বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
গতকাল বাদ এশা ধানমন্ডি মসজিদ উত তাকওয়ায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি সাইফুল ইসলাম ধারাবাহিক তাফসিরে সুরা হুদ থেকে ৭ ও ৮ নং আয়াত ব্যাখ্যা করেন। আয়াতদ্বয়ের সরল অর্থ-
‘তিনিই আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন,– যখন এর আগে তাঁর আরশ পানির ওপর ছিল,–যাতে তোমাদের পরীক্ষা করে দেখেন তোমাদের মধ্যে কে ভালো কাজ করে। হে মুহাম্মদ! এখন যদি তুমি তাদের বলো, মৃত্যুর পর তোমাদের অবশ্যই পুনরুজ্জীবিত করা হবে, তাহলে অস্বীকারকারীরা সাথে সাথে বলে উঠবে, এতো সুস্পষ্ট যাদু। আর যদি আমি একটি সময পর্যন্ত তাদের শাস্তি পিছিয়ে দেই তাহলে তারা বলতে থাকে, কোন্ জিনিস শাস্তিটাকে আটকে রেখেছে? শোনো! যেদিন সেই শাস্তির সময় এসে যাবে সেদিন কারো ফেরানোর প্রচেষ্টা তাকে ফেরাতে পারবে না এবং যা নিয়ে তারা বিদ্রূপ করছে তা-ই তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলবে’- সুরা হুদ ৭-৮।
[সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। আরবের কুরাইশদের দ্বারা রসুলুল্লাহ সা.-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার ফলে সুরা ইউনুস ও সুরা হুদে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। অতীত জাতিসমূহের (নুহের জাতি, আদ, সামুদ, লূতের জাতি, মাদয়ানবাসী ও ফেরাউনের সম্প্রদায়ের) নবিদের দাওয়াতের বিরোধীতার পরিণতি তুলে ধরে কুরাইশদের সতর্ক করা হয়েছে এবং এই দুটি আয়াতের মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন ও আল্লাহর আজাবের কথা উচ্চারিত হয়েছে। সুরা দুটি নাজিলের ফলে রসুলুল্লাহ সা. খুব ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, না-জানি তাঁর জাতির ওপর কখন গজব ঘনিয়ে আসে।]
খতিব মহোদয় বর্তমান বিশ্বের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে বলেন, করোনা সমগ্র বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে, তুরস্কে ভয়াবহ দাবানল, প্রকৃতির উষ্ণতায় বরফ গলে পড়াসহ বর্তমান বিশ্ব নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এসব বিপদ-মুসিবতে মানুষ আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে- এটিই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু তা লক্ষণীয় নয়। বস্তুবাদী এই সভ্যতায় মানুষ যাতে আল্লাহকে ভুলে থাকতে পারে তার জন্য খেলাধুলাসহ নানা রঙ-তামাশার আয়োজন করেছে। এসব বিপদ-মুসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা, সে উপলব্ধি গাফেলদের নেই এবং তাদের মাঝে মৃত্যু ও পরবর্তী জীবনের কোনো চেতনাও নেই। কুরআন সার্বজনীন ও সর্বকালের, এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
করোনা আমাদেরকে মৃত্যুর কথা বারবার স্মরণ করে দিচ্ছে। তিনি তাঁর অবস্থা ব্যক্ত করে বলেন, গত জুমায় তিনি আসতে পারেননি। হঠাৎ করে তাঁর প্রেসার দারুণভাবে পড়ে যায় যা অতীতে কখনই হয়নি। মনে হচ্ছে যে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে এবং এখনই মারা যাবেন। দুনিয়ার জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী। করোনায় মারা যাচ্ছে, -হার্টএ্যাটাক করছে, এক্সিডেন্ট করছে, এ যেন মৃত্যুর মিছিল এবং আমিও যে-কোনো সময়ে সেই মিছিলে শরীক হয়ে পড়বো- সেটি আমরা ভাবতে পারছি না।
