মসজিদ উত তাকওয়ার সম্মানিত প্রধান ইমাম হাফেজ মাওলানা আব্দুল হাফিজ মারুফ জুমার খুতবায় আল্লাহর হামদ ও রসুল (সা)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারিতেও আল্লাহর ঘর মসজিদে এসে নামাজ আদায়ের সুযোগ লাভ করায় মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। আলহামদু লিল্লাহ।
ইমাম সাহেব বলেন, আল্লাহপাক মহামারি বা কোনো বিপদাপদ দেন একারণেই যে, তাঁর বান্দারা সতর্ক হবে এবং গুনাহের পথ ছেড়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে। করোনার সাথে সাথে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। এবারের করোনায় আমাদের অনেক প্রিয়জন আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন। তিনি তাঁদের মাগফেরাত কামনা করেন। আমাদেরও চলে যাওয়ার কোনো দিনক্ষণ নেই। যেকোনো মুহূর্তে ডাক আসতে পারে।
করোনা পূর্ববর্তী জীবনযাপন এখনকার জীবনযাপনে যদি কোনো পার্থক্য না থাকে বা এখনকার রাতগুলো যদি আরো আল্লাহর নাফরমানিতে ব্যয় হয় এবং সুদ-ঘুষ ও নানাবিধ পাপাচারে এখনো নিমজ্জিত থাকা হয় তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের চেয়ে হতভাগা আর কেউ নেই। তিনি আজকের খুতবায় কবিরা গুনাহ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
ইমাম সাহেব কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেন, ‘যদি তোমরা সেই সমস্ত বড় বড় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো, যা থেকে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, তাহলে তোমাদের (ছোটখাটো) গুনাহ আমি এমনিই তোমাদের হিসাব থেকে মুছে দেবো এবং অত্যন্ত সম্মানজনক স্থানে তোমাদের প্রবেশ করাবো’- সুরা আন নিসা ৩১।
এখানে আল্লাহপাক স্পষ্ট করেছেন যে, বান্দা যদি কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকে তাহলে ছোট ছোট গুনাহ তিনি এমনিতেই ক্ষমা করে দিবেন। বান্দার নেক আমাল ছোট গুনাহ দূর করে দেয়, বিশেষ করে দুই নামাজের মাঝখানে যেসব গুনাহ হয়ে থাকে নামাজ তা মিটিয়ে দেয়। যেমন, ফজরের নামাজের পরে সংঘটিত সগিরা গুনাহ জোহরের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মুছে যায়। এছাড়া ওজুর মাধ্যমে ছোটখাটো গুনাহসমূহ ধুয়েমুছে যায়। এসবই বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ। কবিরা গুনাহ তওবার মাধ্যমে ক্ষমা হয়। ইমাম সাহেব কিছু কবিরা গুনাহ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
কবিরা গুনাহের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় শিরককে। আল্লাহর সাথে শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ, যে গুনাহ ক্ষমা না করার স্পষ্ট ঘোষণা আল্লাহপাক দান করেছেন। তাঁর বাণী, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা (সে গুনাহ) মাফ করবেন না (যেখানে) তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা হয়, এছাড়া অন্য সব গুনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করলো সে সত্যিই (আল্লাহর ওপর) মিথ্যা আরোপ করলো যা বড় ধরনের একটি গুনাহ’- সুরা আন নিসা ৪৮। শিরক অর্থ কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ জ্ঞান করা। আল্লাহর জাতে, সিফাতে (গুণ) ও অধিকারে আর কাউকে সমমর্যাদা বা তাঁর চেয়ে বড় মনে করাকেই বলে শিরক।
আল্লাহর সাথে শিরক করার পর সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো মানুষকে হত্যা করা। মানুষ আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি এবং সেরা সৃষ্টি। মানুষ যখন কোনো কিছু তৈরী করে তখন দেখা যায় তার প্রতি তার আলাদা দরদ। হতে পারে একটি বাড়ির ডিজাইন বা একটি প্রবন্ধ রচনা। সে অন্যদেরকে তা দেখিয়ে আনন্দ অনুভব করেন। সেরা সৃষ্টি ও তাঁর প্রতিনিধি মানুষকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন এবং জঘন্য অপরাধ বলে উল্লেখ করেছেন।
