মসজিদ আল্লাহর ঘর, আর যারা মসজিদে আগমন করেন তারা আল্লাহর মেহমান
- জুমার খুতবা-২০.০৮.২০২১ শ্রুতিলিখন : প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর মসজিদের মর্যাদা ও মসজিদের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের মর্যাদা নিয়ে আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কুরআন ও হাদিসের প্রচুর উদ্ধৃতি পেশ করেন।
খতিব মহোদয় বলেন, কুরআন মজিদে অন্তত ২৮ জায়গায় মসজিদের উল্লেখ রয়েছে। তিনি সুরা জিন ১৮ নং আয়াত উদ্ধৃত করেন, ‘আর মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য। তাই তোমরা আল্লাহর সাথে আর কাউকে ডেকো না।’ মসজিদ একান্তভাবে আল্লাহর, এখানকার কর্তৃত্ব সবই আল্লাহর। কর্তৃত্বে আল্লাহর সাথে আর কারো অংশ নেই। সেজদা থেকে মসজিদের উৎপত্তি অর্থাৎ সেজদার স্থানকে মসজিদ বলা হয়। ইসলামী পরিভাষায় মসজিদ বলতে বোঝায় যেখানে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করা হয়। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বিরই ইবাদতের সুনির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে; যেমন : মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, মঠ ইত্যাদি। অন্যান্য ধর্মাবলম্বির জন্য উপাসনালয় ছাড়া তারা পূজা-অর্চনা করতে পারে না। আমাদের নবি সা.-এর শান ও মর্যাদার খাতিরে আল্লাহপাক সমগ্র জমিনকে সেজদার উপযুক্ত করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আমার জন্য সমগ্র জমিন পাক। ওয়াক্ত হলেই তিনি নামাজ পড়ে নিতে বলেন। আমাদের ধর্মে কবরস্থান ও নাপাক জায়গায় ছাড়া সকল স্থানে নামাজ আদায়ের সুযোগ রয়েছে। আকাশে উড়েও (বিমানে) ওয়াক্ত হলে নামাজ আদায় করে নিতে হয়।
মানবজাতির জন্য প্রথম স্থাপনা (ঘর) শুরু হয় মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়ে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই গোটা মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘরটি (বানিয়ে) রাখা হয়েছিল তা ছিল বাক্কায় (মক্কা নগরিতে), এ ঘর হচ্ছে মানবকুলের জন্য কল্যাণ ও হেদায়াত’- সুরা আলে ইমরান ৯৬। রসুলুল্লাহ সা. হিজরতের পরে নিজের বাড়ি-ঘরের কথা চিন্তা না করে প্রথম নির্মাণ করেছিলেন মসজিদ। মুসলমানরা যেখানেই গেছে সেখানেই মসজিদ নির্মাণ করেছে এবং মসজিদ মুসলিম জনবসতির পরিচয় বহন করে। খতিব মহোদয় (ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত) মসজিদের একটি তথ্য প্রদান করে বলেন, বিশ্বে বর্তমানে ২৫ লক্ষাধিক মসজিদ রয়েছে। সর্বাধিক ইন্দেনেশিয়ায় ৮ লক্ষ, ভারতে ৩ লক্ষ, বাংলাদেশে ২ লক্ষ ৫০ হাজার, পাকিস্তানে ১ লক্ষ ২০ হাজার, মিশরে ১ লক্ষ ৮ হাজার, সৌদি আরবে ৯৪ হাজার, তুরস্ক ৮২ হাজার, মরক্কো ৪১ হাজার, চীন ৩৯ হাজার। তিনি বলেন, কেয়ামতের দিন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু মসজিদসমূহ খানায়ে কাবার সাথে যুক্ত হয়ে থাকবে।
