বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর বরকতের জন্য সুরা আল আ’রাফ ৯৬ নং আয়াতে উল্লিখিত আল্লাহ নির্ধারিত দুটি শর্তের ওপর আলোচনা করেন। আয়াতের সরল অর্থ-
‘যদি জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনতো এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান ও জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে, অতঃপর তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করেছি’- সুরা আল আ’রাফ ৯৬।
সুরা আল আরাফ মক্কী সুরা এবং মক্কায় শেষ পর্যায়ে অবতীর্ণ। সেসময়ে মক্কাবাসীরা রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রচণ্ড বিরোধীতা করতো এবং মুসলমানদের ওপর নানাবিধ জুলুম-নির্যাতন চালাতো। হেদায়েতের লক্ষ্যে আল্লাহ দুর্ভিক্ষ ও বিপদাপদ দিয়ে তাঁর বান্দাদের মন নরম করতে চান যাতে নবি-রসুলদের দাওয়াত সহজেই গ্রহণ করতে পারে। মক্কায় ইতোপূর্বে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সেসময়ে তারা মুহাম্মদ সা.-এর কাছে এসে দোয়া করতে বললে তাঁর দোয়ার বরকতে আল্লাহ দুর্ভিক্ষ দূর করে সুদিন ফিরিয়ে দেন। ইতোপূর্বে নবি-রসুলদের যেমন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল তেমনি নবি মুহাম্মদ সা.-কেও তাঁর জাতির লোকেরা প্রত্যাখ্যান করে। ঈমান আনা ও তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করলে আল্লাহপাক বরকতের দুয়ার খুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদানের সাথে সাথে সতর্কও করে দিয়েছেন। আল্লাহর এই ওয়াদা চিরন্তন।
দুনিয়ার জীবনে বরকত ও কল্যাণ লাভের জন্য আল্লাহ দুটি শর্ত প্রদান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত সাফল্য বহুমাত্রিক এবং সেটি দুনিয়া ও আখেরাত মিলে। সকল ধনভাণ্ডার ও কল্যাণের চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে এবং তিনি তাঁর বান্দাদেরকে দিতে চান। শর্ত দুটির প্রথম হলো ঈমান এবং দ্বিতীয়টি হলো তাকওয়া। জীবনে সত্যিকার সুখ-শান্তি-পরিতৃপ্তি দানের মালিক আল্লাহ এবং সেটি যথার্থ ভোগ করতে পারে কেবল মুমিনরা। প্রাচুর্যের মধ্যে যে প্রকৃত সুখ নেই তা আমরা প্রতিনিয়তই চারিপার্শ্বে লক্ষ্য করছি। আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তাঁর পথে চলার মধ্যে যে পরিতৃপ্তি ও পরম সুখ রয়েছে তা কাফির-মুশরিক কখনই উপলব্ধি করতে পারে না। এখানে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করেছেন, তাঁর প্রতি ঈমান এবং তাঁকে ভয় করে চলার নীতি অবলম্বন করলে সেই জনপদকে তিনি সুখ-শান্তিতে ভরে দিবেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত আমাদের বাংলাদেশ এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে প্রকৃত সুখ-শান্তি কি রয়েছে? এককথায় জবাব হবে, না। আবার আমাদের মধ্যে একজনকেও পাওয়া যাবে না, যে বলতে পারে আল্লাহর ওয়াদা সঠিক নয়। তাহলে বলা যায় জাতিগতভাবে আমরা না মুমিন আর না মুত্তাকি।
আমাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারি কোথাও তাকওয়ার লেশ নেই। আমাদের মতো এতো মিথ্যাবাদী, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, আমানতে খেয়ানতকারী, হিংসা-বিদ্বেষে জর্জরিত বিশ্বে বিরল। যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহর প্রতিশ্রুত লাঞ্ছনা, অপমান ও জিল্লতি আমরা ভোগ করছি। মনে হতে পারে, আমরা তো আধা মুসলমান কিন্তু যারা আল্লাহকে আদৌ মানে না তাদেরকে কেন আমাদের ওপর শাসন করার ক্ষমতা দান করেছেন। এটিই তো আমাদের শাস্তি- লাঞ্ছনা, অপমান ও জিল্লতি।
