আল্লাহপাক দয়া করে আমাদেরকে বাঙালি করে পাঠিয়েছেন। বাঙলা আমার মায়ের ভাষা। আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠতম উপহার এই ভাষা। এই ভাষায় শুদ্ধভাবে কথা বলা ও লেখা এবং এর মাধ্যমে গল্প, কবিতা, উপন্যাসে ইসলামকে ফুটিয়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। এসবের মাধ্যমে ইসলামকে সাধারণ মানুষের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব।
ব্যাপকভাবে ইসলামের চর্চা হয় বক্তৃতার মাধ্যমে। সাপ্তাহিক জুমার নামাজে খুতবা প্রদান বাধ্যতামূলক এবং সেটি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে শ্রবণ করতে হয়। কেউ কথা বললে ‘ভাই, চুপ করো’- তাও বলা যায় না। ইসলামের আলোকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং দ্বীনের ব্যাপক প্রচারের ক্ষেত্রে এই খুতবার অবদান অনস্বীকার্য। দুর্ভাগ্য, আমরা এর থেকে পুরোপুরি ফায়দা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছি না। মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ ও সমাজ পরিবর্তনে বক্তৃতার যাদুকরী প্রভাব রয়েছে।
জুমার দিনে বক্তৃতা শ্রবণকে আল্লাহর রসুল সা. আবশ্যক করেছেন। এটি শুধু বক্তৃতা নয়, ইবাদত এবং অত্যন্ত মনোযোগের সাথে শুনতে হয়। জুমার দিন প্রস্তুতিসহ সকাল সকাল মসজিদে উপস্থিত হওয়ার তাগিদ রয়েছে এবং যে প্রথমে উপস্থিত হবে তার আমলনামায় উট, পরবর্তীতে গরু, ছাগল ও মুরগি কুরবানির সওয়াবের কথা বলা হয়েছে। খতিব মহোদয় যখন মিম্বরে আরোহণ করেন তখন ফেরেশতারা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শ্রবণ শুরু করে। এতে উপলব্ধি করা যায়, ইমাম সাহেবের খুতবা শুরুর পরে উপস্থিত মুসল্লিরা জুমার সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়।
আমাদের দেশের ব্যবস্থাপনায় আরবিতে খুতবা দেয়া হয় যা শুধু অযৌক্তিকই নয় বরং আল্লাহর বাণী ‘আমি সব নবিকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে’- এর নির্দেশনার পরিপন্থী। খুতবা বা বক্তৃতা মানুষের বোধগম্য ভাষাতেই হওয়া বাঞ্চণীয়। দুর্ভাগ্য, মানুষ আরবি বুঝে না বিধায় খুতবা আমাদের দেশে তিনটি হয় যা সুস্পষ্ট বিদয়াত এবং আলোচনা চলার সময় বলা হয় পরে চার রাকাত সুন্নাত পড়ার সময় দেয়া হবে, এ কথা বলাতে খুবই স্বল্প সংখ্যক মানুষ বক্তৃতা শুনে থাকে এবং খতিব মহোদয়ের বাংলায় ওয়াজ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
দুটি খুতবা সুন্নাহ সমর্থিত এবং প্রথম খুতবা মাতৃভাষায় হলে এর হক আদায় হওয়া সম্ভব। ড. আব্দুল্লাহ বিন বাজের মতো জগত বিখ্যাত ফকিহ মানুষের বোধগম্য নয় এমন ভাষায় খুতবা প্রদানকে নাজায়েজ বলেছেন এবং সউদী আরবের বরেণ্য মুফতি শাইখ ইবনে উসাইমিন রহ.-কে মাতৃভাষায় খুতবা প্রদান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জায়েজ বলে মন্তব্য করেন এবং স্পষ্টভাবে বলেন, খতিবকে নিজ ভাষায় খুতবা দিতে হবে (ফাতওয়া আরকানিল ইসলাম)।
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, ‘প্রত্যেক খতিবকে জুমার সময় তাঁর মাতৃভাষায় ওয়াজ করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য’- তানকীহুর রুওয়াত ১/২৬৪।
প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নয়নের পরও বলা যায় দ্বীনের চর্চা ও নসিয়তের ক্ষেত্রে বক্তৃতার অবদান সর্বাগ্যে। জুমার খুতবা, তাফসিরুল কুরআন ও ওয়াজ মাহফিলে বরেণ্য আলেমদের ওয়াজ শোনার জন্য মানুষ উদগ্রীব থাকে এবং সেসব ওয়াজ মাহফিলের আলোচনা ইউটিউবে মানুষ মনোযোগ সহকারে শুনে। নসিহতের ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে রয়েছে জুমার খুতবা। রসুলুল্লাহ সা.-এর পন্থা অনুসরণ করে যদি জুমার খুতবা প্রদান করা যায় তবে উদ্বুদ্ধকরণ ও সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যুগান্তকর ভূমিকা রাখতে পারে।
এখানে বলা যায়, খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণের পূর্বে সব মুসল্লি মসজিদে উপস্থিত হয়ে যাবে এবং ইমাম সাহেব সমসাময়িক বিষয়ে মাতৃভাষায় খুতবা প্রদান করবে যাতে মহান আল্লাহর অভিপ্রায় ‘যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে’- বাস্তবায়ন হয়। খতিব মহোদয়ের খুতবা ও ফরজ নামাজের মাঝে আর কোনো নামাজ থাকবে না। ঢাকা শহরে অনেক মসজিদে খুতবা এবং ফরজ নামাজের মধ্যে কোনো নফল নামাজের সুযোগ দেয়া হয় না। আমাদের বিশ্বাস, বছরে ৫২টি সপ্তাহে খতিব মহোদয় পরিকল্পিতভাবে তাঁর মুসল্লিদের সম্মুখে দ্বীনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারলে ইনশা-আল্লাহ নসিহতের হক আদায় সম্ভব।
মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে এবং সেটি কোন্ প্রক্রিয়ায় আল্লাহ তা উল্লেখ করেননি। এব্যাপারে গাইডলাইন হলো দাওয়াত দিতে হবে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা। আল্লাহর বাণী, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের দিকে আহবান করো হিকমাত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়’- সুরা নাহল ১২৫।
যতো প্রকার প্রক্রিয়া রয়েছে এবং ভবিষ্যতে উদ্ভাবন হবে সবই বৈধ পন্থা। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক দাওয়াত, বক্তৃতা-বিবৃতি, জুমা ও ঈদের খুতবাসহ সবধরনের আলোচনা, বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকায় লেখনি, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ, ইউটিউব যতো রকমের উপায় আছে সবই গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ জনগণের বোধগম্যের লক্ষ্যে তাদের ভাষায় অর্থাৎ মাতৃভাষায় দ্বীনের চর্চা করতে হবে। মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষায় আমরা যতো পারদর্শী হবো ততো বেশি দ্বীনকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবো।
ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী একটি জাতির শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, তমুদ্দুন মজলিসের মতো একটি ইসলামী সংগঠন ভাষার জন্য আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। আল্লাহপাকের অশেষ দয়ায় বাংলা ভাষায় প্রচুর কুরআনের তাফসির, হাদিসের তরজমা এবং বিপুল পরিমাণ ইসলামী সাহিত্য গড়ে উঠেছে। সাহিত্যের একটি বড় অংশ গল্প, উপন্যাস, নাটক ও কবিতায় আমরা এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে পারিনি। আশার দিক, অনেক তরুণ ইসলামের আলোকে নতুন সাহিত্য রচনার প্রয়াস চালাচ্ছে।