ইয়াযিদকে নিন্দা করার বৈধতা ও বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তিখণ্ডন
- বুক রিভিউ: ইয়াযিদকে নিন্দা করার বৈধতা ও বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তিখণ্ডন। লেখক: ইমাম আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী (রা:) অনুবাদক: আব্দুল্লাহ যোবায়ের সম্পাদনা: অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ প্রকাশনী: ঐতিহ্য। রিভিউ কৃতজ্ঞতাঃ আরিফুল ইসলাম।
আব্দুল মুগীস হাম্বলী নামের এক আলেম ইয়াযিদের প্রশংসায় ❝ফাদাইলু ইয়াযিদ❞ নামে একটি বই লিখেন! এই বইয়ে তিনি ইয়াযিদের প্রশংসা সংক্রান্ত বানোয়াট ইতিহাস রচনা করেন, ইয়াযিদের অপকীর্তিগুলোর সাফাই গেয়ে তাকে সাধু প্রমাণের চেষ্টা করেন।
ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) আব্দুল মুগিসের ইয়াযিদের প্রশংসামূলক বইয়ের জবাবে একটি বই লিখেন। বইয়ের নাম- ❝আর রাদ্দু আলাল মুতাআসসিবিল আনিদ আল মানি মিন যাম্মি ইয়াযিদ❞। বইটি বাংলায় ❝ইয়াযিদকে নিন্দা করার বৈধতা ও বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তিখণ্ডন❞ নামে অনূদিত।
ইয়াযিদ মাত্র ৩ বছর শাসনক্ষমতায় ছিলো। এই ৩ বছর ক্ষমতায় থেকে সে এমনকিছু করেছিলো, যার ফলে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়। ইতিহাস যেমন নায়ককে জায়গা দেয়, তেমনি জায়গা দেয় খলনায়ককে। ইয়াযিদ মুসলিম ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেই অধ্যায়ে তার স্থান কী হিশেবে হয়? আসুন ইমাম জাওযীর মুল্যায়ন দেখি-
ইয়াযিদকে নিয়ে পূর্ববর্তী আলেমগণের মধ্যে নানান মত পাওয়া যায়। তাকে কাফির বলা, না বলা, লা ন ত দেয়া, লা ন ত না দেয়ার বিষয়েও আলেমগণের অবস্থান আছে।
❝ইয়াযিদ কা ফি র❞ এই মতপোষণ করেন:
ইবনে আকিল (রাহিমাহুল্লাহ) , আল্লামা আলূসী (রাহিমাহুল্লাহ)
তবে বেশিরভাগ আলেমগণ এই মতপোষণ করেন যে- ❝ইয়াযিদ কাফির নয়❞।
❝ইয়াযিদকে লা ন ত দেয়া জায়েজ❞ এই মতপোষণ করেন:
আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ), কাযি আবু ইয়ালা (রাহিমাহুল্লাহ), জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রাহিমাহুল্লাহ), ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ), ইবনে হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ)
❝ইয়াযিদকে ভালোবাসা ও লা ন ত দেয়া জায়েজ নয়❞এই মতপোষণ করেন:
ইমাম গাজ্জালী (রাহিমাহুল্লাহ), ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ), ইমাম ইবনে হাজার হায়তামী (রাহিমাহুল্লাহ)
তবে, যারা ইয়াযিদকে নিষ্কলুষ প্রমাণ করতে চায়, তার প্রশংসা করে, তাকে ন্যায়পরায়ণ মনে করে, তাদের ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন বেশ সরব। তিনি বলেন:
❝কিছু লোক ভাবে ইয়াযিদ ভালো লোক ছিলো, ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলো, রাসূলের যুগে জন্ম নেয়া সাহাবী ছিলো; এগুলো পথভ্রষ্টতা।❞ [ইমাম ইবনে তাইমিয়া, মাজমু আল-ফাতাওয়া ৪/৪৮২]
সহীহ বুখারীর শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীও (রাহিমাহুল্লাহ) ইয়াযিদের ব্যাপারে যারা গুণকীর্তন করে, তাদেরকে সতর্কবার্তা দেন। তিনি বলেন:
❝ইয়াযিদের প্রতি মহব্বত রাখা ও তার গুণকীর্তন করা কেবল বেদআতি ও বাতিল আকীদাধারীর পক্ষেই সম্ভব। কারণ, ইয়াযিদের ভেতর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিলো, যেজন্য কেউ তাকে ভালোবাসলে তার ঈমান চলে যাবার আশঙ্কা থেকে যায়। কেননা, শুধু আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও শুধু তাঁর জন্য ঘৃণা করা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত।❞ [ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, আল ইমতা বিল আরবাঈন আল মুতাবাইনাতুস সামা, পৃষ্ঠা ৯৬]