নরহত্যা প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ইমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করবে, তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে অনন্তকাল থাকবে, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর ভীষণ রুষ্ট হন, তাকে তিনি লানত দেন, তিনি তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক আজাব প্রস্তুত করে রেখেছেন’- সুরা আন নিসা ৯৩।
এখানে আল্লাহপাক একসাথে কয়েকটি শাস্তির কথা বলেছেন। প্রথমত ঘাতক জাহান্নামে যাবে, সে সেখানে অনন্তকাল থাকবে, তৃতীয়ত আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হন, চতুর্থত ঘাতক অভিশপ্ত, পঞ্চমত তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। কুরআনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার শামিল।
এরপর ইমাম সাহেব কবিরা গুনাহ হিসেবে নামাজের কথা উল্লেখ করেন। নামাজ মুসলমান হিসেবে একজন ব্যক্তির পরিচিতি। মুসলিম ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্য হিসেবে হাদিসে নামাজকে উল্লেখ করা হয়েছে। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দিল সে কুফুরি করলো। নামাজ না পড়াটাই জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। নামাজ বলতে জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের কথাই বলা হয়েছে। রসুলুল্লাহ সা. ও সাহাবিদের যুগে জামাত ত্যাগকারীর মুসলমান থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুনাফিকদের মসজিদে জামাতে শরীক হতে হত।
মুনাফিকদের প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘এ দুটি নামাজ (এশা ও ফজর) মুনাফিকদের জন্য খুবই কষ্টকর। এ নামাজ দুটি জামাতে আদায় করায় কত যে পুণ্য রয়েছে তা যদি লোকেরা জানতে পারতো, তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তা আদায় করতে আসতো’- বুখারি ও মুসলিম।
হজরত ইবনে ওমর রা. বলেন, আমাদের মধ্যে কেউ যদি এশা ও ফজরের জামাতে উপস্থিত না হতো, তবে আমরা মনে মনে ভাবতাম, হয়তো সে মুনাফিক হয়ে গেছে। তাবারানি, বাজ্জার, ইবনে খুজায়মা।
ইমাম সাহেব বলেন, কোনো মহল্লায় তিনজন মুসলমানের বাস হলে তাদেরকে জামাতের সাথে সালাত আদায় করতে হবে। অবশ্য সংগত কারণে জামাত ছুটে গেলে একাকী নামাজ পড়ে নেয়ার জন্য বলেন। নামাজে কোনো ছাড় নেই। তিনি বলেন, নামাজ হলো মুসলমানিত্বের পরিচয়, ইসলামের যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তা মূলত নামাজ আদায়ের কারণেই রয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘তাদের পর তাদের অপদার্থ বংশধররা এলো, তারা নামাজ বরবাদ করে দিল এবং নানা পাশবিক লালসার অনুসরণ করলো, অচিরেই তারা গোমরাহীর পরিণাম ফলের সম্মুখীন হবে’- সুরা মারইয়াম ৫৯।
ইমাম সাহেব বলেন, কবিরা গুনাহের পরিমাণ অনেক। ইমাম যাহাবী রহ. তাঁর লিখিত ‘কবিরা গুনাহ’ নামক বইয়ে কবিরা গুনাহসমূহের বর্ণনা দিয়েছেন । কবিরা গুনাসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো আপন পিতা-মাতার সাথে অসদাচরণ। আল্লাহপাক তাঁর আনুগত্যের সাথে পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণের তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহর বাণী, ‘তোমার প্রভু নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো ইবাদত করোনা, ইবাদত করবে কেবল তাঁরই। পিতা-মাতার প্রতি ইহসান করবে, তাদের একজন কিংবা দুজনই তোমার জীবদ্দশায় বৃদ্ধ বয়সে এসে পৌঁছালে তাদেরকে ‘উহ্’ পর্যন্ত বলোনা এবং তাদেরকে ধমক দিয়োনা। তাদের সাথে কথা বলবে সম্মানের সাথে’- সুরা বনি ইসরাইল ২৩।
‘তোমরা এক আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করো, কোনো কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করো না এবং পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো’- সুরা নিসা ৩৬। হাদিসের কিতাবসমূহে পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহারের জোর তাগিদ রয়েছে।
