। অবশ্য এক্ষেত্রে আগে সন্তানকে হজ আদায় করতে হবে। এছাড়া পিতামাতার সওয়াবের লক্ষ্যে নফল হজ ও ওমরা করা যায়।

৫. কুরবানি করা। কুরবানির সময় কুরবানিদাতা তার পিতামাতাকেও শরীক করে নিতে পারে। এতে পিতামাতাও সওয়াব পাবেন।

৬. অসিয়ত পূরণ করা। পিতামাতার কোনো অসিয়ত থাকলে অবশ্যম্ভাবী তা পূরণ করা সন্তানের কর্তব্য। সেটি হতে পারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে কোনো কিছু দান করা বা যে কোনো বিষয়ে তাঁদের নির্দেশনা।

৭. পিতামাতার বন্ধুদের সাথে সদ্ব্যবহার করা। পিতামাতার ইন্তেকালের পরে তাঁদের বন্ধুদের খোঁজ-খবর নেয়া, প্রয়োজন পূরণ ও সদাচরণ করা সন্তানের কর্তব্য। হজরত খাদিজা রা.-এর ইন্তেকালের পরে রসুলুল্লাহ সা. বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে তাঁর বান্ধবীদের কাছে পাঠাতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জনৈক বেদুইনকে দেখে উটের পিঠে উঠিয়ে নিলে তাঁর সাথে থাকা অন্যরা তাজ্জব হয়ে যান। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন আমার বাবা ও তার বাবা পরস্পর বন্ধু ছিলেন।

৮. পিতামাতার আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করা। পিতামাতা মারা গেলে চাচা, ফুফু, মামা, খালা এবং মাতাপিতা থেকে যত আত্মীয়-স্বজন হবে সবার সাথে সদ্ব্যবহার করা সন্তানের কর্তব্য।

৯. ঋণ পরিশোধ করা। পিতামাতা ঋণগ্রস্ত থাকলে যতক্ষণ ঋণ পরিশোধ না হয় ততক্ষণ সে আটকা পড়ে থাকে। সন্তানের উচিৎ সর্বাগ্যে পিতা-মাতার ঋণ পরিশোধ করা।

১০. মান্নত পূরণ করা। পিতামাতা মান্নত করে পূরণ করতে না পারলে তা পূরণ করা সন্তানের কর্তব্য।

১১. পিতামাতার জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা চাওয়া। এই ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে পিতামাতার আমলনামায় সওয়াব বেড়ে যায়।

১২. পিতামাতা কারো কাছে অন্যায় করলে সন্তানের উচিৎ পিতামাতার পক্ষে ক্ষমা চেয়ে নেয়া।

১৩. পিতামাতার ওয়াদা পালন করা। পিতামাতা কাউকে কোনো বিষয়ে ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি প্রদান করলে তা পূরণ করা সন্তানের একান্ত কর্তব্য।

১৪. পিতামাতার পালিত দায়িত্ব অব্যাহত রাখা। পিতামাতার কোনো ভালো আমল যেমন মসজিদ-মাদ্রাসা পরিচালনা করে থাকলে তা জারি রাখাও সন্তানের কর্তব্য।

১৫. পিতামাতার মন্দ কাজ বন্ধ রাখা। পিতার কোনো মন্দ কাজ যেমন মদের দোকান পরিচালনা বা হারাম কোনো ব্যবসা করে থাকলে তা বন্ধ করা সন্তানের কর্তব্য। তা না হলে পিতার সাথে সাথে সন্তানও গুনাহের ভাগিদার হবে।

১৬. কবর জিয়ারত করা। পিতামাতা মারা গেলে তাদের কবর জিয়ারত করা সন্তানের কর্তব্য। এতে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। রসুলুল্লাহ সা. নিজে তাঁর মার কবর জিয়ারত করেছিলেন।

যে কাজগুলো মৃত বাবা-মার জন্য কল্যাণকর সেগুলো না করে আমরা সমাজে যা করি তা মোটেই ইসলাম সম্মত নয়। খতিব মহোদয় প্রশ্ন করেন, মানুষ মিষ্টি খায়, জিলাপি খায় বা খানাপিনা করে আনন্দ-খুশির সময় না দুঃখ-বেদনার সময়। মুসল্লিরা সমস্বরে জবাব দেন, আনন্দস্ফুর্তির সময় মিষ্টি খায়। আমাদের সমাজে সব উল্টো হয়। আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী কেউ মারা গেলে নিয়ম হলো মৃতের ঘরে খাওয়ার পৌঁছানো। অথচ আমাদের সমাজে চার দিন বা চল্লিশ দিন (চল্লিশা) হলে গরু জবেহ করে খানাপিনার ব্যবস্থা করা হয়। এসবের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এতে কোনো সওয়াবও নেই। খানাপিনা হতে পারে দিনক্ষণ ঠিক না করে হতদরিদ্রদের উদ্দেশ্যে এবং সেই খানায় ধনীদের (সাহেবে নেসাব) কোনো অংশ নেই। সবচেয়ে উত্তম হয় কোনো ইয়াতিমখানায় খানার ব্যবস্থা করা।

মৃত্যুবার্ষিকী বা মারা যাওয়ার পরে মসজিদে দোয়া অনুষ্ঠান করে খতিব/ইমামকে হাজার টাকা ধরিয়ে দেয়ার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বরং এমনিতেই আলেম-উলামাদের হাদিয়া দিতে পারেন এবং এটি অত্যন্ত সওয়াবের। যারা সারাক্ষণ আল্লাহর দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত দানের ক্ষেত্রে তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য স্বয়ং আল্লাহপাকই বলেছেন। সমাজে এসব রেওয়াজ দীর্ঘদিন চলে আসছে এবং আমরা আলেম সমাজই করে আসছি। আমরা এখন উপলব্ধি করছি, তাই আপনাদেরকে নিষেধ করছি। মৃত পিতা-মাতার জন্য করণীয় যে ১৬টি আমলের কথা বলা হলো তা সবই সহিহ হাদিস থেকে গৃহিত। এর মধ্যে চল্লিশার কিছু নেই। খতিব মহোদয় পিতামাতার জন্য কুরআনে উল্লিখিত তিনটি দোয়া ও ১৬টি আমল (যা মসজিদের দেয়ালে লাগিয়ে দেয়া আছে) পরবর্তী জুমায় তাঁর মুসল্লিদের জিজ্ঞাসা করবেন বলে জানান। মুসল্লিরা তাতে স্বতস্ফুর্তভাবে সাড়া দেন।

আল্লাহপাক আমাদেরকে সুন্নাহ মোতাবেক জীবনযাপনের তৌফিক দান করুন।

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

কলামিস্ট এবং সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button