বিশ্বজাহান সৃষ্টি প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেছেন যে তিনি ছয়দিনে পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহপাক সৃষ্টির বিষয়ে ‘হও’ বললেই তাৎক্ষণিক হয়ে যায়। এখানে ছয়দিনে সৃষ্টি বলায় বোঝা যায়, তিনি সময় নিয়ে এই সপ্ত আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এখন ছয়দিন আমাদের হিসাবে ২৪ ঘন্টায় দিন না আল্লাহর হিসাবে দিন তা তিনিই ভালো জানেন। আসলে আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি অত্যন্ত সীমিত। আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে তাঁর আরশ সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেটি ছিল পানির ওপর। সেই পানিও কেমন, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। তিনি একটি উপমা দিলেন, এক ব্যক্তি রাজার সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা পোষণ করেছিল। রাজার জন্য উপঢৌকন হিসেবে মরুভূমির বালি সরিয়ে এক কলস স্বচ্ছ পানি নিয়ে গেল। তার ধারণ এত স্বচ্ছ পানি পেয়ে রাজা খুশি হয়ে যাবেন। রাজা সানন্দে প্রজার উপঢৌকন গ্রহণ করে কলস ভর্তি করে স্বর্ণ-রৌপ্য দান করলেন এবং অপেক্ষা করতে বললেন। পরে তাঁর প্রজাকে সাথে করে রাজপ্রাসাদ দেখানোর সাথে প্রাসাদের সাথে স্বচ্ছ পানির বিশাল লেকও দেখালেন। সেই প্রজা লেক দেখে লজ্জিতই হলো। আল্লাহর জ্ঞানসমুদ্রের অতি সামান্যই মানুষকে দান করা হয়েছে। মানুষ হয়তো গবেষণা করে কিছু পেলেও অনেক কিছু তার অজানাই রয়ে যাবে।
এই আসমান ও জমিন যা কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে তা সবই মানুষের ভোগ ব্যবহারের জন্য। এসব পেয়ে সে কৃতজ্ঞ হবে, এটিই স্বাভাবিক। এই মনোরম পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তিনি মানুষকে পাঠিয়েছেন। এই পৃথিবী তার জন্য পরীক্ষাগার। আল্লাহ দেখতে চান কে ভালো কাজ করে আর কে মন্দ কাজ করে এবং সেটি যাচাই করা হচ্ছে। মুহাম্মদ সা.সহ সকল নবিদের দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাত। আখেরাতের ব্যাপারে তাদের ঘোর আপত্তি ছিল। মানুষ মরে যাবে, আবার তাকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে এবং ভালো-মন্দের হিসাব দিতে হবে, তা তারা মানতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। মুহাম্মদ সা. যখন মানুষকে আখেরাতের ভয় দেখান তখন কাফেররা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে এবং বলে, মুহাম্মদ মানুষকে যাদু করেছে। পৃথিবীতে সীমাহীন অন্যায়-অত্যাচার, দুর্নীতি ও আল্লাহ তায়ালার নাফরমানির মূলে রয়েছে আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাস। মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত হতে হবে এবং তার প্রতিটি ভালো ও মন্দ কাজের হিসাব দিতে হবে- এই বিশ্বাস কারো মধ্যে দৃঢ় থাকলে কখনই তার দ্বারা কোনো অন্যায় হওয়া সম্ভব নয়।
নাফরমানির ফলে আল্লাহপাক তাদেরকে আজাবের ভয় দেখিয়েছেন, কিন্তু কাফেররা এই আজাব অবিশ্বাস করতো। বরং চ্যালেঞ্জ দিত, সম্ভব হলে আজাব নিয়ে এসো। আল্লাহ বলেছেন, আজাবের সময়টা ঘনিয়ে আসলে কারো ক্ষমতা নেই তা ঠেকানোর। সাধারণত আল্লাহর রসুল কোনো জনগোষ্ঠীর মাঝে অবস্থান করলে আল্লাহ আজাব দেন না। অতীতেও আল্লাহ তাঁর রসুলদের আজাবের পূর্বে সরিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা নাফরমান জনগোষ্ঠীকে মাঝে-মধ্যে তাঁর নিদর্শন হিসাবে শাস্তি দিয়ে থাকেন। কিন্তু সেই উপলব্ধি তাদের নেই। বর্তমানে করোনাসহ যেসব বিপদাপদ মানুষের ওপর আপতিত হচ্ছে সেগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য সতর্ককরণ ও তাঁর পথে ফিরে আসার একটা আহবান তা অবিশ্বাসীরা মনে করে না। অবশ্য আল্লাহর বিশ্বাসী বান্দারা নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করার একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। যারা পেরেছেন তারা সত্যিই ভাগ্যবান। যারা পারেনি তারা হতভাগা, কপালপোড়া। খতিব মহোদয় করোনাসহ নানা বালা-মুসিবত থেকে আল্লাহর কাছে হেফাজত কামনা করেন।