খতিব মহোদয় বলেন, মসজিদ আবাদ করা অর্থ এ নয় যে, মসজিদে টাইলস লাগাতে হবে, দামী ঝাড়বাতি ও মসজিদকে কারুকার্যময় করতে হবে। বরং মসজিদগুলোকে মসজিদে নববির আলোকে হেদায়াত জারির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। রসুলুল্লাহ সা. মসজিদের ইমাম ও খতিব হওয়ার পাশাপাশি সমাজেরও নেতা ছিলেন। বর্তমানে নামাজের বাইরে অধিকাংশ সময় মসজিদ তালাবদ্ধ থাকে। অথচ ইসলামের সোনালী যুগে মসজিদ ছিল প্রাণবন্ত। মসজিদে নববিতে বসে রসুলুল্লাহ সা. তাঁর সকল কর্মকাণ্ড সম্পাদন করছেন। বিচার-মিমাংসা, অপরাধের শাস্তি, মানুষের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, দুস্থদের সেবা সবই মসজিদ থেকে সম্পাদিত হয়েছে। দুর্ভাগ্য, মসজিদের ইমাম ও সমাজের ইমাম (নেতা) এখন পৃথক হয়ে পড়েছে। ইমাম-খতিব ও মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্টদের ওপর কর্তৃত্ব সমাজের নেতাদের। খতিব/ইমামের বক্তব্য তাদের মর্জির পরিপন্থি হলে আর তাদের চাকরি থাকে না।
সমগ্র বিশ্বের রাজত্ব ও কর্তৃত্ব আল্লাহর। তদুপরি মসজিদকে আল্লাহ তাঁর নিজের ঘর আখ্যায়িত করে এর সম্মান ও মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি ইমাম আবু ইউসুফ রহ. (ইমাম আবু হানিফার রহ. প্রখ্যাত ছাত্র) একটি রায় উল্লেখ করেন। তিনি ছিলেন সেই সময়ের প্রধান বিচারপতি। তখনকার বাদশাহ একদিন রাগের বশে স্ত্রীকে বলেন, তুমি রাতের মধ্যে আমার রাজ্যের বাইরে চলে যাও, অন্যথায় তোমাকে তালাক। তৎক্ষণাত বাদশাহ তাঁর ভুল উপলব্ধি করেন এবং বড় অসহায় হয়ে পড়েন, কারণ সে-সময়ে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে প্লেন বা কোনো দ্রুত যান ছিল না যে, স্ত্রীকে তাঁর রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দিবেন। বাদশা তাঁর প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফের শরণাপন্ন হলে সম্মানিত ইমাম রায় দেন, বাদশা তাঁর স্ত্রীকে রাতে মসজিদে রাখবেন কারণ মসজিদের কর্তৃত্ব তাঁর নয় অর্থাৎ তাঁর রাজ্যের আওতাবহির্ভূত। মসজিদ একান্তভাবে আল্লাহর।
সমাজে দাম্পত্যকলহ ও তালাক বৃদ্ধি পাওয়ায় খতিব মহোদয় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, স্বামী-স্ত্রী উভয়ই সহনশীল হলে সমস্যা হয় না, আবার দুইজনের কোনো একজন সহনশীল হলেও চলে, কিন্তু দু’জনই যদি মেজাজী হয় তাহলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। উদাহরণ দিয়ে বলেন, স্বামী কর্মক্লান্ত হয়ে বাসায় যাওয়ার পরে সামান্য কারণে স্ত্রী যদি বলে বসেন, আমি আর তোমার ভাত খাব না, পাল্টা স্বামী যদি বলে, না খেলে যাও তাহলেই গেল। বরং স্বামী হাসিমুখে বলবে, ভাত না খেলে রুটি খাও বা খিচুড়ি খাও, তাহলে দেখবেন, রাগ পানি হয়ে গেছে। সংসারে মান-অভিমান স্বাভাবিক এবং তা রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনেও ঘটেছে এবং ঘটেছে বলেই তো তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। উম্মুল মোমেনিন আয়েশা রা.-কে উদ্দেশ্য করে রসুলুল্লাহ সা. বলেন, হে আয়েশা! তুমি যখন রাগ করো তখন আমি বুঝতে পারি। আয়েশা রা. বলেন, কীভাবে? তিনি বলেন, তুমি যখন স্বাভাবিক থাক তখন বলো মুহাম্মদের আল্লাহ, আর যখন রাগ করো তখন বলো, ইবরাহিমের আল্লাহ। দাম্পত্যজীবন ও পারিবারিক জীবনে একটু উদার ও ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকলে সমস্যা হয় না।