এতিমের মাল ভক্ষণ কবিরা গুনাহ। আমাদের মধ্যে হয়তো অনেকেই এই গুনাহ থেকে মুক্ত। কিন্তু বোনকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার মতো কবিরা গুনাহের সাথে অনেকেই জড়িত। এটা যে গুনাহ, অনেকের মধ্যে সেই উপলব্ধিও নেই।
মিথ্যা বলা একটি কবিরা গুনাহ। আমাদের মধ্যে অনেকেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মিথ্যা বলে। অথচ হাদিসে বলা হয়েছে, মিথ্যা হলো সকল পাপের মা। মুনাফিকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য। তন্মধ্যে কথা বলার সময় মিথ্যা বলে। আরো বৈশিষ্ট্য হলো আমানতে খেয়ানত করা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, ঝগড়া-ঝাটি করার সময় অশ্লীল বাক্য বলা। এসবই কবিরা গুনাহ।
বিবাহের সময়ে মুসলিম সমাজে যৌতুকগ্রহণ অত্যন্ত ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক কাজ। অথচ আমাদের সমাজে তা বহাল রয়েছে। নানা কায়দায় মেয়ের বাবার কাছ থেকে যৌতুক আদায় করা হয়। যৌতুক নেয়া সুস্পষ্ট হারাম ও কবিরা গুনাহ।
কবিরা গুনাহসমূহের মধ্যে রয়েছে সুদ-ঘুষসহ অবৈধ উপায়ে উপার্জনের সকল পথ ও পন্থা। ধোকা-প্রতারণা, ওজনে কম-বেশি করা, ভেজাল দেয়া, মিথ্যা কসম খাওয়া অর্থাৎ জনস্বার্থ ব্যাহত হয় এমন সকল কর্মকাণ্ড হারাম ও কবিরা গুনাহ।
নেতৃত্বের প্রতি মোহ একটি কবিরা গুনাহ। নেতৃত্বের প্রতি আকাঙ্ক্ষাকারীকে নেতৃত্ব না দেয়ার জন্য রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন। আবার যোগ্যতা ও সততার কারণে জনগণ কাউকে নেতৃত্ব প্রদান করলে সেটি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোরও কোনো সুযোগ নেই। ফলে ইসলামী সমাজে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ, হিংসা-বিদ্বেষ ও মারামারি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দুর্ভাগ্য, আমরা সেই চরিত্র হারিয়ে ফেলেছি। জনগণের মনোনীত ব্যক্তিকে আল্লাহপাক সহায়তা প্রদান করেন।
ইমানদারদের মাঝে অনেকেই শিরক ও নামাজ না পড়ার গুনাহ থেকে দূরে রয়েছে। কিন্তু শয়তান তাদেরকে ভিন্নভাবে ঘায়েল করে। গিবত, ধারণা-অনুমান করা, সন্দেহ করা, হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা, অপরকে হেয় করা, গর্ব-অহঙ্কার করা- সবই কবিরা গুনাহ। সুরা হুজরাতে মানুষের আচরণ আল্লাহপাক শিখিয়েছেন। কুরআনে গিবতকে মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
হতাশ হওয়াও একটি কবিরা গুনাহ। যতবড় অপরাধই হোক না কেন হতাশ না হওয়ার জন্য আল্লাহ বলেছেন। তাঁর বাণী, ‘বলো (আমার একথা) হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের আত্মার ওপর জুলুম করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’- সুরা আয যুমার ৫৩।
নিজের ওপর হতাশ হয়ে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া একটি কবিরা গুনাহ। শয়তান মানুষকে প্ররোচনা দেয়, এতো এতো গুনাহ, তোমার ক্ষমা নেই। অথচ আল্লাহ মানুষকে ক্ষমার দিকে ডাকেন। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য অপেক্ষা করেন। নামাজের মধ্যে দোয়া মাছুরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার চমৎকার দোয়া।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে তিনি গুনাহ থেকে বাঁচার বিশেষ করে গর্ব-অহঙ্কারের মতো সর্বনাশা গুনাহ থেকে রক্ষার কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। তন্মধ্যে পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সবাইকে আগে সালাম দেয়ার কথা বলেন। বিশেষ করে অর্থবৃত্ত ও সামাজিক মর্যাদার দিকে নিজের চেয়ে যারা পেছনে রয়েছে তাদেরকে আগে সালাম দেয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। আমরা সবাই গুনাহের সাথে জড়িত। মহান আল্লাহপাক দয়া করে তা গোপন রেখেছেন। তাই পরিবার ও সমাজের কাছে আমাদের এত মর্যাদা। আল্লাহর এই দয়া ও অনুগ্রহ অন্তরে অনুভব করা এবং আল্লাহর কাছে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে গুনাহ থেকে দূরে থাকা সম্ভব। তিনি তাঁর নিজের ও মুসল্লিদের পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।