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে (রাহিমাহুল্লাহ) ইয়াযিদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি একটি রেটোরিকাল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন:
❝কোনো মুসলিম কি ইয়াযিদকে ভালোবাসতে পারে?❞
কন্সট্যান্টিনোপল অভিযানের ফযিলত সংক্রান্ত হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে কেউ কেউ ইয়াযিদকে ‘নাজাতপ্রাপ্ত’ বলে দাবি করেন। সেটার প্রেক্ষিতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম, মুহাদ্দিস
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
❝রাসূলুল্লাহর (সা:) ‘মাগফুরুল লাহুম (তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত) হাদীস দিয়ে কিছু লোক ইয়াজিদের নাজাতের স্বপক্ষে দলিল দেয়। কারণ, ইতিহাসের গ্রন্থাদি সাক্ষ্য দেয় যে, সে ঐ দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলো এবং সে তাদের সেনাপতি ছিলো। আসলে এই হাদীস দ্বারা যু দ্ধে র আগের করা তার অপরাধ ছাড়া অন্য কিছু মাফ হওয়া সাব্যস্ত হয় না। কারণ, আল্লাহর রাস্তায় যু দ্ধ কাফফারার অন্তর্ভুক্ত। আর কাফফারার রীতি হলো পূর্বের গুনাহ দূর করা, ভবিষ্যতের গুনাহ না। হ্যাঁ, যদি হাদীসে এরকম হতো যে ‘সে কিয়ামত পর্যন্ত ক্ষমাপ্রাপ্ত’ তাহলে তার নাজাত বুঝা যেতো। তা তো কস্মিনকালেও বলা হয়নি।❞
তাই, ❝এই যু দ্ধে র (কন্সট্যান্টিনোপল) পর হুসাইন (রা:) –কে হ ত্যা, মদীনাকে ধ্বংস করা, মদ্যপানের সাথে লেগে থাকা ইত্যাদি জঘন্য যেসব কাজ ইয়াযিদ করেছে, সেসব আল্লাহর কাছে ন্যস্ত থাকবে। অন্যান্য পাপীদের ব্যাপারে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন অথবা শাস্তি দিতে পারেন। এরপরও পবিত্র আহলে বাইয়াতের অবমাননাকারী, হারামে সীমালঙ্গনকারী, সুন্নাতের পরিবর্তনকারী সম্পর্কিত বর্ণিত হাদীস উপরোক্ত আম বক্তব্যকে খাস করার জন্য তো রয়েছেই❞ [শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, শারহু তারাজিমি আবওয়াবিল বুখারী, পৃষ্ঠা ৩১-৩২]
উপরে উল্লিখিত চারটি মতের মধ্যে ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) তৃতীয় মতপোষণ করেন। যারা চতুর্থ মতপোষণ করেন, তাঁদের মতগুলো লা ন ত দেয়া সংক্রান্ত হাদীস ও ইয়াযিদের ইতিহাসের আলোকে তিনি খণ্ডন করেন।
মোট ১৪ টি অনুচ্ছেদে তিনি তাঁর বইটি সাজান। অনুচ্ছেদগুলোর শিরোনাম হলো:
যেসব অপরাধীর প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা:) লা ন ত।
ইয়াযিদ বন্দনার পরিণাম।
ইয়াযিদের বাইয়াতের প্রতি আহ্বান।
ইয়াযিদের প্রতি মুআবিয়া (রা:) –এর উপদেশ।
আমির মুআবিয়া (রা:) –এর ইন্তেকাল।
মক্কায় ইমাম হুসাইন (রা:)।
হুসাইন (রা:) এর মাথা মোবারকের সাথে ইয়াযিদের ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ।
ইয়াযিদের চরিত্র-বিচার।
ইয়াযিদের হাতে বাইয়াতে মদীনাবাসীর অস্বীকৃতি
হাররার ঘটনা ও ইবনে উকবার মৃত্যু।
আব্দুল মুগিসের অযৌক্তিক প্রমাণাদি ও তার খণ্ডন।
ইয়াযিদের খেলাফতপ্রাপ্তি অসমর্থিত।
অত্যাচারী শাসকের আনুগত্য প্রসঙ্গ।
ইমাম হুসাইন (রা:) বিদ্রোহী ছিলেন না।
তৎকালীন সময়েও কেউ কেউ ইয়াযিদকে ‘আমিরুল মু’মিনীন’ বলতো। ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিশেবে খ্যাত উমর ইবনে আব্দুল আযিয (রাহিমাহুল্লাহ) যখন শুনলেন এক লোক ইয়াযিদকে ‘আমিরুল মু’মিনীন’ বা বিশ্বাসীদের নেতা বলে অভিহিত করছে, তখন তিনি সে ব্যক্তিকে বিশটি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দিলেন।
[ইবনে হাজার হায়তামী, আস সাওয়াইকুল মুহরিকা, পৃষ্ঠা ২২১]
আল্লামা ইবনে কাসির (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম ইবনুল জাওযীর (রাহিমাহুল্লাহ) এই বইয়ের রিভিউ দেন। তিনি বলেন:
❝(ইয়াযিদের প্রশংসা করতে গিয়ে) আব্দুল মুগিস হাম্বলী তার বইয়ে অনেক আশ্চর্যজনক ও অপ্রচলিত কথা নিয়ে এসেছে। ইবনুল জাওযী তার খণ্ডন করেছেন। তাঁর সে খণ্ডন সঠিক ও যথাযথ হয়েছে।❞ [আল্লামা ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিয়াহা: ১২/৩২৮]