মসজিদ আল্লাহর ঘর এবং এই ঘরে যারা যাতায়াত করে তারা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করলেই গুনাহ মাফ (হাদিসের ভাষায় এক নামাজ থেকে পরবর্তী নামাজ এবং এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা বান্দার ছগিরা গুনাহ ক্ষমা করা হয়) এবং মসজিদ থেকে বের হলেই মেজবানের পক্ষ থেকে মেহমান হাদিয়া-তোহফা নিয়েই বের হয়। আল্লাহর ভাণ্ডার অফুরন্ত, শুধু নেয়ার দরকার। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, কেউ যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করে তাহলে তোমরা সাক্ষ্য দেবে যে, ঐ ব্যক্তি ইমানদার। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেন, সাত শ্রেণির মানুষ কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ার নিচে আশ্রয় পাবে। তন্মধ্যে ঐসব ব্যক্তি যাদের অন্তর মসজিদের সাথে আটকে থাকে। অর্থাৎ এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পর পরবর্তী ওয়াক্তে শরীক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যারা সময় অতিবাহিত করে। কোনো ব্যস্ততা তাদেরকে জামাতে নামাজ আদায়ে গাফেল করে না।
আফগানিস্তানে তালেবানদের বিজয়ে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আল্লাহপাকের দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আলহামদু লিল্লাহ। তিনি মিডিয়ার সমালোচনা করে বলেন, যারা ২০টি বছর ধরে মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতন চালালো, নারী-শিশুসহ নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করলো তারা সন্ত্রাসী নয়, যারা দেশটাকে দখলদার মুক্ত করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করলো তারা সন্ত্রাসী, না- বরং তারা সবাই মহান মুক্তিযোদ্ধা এবং যারা হুড়োহুড়ি করে পালাতে গিয়ে পদপিষ্ঠ হয়ে মারা গেল তারা আসলে আমেরিকার দালাল আমাদের ভাষায় আফগানিস্তানের রাজাকার। খতিব মহোদয় বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে বলেন, আফগান শরণার্থী গ্রহণের আমেরিকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সরকার যথার্থ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বলেন, তালেবানদের বিজয়ে খুশি হওয়া ইমানেরই পরিচায়ক এবং ইসলামের দুশমন মুনাফিকদেরই কেবল কষ্ট হওয়ার কথা। প্রতিশোধস্পৃহা বাদ দিয়ে তালেবানদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা এবং সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। আল্লাহর কাছে তিনি ভ্রাতৃপ্রতিম আফগানিস্তানের শান্তি ও স্থিতিশীলতা কামনা করেন।
খতিব মহোদয় জানতে চান, আজকের আশুরায় কারা কারা রোজা পালন করছেন। অধিকাংশ মুসল্লি হাত তুলে সাড়া দেন। তিনি বলেন, যারা ৯ ও ১০ তারিখ রোজা পালন করছেন তাদের তো হয়ে গেল, আর যারা কেবল আজকে রোজা রেখেছেন তাদেরকে আগামীকালও রোজা রাখার জন্য তিনি আহবান জানান। তিনি মিডিয়ার সমালোচনা করে বলেন, আল্লাহর রসুল সা.-এর একটি সুন্নাহ লক্ষ লক্ষ মানুষের আশুরার রোজা পালন মিডিয়ায় খবর হয় না বরং খবর হয় কয়েকজন লোকের ‘হায় হোসেন-হায় হোসেন’ করে বুক চাপড়িয়ে তাজিয়া মিছিলের, যার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
খতিব মহোদয় দেশবরেণ্য আলেম, অনেক আলেমের উস্তাদ, উম্মাহর অভিভাবক ও আপোষহীন নেতা শায়খুল হাদিস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর রহ. মৃত্যুকে ইসলামের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে আখ্যায়িত করেন এবং মুসল্লিদের সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস (৩ বার) ও দরুদ শরিফ পড়ার জন্য আবেদন করেন। তিনি বাবুনগরী রহ.সহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার এবং কারবেলায় হোসাইন রা. ও তাঁর পরিবারের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেন।