কাঁটাবন মসজিদের সম্মানিত খতিব অধ্যাপক মাওলানা রফিকুর রহমান মাদানি আজকের খুতবায় আল্লাহপাকের হামদ ও রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর তারাবিহ নামাজের গুরুত্ব ও রাকাত সংখ্যা এবং নানা বিতর্ক নিয়ে পুরো সময়টা আলোচনা করেন।
খতিব মহোদয় বলেন, অত্যন্ত ফজিলত ও রহমতের মাস রমজানুল মুবারক সমাগত। শাবান মাসের শেষে রসুলুল্লাহ সা. সমবেত সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আল্লাহপাক রমজান মাসে দিনে রোজা তোমাদের জন্য ফরজ করেছেন এবং তোমাদের প্রতি আমি রাতের নামাজ সুন্নাত করে দিলাম। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে লোক ঈমান ও এহতেসাবের সাথে দণ্ডায়মান হবে আল্লাহপাক তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ বড় সুসংবাদ। রসুলুল্লাহ সা. নিজে তারাবিহ নামাজ পড়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন, তাঁর সাহাবায়ে কেরাম তারাবিহ পড়েছেন এবং খুলাফায়ে রাশেদিনের অন্যতম হজরত ওমর রা. বিচ্ছিন্নভাবে নামাজ পড়াকে একজন কারীর তত্ত্বাবধানে জামাতে পড়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার পর থেকে উম্মাহ পালন করে আসছেন।
তারাবিহ শব্দ অর্থ বিশ্রাম। প্রতি চার রাকাত পড়ার পর বিশ্রাম নেয়ার কারণে এই নামাজের নাম তারাবিহ। মা আয়িশা রা. বর্ণনা করেন, একদিন রাতে রসুলুল্লাহ সা. মসজিদে গিয়ে উপস্থিত মুসল্লিদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। সেটা নিয়ে সকালে আলোচনা হলে দ্বিতীয় দিন মুসল্লি বেড়ে গেল এবং তৃতীয় দিনও তিনি নামাজ পড়লেন। চতুর্থ দিন মুসল্লি এতো বেড়ে গেল যেন মসজিদে আর ধরে না। কিন্তু রসুলুল্লাহ সা. আর বের হননি। ফজরে এসে তিনি নামাজ আদায়ের পর মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি সব জানি এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আসিনি, আমার ভয় হয় আল্লাহপাক তোমাদের প্রতি ফরজ করে না দেন। এতটুকু বোঝা যায় রসুলুল্লাহ সা. জামাতের সাথে তারাবিহ নিজে তিনদিন পড়েছেন। অর্থাৎ তিনি নিজে তারাবিহ পড়েছেন এবং সাহাবিদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
তারাবিহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ও অত্যন্ত ফজিলতের তাতে উম্মাহর মাঝে কোনো মতানৈক্য নেই। সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে একাকী পড়তেন বা কয়েকজন মিলে পড়তেন বা বাড়িতে পড়তেন অত্যন্ত আগ্রহ ও গুরুত্ব সহকারে। রমজান মাস সওয়াব কামাবার একটি মওসুম। হাদিসে নানাভাবে এর সওয়াব বর্ণনা করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবদ্দশায় ও আবু বকর রা.-এর শাসনামল এবং ওমর রা.-এর শাসনের প্রথম দুটি বছর এভাবে তারাবিহ পড়া হয়েছে। আব্দুর রহমান রা. বর্ণনা করেন, একদিন ওমর রা. মসজিদে গিয়ে এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে নামাজ পড়তে দেখে বলেন, আমার মনে হয় একজন অভিজ্ঞ লোকের নেতৃত্বে জামাতবদ্ধভাবে নামাজ আদায় করলে উত্তম হবে। তিনি তাঁর মতে দৃঢ় থেকে উবাই বিন কাব রা.-কে ইমাম নিযুক্ত করে জামাতে তারাবিহ পড়ার ব্যবস্থা করেন। পরের দিন এসে জামাতে নামাজ পড়া দেখে সন্তুষ্ট হয়ে বলেন, সুন্দর বিদয়াত। তাঁর এই বিদয়াত বলা শাব্দিক, পরিভাষাগত নয়। সাউম অর্থ উপোষ কিন্তু উপোষ থাকাকে সাউম বলা হয় না। রসুলুল্লাহ সা. শেখানো পন্থায় রোজা পালনকেই বলে সাউম বা রোজা। এথেকে অনেকে বিদয়াতের মধ্যে উত্তম বিদয়াত খুঁজে। বিদয়াত বিদয়াতই। এর মধ্যে ভালো-মন্দ নেই। সবই ভ্রষ্ট।
রসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাতের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নাতকেও আঁকড়ে ধরতে বলেছেন। ওমর রা.-এর খেলাফতকাল এবং পরবর্তী ওছমান রা. ও আলী রা.-এর খেলাফতকালে সাহাবায়ে কেরাম ঐক্যমতের সাথে জামাতে তারাবিহ আদায় করেছেন। উম্মাহর মধ্যে জামাতে তারাবিহ আদায়ের ব্যাপারে মতানৈক্য নেই। মতানৈক্য রয়েছে রাকাত নিয়ে। রসুলুল্লাহ সা. তিনদিন তারাবিহ জামাতের সাথে পড়েছেন এটির উল্লেখ থাকলেও কয় রাকাত পড়েছেন সেটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। মা আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়, রমজানে এবং রমজানের বাইরে রসুলুল্লাহ সা.-এর নামাজ ছিল ১১ রাকাত। তাঁর চার রাকাত নামাজ এতো দীর্ঘ ও সুন্দর ছিল তা আর কী বলবো? এতে বোঝা যায় ৮+৩ (বিতর) ১১ রাকাত পড়তেন। আবার কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে তেরো রাকাত। আবার এমন বর্ণনাও পাওয়ায় তোমরা রাতের নামাজ দুই দুই করে পড়ো এবং সময় শেষ হয়ে গেলে এক রাকাত পড়ে বেজোড় করে নেও। বোঝা যায় সাধারণভাবে বিতর তিনি তিন রাকাত পড়েছেন। বিতর অর্থ বেজোড়। নয়, সাত, পাঁচ, তিন ও এক রাকাত পড়ারও উল্লেখ পাওয়া যায়।
যারা তারাবিহ আট রাকাতের কথা বলেন, আসলে সেটি তারাবিহ নয় তাহাজ্জুদ। আয়িশা রা.-এর বর্ণনা হলো রমজান ও রমজানের বাইরে তিনি এগারো রাকাত পড়তেন। তারাবিহ নামাজ তো রমজান মাসে। রসুলুল্লাহ সা.-এর আট রাকাত নামাজ বিশ রাকাতের চেয়েও বেশি সময় ধরে পড়তেন। প্রধান চার ইমামসহ অধিকাংশ ইমামের মতে তারাবিহ নামাজ বিশ রাকাত। ইমাম মালেক রহ.-এর মতে ৩৬ রাকাত। তাঁর যুক্তি হলো মক্কায় যারা তারাবিহ পড়েন তারা প্রতি চার রাকাতের পরে তাওয়াফ করেন। তাদের সমান সওয়াব প্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রতি তাওয়াফের পরিবর্তে চার রাকাত বাড়তি নামাজ আদায়ের কথা বলেছেন। ইমাম আবু হানিফা রহ. ইমাম শাফেয়ি রহ. ও ইমাম হাম্বলি রহ.সহ অধিকাংশ ইমাম বিশ রাকাত তারাবিহ পড়ার কথা বলেছেন।
উম্মাহর মধ্যে মতানৈক্য ও দলাদলিতে খতিব মহোদয় অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তীব্র সমালোচনা করেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে দলাদলি ও মসজিদ পৃথক করাকে হারাম বলে উল্লেখ করেন। তাঁর প্রশ্ন- আহলে হাদিস মসজিদ কেন? এভাবে মসজিদ পৃথক করার অধিকার কে দিল? তাহলে হানাফি মসজিদ, মালিকি মসজিদ, হাম্বলি মসজিদ হবে? ইবাদতের নামে উম্মাহকে টুকরো টুকরো করার অধিকার কোথায় পেল? তারাবিহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, না পড়লে তো গুনাহ নেই কিন্তু তারাবিহ নিয়ে দলাদলি করা সুস্পষ্ট হারাম। উম্মাহর উচিৎ আগে হারাম পরিহার করা। ইবনে মাসউদ রা.-এর মতো সাহাবি উম্মাহর মাঝে মতানৈক্য সৃষ্টির ভয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অধীনে নামাজ পড়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম মদ্যপ শাসকের পেছনেও নামাজ পড়েছেন।
খতিব মহোদয় মুসল্লিদেরকে অনুরোধ করেন ফরজ- ওয়াজিবের বাইরে কারো আমল নিয়ে প্রশ্ন তুলে দলাদলি না করার। আল্লাহপাক মুমিনদেরকে পরস্পর ভাই এবং রসুলুল্লাহ সা. মুমিনদেরকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন। পায়ে কাঁটা ফুটলে বা কেটে গেলে কি চোখ সাড়া দেয় না? চোখ তখন অশ্রুসিক্ত হয়। তিনি বলেন, আপনার কথাবার্তা ও আচরণে অপর ভাই কষ্ট পায় এমন কিছু করবেন না। রমজান মাস সওয়াব কামাবার মওসুম, পুরোপুরি কাজে লাগান এবং রাতকে বেশি বেশি আল্লাহর জন্য ব্যয় করেন। যে মসজিদে নামাজ আদায় করেন সেখানে যদি বিশ রাকাত পড়া হয় আপনিও বিশ রাকাত পড়েন। মাসালা খুঁজতে গিয়ে শুধু শুধু ঝগড়াঝাটি করবেন না। ফরজ- ওয়াজিবের বাইরে রসুলুল্লাহ সা.-এর আমলেই ভিন্নতা ছিল। এই ভিন্নতাকে দলাদলি সৃষ্টির কাজে না লাগিয়ে দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করুন এবং আল্লাহর ওয়াস্তে ভ্রাতৃত্ববন্ধনকে মজবুত করুন। মতানৈক্য ও দলাদলি উম্মাহর বড় সমস্যা এবং কুফরি ও সুস্পষ্ট হারাম। ঈমানের স্বার্থে সকল ভাইয়ের প্রতি অন্তরে দয়া ও মুহাব্বত অনুভব করুন। আল্লাহপাক আমাদেরকে কবুল করুন।