এই বিশ্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর একটি নিয়ম রয়েছে। যারা মৌলিক মানবীয় গুণে ভূষিত অর্থাৎ যাদের মধ্যে রয়েছে সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা, সুশাসন, ন্যায়পরায়ণতা, কল্যাণকামিতা, পরিশ্রমপ্রিয়তা আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ায় নেতৃত্ব দিবেন এবং ঈমান না থাকার কারণে আখেরাতে শুভ ফল লাভ থেকে তারা বঞ্চিত হবে। আল্লাহ কারো আমলই বিনষ্ট করেন না। আল্লাহপাক যখন এই আয়াত নাজিল করেন তখন প্রতিশ্রুতি প্রদানের সাথে পাকড়াও করার কথাও বলেছেন। অল্পদিনের ব্যবধানে আল্লাহপাক আরবের জাহিলী নেতৃত্ব উৎখাত করে সেখানে রসুলুল্লাহ সা.-এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
খতিব মহোদয় ইতিহাস থেকে বরকতের দুটি ঘটনা উপস্থাপন করেন যা ছিল প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.-এর জীবনে ঘটে যাওয়া মুজিজা। একটি ঘটনা খন্দকের যুদ্ধকালীন যখন মুসলমানরা চরম দুর্ভিক্ষে পতিত হন। শত্রু কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্ষুধায় তাঁরা বড় কাতর হয়ে পড়েন। এমন সময় জাবের রা. তাঁর স্ত্রীকে এসে জানান যে মুহাম্মদ সা. ও তাঁর সাহাবিরা অভুক্ত রয়েছেন। একথা শুনে তাঁর স্ত্রী বলেন, তাদের একটি ছাগল রয়েছে সেটি জবেহ করে দিয়ে রসুলুল্লাহ সা.-কে দাওয়াত দিন। জাবের রা. রসুলুল্লাহ সা.-কে জানালে তিনি প্রকাশ্য ঘোষণা করে দেন যে সবার আজ জাবেরের বাড়িতে দাওয়াত। জাবের রা. ভয় পেয়ে স্ত্রীকে গিয়ে বললে তিনি জবাব দেন, যেহেতু রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন সেহেতু কোনো ভয় নেই বা সমস্যা নেই। এমনই ছিল আল্লাহর প্রতি তাঁদের তাওয়াক্কুল ও রসুল সা.-এর প্রতি আস্থা। সেই রুটি ও গোশত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিরা খাওয়ার পরেও মদিনাবাসী তৃপ্তির সাথে খেয়েছিলেন।
আর একটি ঘটনা আবু হুরাইরা রা.-এর বর্ণনা। তিনি আসহাবে সুফ্ফার একজন সদস্য এবং সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। একদিন তিনি ক্ষুধায় খুব কাতর হয়ে পড়লে আবু বকর রা. ও ওমর রা.-এর বাড়ি পর্যন্ত আলাপ করতে করতে যান। কিন্তু তাঁরা কেউ তাঁর অসহায়ত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। ফলে ফিরে মসজিদে চলে আসেন। নবি সা. বিষয়টি উপলব্ধি করে তাঁকে সাথে করে বাড়ি নিয়ে যান। কোনো এক স্ত্রীর ঘরে এক পেয়ালা দুধ পান। দুধ নিয়ে মুহাম্মদ সা. আবু হুরাইরা রা. বলেন, আসহাবে সুফ্ফার সবাইকে ডেকে আনো। দুধ এক পেয়ালা আর মানুষ সত্তর জন, তিনি তাজ্জব হয়ে যান। আবু হুরাইরা রা. ছিলেন খুবই ক্ষুধার্ত। তিনি ভাবলেন, এক ফোটা করে দুধও তো ভাগে পড়বে না। সবাই উপস্থিত হলে তাঁকেই দেয়া হয় দুধ পানের দায়িত্ব এবং সবাই তৃপ্তির সাথে সেই দুধ পান করেন। বরকত দানের মালিক আল্লাহ। তাঁর ভাণ্ডার অফুরন্ত। এটি ছিল নবির সা. প্রতি আল্লাহপাকের অনুগ্রহ। রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনে এমন অনেক মুজিজা ঘটেছে।
উপরোক্ত ঘটনা দুটি আল্লাহপাকের প্রত্যক্ষ বরকত দানের উদাহরণ। সুরা আ’রাফের ৯৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সাধারণভাবে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন, যে কোনো জনপদের মানুষ যদি তাঁর প্রতি ঈমান আনে ও তাঁকে ভয় করে চলে তাহলে আল্লাহ তাদের জীবন থেকে দুঃখ-কষ্ট দূর করে আসমান ও জমিনের বরকতের দুয়ারসমূহ খুলে দিবেন। অন্যথা ঘটলে তারা আল্লাহর আজাবের মুখোমুখি হবে।
আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান ও সকল অবস্থায় তাঁকে ভয় করে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।