দোয়ার তাৎপর্য
‘হে নবি! আপনি বলে দিন, যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই’।
- শ্রুতিলিখন : প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।
বিজয়নগর বাইতুন নূর জামে মসজিদের খতিব মুফতি মুহাম্মদ জাকারিয়া জুমার খুতবায় কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন- ‘হে নবি! আপনি বলে দিন, যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই’।
এতে বোঝা যায় বান্দা তার নিজের সমস্ত চাওয়া-পাওয়া সরাসরি আল্লাহর কাছে পেশ করবে এবং এ বিশ্বাস নিয়ে পেশ করবে যে, আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করবেন। চাওয়ার উত্তম মাধ্যম হলো নামাজ। আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন’।
তাই নিজের সকল প্রয়োজন, পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানাদি, আত্মীয়-স্বজন, অপর মুসলিম ভাই সবার জন্য কল্যাণ চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। যেহেতু আল্লাহ নিজ থেকে তাঁর কাছে চাওয়ার জন্য বলেছেন তাই প্রার্থনা ব্যর্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ আল্লাহ তাঁর বান্দার সাথে কখনই মিথ্যা বলতে পারেন না। অনেক সময় দোয়া তাৎক্ষণিক কবুল হয়, আবার কখনো বিলম্বে কবুল হয়।
অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য যখন যেটা ভালো মনে করেন সেটাই করেন। আবার অনেক সময় প্রার্থনাকারীর অযোগ্যতার কারণে দোয়া কবুল না করে দরখাস্ত ফেরৎ দেন। একদিন মসজিদে নববীতে দেখা গেল এক লোক মলিন পোশাকে আল্লাহর কাছে অনবরত চাচ্ছেন। রসুল সা. সাহাবিদের বললেন- দেখ এই লোক আল্লাহর কাছে চাচ্ছে অথচ তার পোশাক অপবিত্র, সে যা পেটে দিয়েছে তাও অপবিত্র (হারাম)। এমতাবস্থায় তার দোয়া কবুল হবে কী করে? তাতে বোঝা যায় দোয়া কবুলের শর্ত হলো হালাল খাদ্যগ্রহণ ও পরিধান।
পরস্পর দোয়া চাওয়া ও দোয়া করা খুবই উত্তম কাজ। একজন মুসলমান তার ভাই-এর সাথে সাক্ষাত হলে তার নিজের ও পরিবারের জন্য দোয়া প্রার্থনা করবে এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তার সাথে সাথে নিজে তার রবের কাছে প্রার্থনা করবে- তার যা প্রয়োজন সবই অত্যন্ত কাতরভাবে তার মালিকের কাছে চাইবে। আমাদের সমাজে কেউ মারা গেলে যদি লোকটি ভালো হয় তাহলে আমরা বলে উঠি- ইস, লোকটি চলে গেলেন, বড় ভালো মানুষ ছিলেন; এটিই তার জন্য দোয়া।
আর যদি দুষ্ট প্রকৃতির হয় তাহলে বলে- সত্যি কি? সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হয়। এটাও দোয়া, তবে বদদোয়া। মূলত এদেরই জন্য বড় আকারের দোয়া অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। শত শত গরীব ও ধনী লোক সে অনুষ্ঠানে খানাপিনায় অংশগ্রহণ করে। আমাদের মতো হুজুর ডেকে নিয়ে দোয়া করে থাকেন। সে অনুষ্ঠানে অনেক সময় নিজেদের থাকার প্রয়োজনটাও অনুভব করেন না। মরহুমের সন্তান-সন্ততিরা কখনই তার জন্য দোয়া করে না, কারণ সে শিক্ষা তার পিতা-মাতা তাকে দিয়ে যাননি। সন্তানের কল্যাণের জন্য সর্বক্ষণ ব্যস্ত জীবন অতিবাহিত করলেও কোনো দ্বীনি শিক্ষা দানের প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করে না।
তাই আল্লাহর কাছে নিজে চাইতে হবে এবং মৃত্যুর পরে সন্তানরা যাতে দোয়া করতে পারেন সেভাবে তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে। হাদিসে যাদের দোয়া কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে-
১. পিতা-মাতার দোয়া : তিনি এ প্রসঙ্গে অনেকগুলো হাদিসের বাণী উদ্ধৃত করেন- আল্লাহর কাছে পিতা-মাতার দোয়া কবুলের ক্ষেত্রে কোনো পর্দা নেই। মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত; প্রভুর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং প্রভুর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে। পিতা-মাতা হলো জান্নাতে যাওয়ার দরজা। যে তাঁদের মনে কষ্ট দিল সে জান্নাতে প্রবেশের দরজা ভেঙ্গে ফেললো। তাই পিতা-মাতার দোয়া পাওয়ার জন্য তাঁদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। দোয়া পাওয়ার জন্য অনেকে বিভিন্ন দরবারে ধর্ণা দেন অথচ সেখানে দোয়া কবুলের কোনো গ্যারান্টি নেই।
২. মুসাফিরের দোয়া: মুসাফির তিনি যিনি ৪৮ মাইল পথ অতিক্রমের লক্ষ্যে বাসা থেকে বের হন। নিজ বাড়ি থেকে বের হলে মানুষ অনেকখানি অসহায়ত্ব অনুভব করে। একজন ব্যক্তি মুসাফির অবস্থায় যেখানে থাকেন সেখানে তিনি সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার। তার সাথে উত্তম আচরণ করা হলে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ বা দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।
৩. মজলুমের দোয়া : জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের দোয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে কোনো পর্দা নেই। আল্লাহ জালেমকে শাস্তি দেয়ার জন্য সাধারণত মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেন না। জালেম বড় হোক ছোট হোক অবশ্যম্ভাবী তাকে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। এমন কি স্বামী-স্ত্রীও যদি পরস্পরের প্রতি জুলুম করে তাহলেও তার শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমরা নারী নির্যাতনের কথা বেশি বেশি শুনে থাকি। পুরুষরাও নির্যাতিত হয়ে থাকেন। মু’মিন কখনই একে অপরের প্রতি জুলুম করে না বা করতে পারে না।
৪. রোজাদারের দোয়া : রোজা অবস্থায় বিশেষ করে ইফতার পূর্বকালীন দোয়া কবুলের কথা হাদিস শরীফে পাওয়া যায়।
৫. হজম্পন্নকারীর দোয়া : হজ মানুষকে নিষ্পাপ করে দেয়। হজ থেকে ফেরৎ আসা ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ কবুল করে থাকেন।
৬. পিতা-মাতার জন্য সন্তানের দোয়া : মানুষ মারা গেলে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। তার মধ্যে দোয়াকারী নেক সন্তানের দোয়া তার পিতা-মাতার জন্য অব্যাহত থাকে। সন্তানের দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তার পিতা-মাতার আজাব মাফ করে দেন।
৭. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া : ন্যায়পরায়ণ শাসক বলতে সকল পর্যায়ে যারা শাসন ও বিচার কাজে নিয়োজিত থাকেন তাদেরকে বোঝায় এবং আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন। তারা ইনসাফ করলে আল্লাহর আরশের ছায়ার নিচে স্থান পাবেন, আর জুলুম করলে জাহান্নামই হবে তাদের ঠিকানা।
৮. মুজাহিদের দোয়া : আল্লাহর রাস্তায় প্রচেষ্টারত মুজাহিদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন যতক্ষণ তিনি জিহাদে লিপ্ত থাকেন।
৯. মুসলমানের দোয়া : এক মুসলমান তার আর এক ভাই-এর জন্য দোয়া করলে আল্লাহ সে দোয়া কবুল করেন। মূলত মানুষ তার ভাই-এর জন্য কল্যাণকর কিছু করলে বা ভালো আচরণের বিনিময়ে তার মুখ থেকে স্বতস্ফুর্তভাবে সন্তুষ্টিবাচক শব্দ উচ্চারিত হয়। এটিই হয় তার জন্য দোয়া।