বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
এই করোনা মহামারির মধ্যে আল্লাহপাক দয়া করে আমাদেরকে সুস্থ রাখার সাথে সাথে তাঁর ঘরে উপস্থিত হয়ে এশার সালাত আদায় এবং কুরআনের তাফসির শোনার সুযোগ দান করায় ধানমন্ডি মসজিদ উত তাকওয়ার সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি সাইফুল ইসলাম আল্লাহ তায়ালার দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। আলহামদু লিল্লাহ ! তিনি প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ সা.-এর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করে গতকাল বাদ এশা (প্রতি মঙ্গলবার) ধারাবাহিক তাফসিরে সুরা হুদ থেকে ৮-১১ নং আয়াত ব্যাখ্যা করেন। আয়াতসমূহের সরল অর্থ-
‘আর আমি যদি একটি সময় পর্যন্ত তাদের শাস্তি পিছিয়ে দেই তাহলে তারা বলতে থাকে, কোন্ জিনিস শাস্তিটাকে আটকে রেখেছে? শোনো! যেদিন সেই শাস্তির সময় এসে যাবে সেদিন কারো ফেরানোর প্রচেষ্টা তাকে ফেরাতে পারবে না এবং যা নিয়ে তারা বিদ্রুপ করছে তা-ই তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলবে। আমি যদি মানুষকে আমার রহমতের স্বাদ আস্বাদন করাই এবং পরে যদি তা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেই, তাহলে সে নিরাশ ও অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে। আবার দুঃখ-দৈন্য তাকে স্পর্শ করার পর যদি আমি তাকে অনুগ্রহের স্বাদ ভোগ করাই, তখন সে অবশ্যই বলতে শুরু করবে হ্যাঁ আমার সব-মুসিবত কেটে গেছে, সে যেমন অল্পতে উৎফুল্ল হয়, তেমনি সহজে অহংকারীও হয়। কিন্তু যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং নেক আমল করে, (তাদের কথা আলাদা) এরাই হচ্ছে সেসব লোক, যাদের জন্য (আল্লাহর) ক্ষমা ও মহাপুরস্কার রয়েছে’- সুরা হুদ ৮-১১।
ব্যাখ্যা : অতীতের সকল নবি-রসুলদের যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত কিছু লোক রয়েছে যারা পরকালকে অবিশ্বাস করে এবং এমন লোক কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। মানুষ মরে যাবে আবার তাকে জীবিত করে হিসাব গ্রহণ করা হবে, এটি তাদের কাছে ছিল একেবারেই অবিশ্বাস্য। এজন্যই তারা দুনিয়াটাকে যেনযেনভাবে ভোগ ব্যবহার করতে চায়। আজকের সমাজের জুলুম-নির্যাতন ও সীমাহীন দুর্নীতর মূলে রয়েছে এমন দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষ যখন সীমালঙ্ঘন করে ও রসূলের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে তখন সংশোধনের লক্ষ্যে আল্লাহপাক তাদেরকে আখেরাতে জাহান্নামের শাস্তি ও দুনিয়ার জীবনে আজাবের ভয় দেখিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা শাস্তিদানের জন্য তাড়াহুড়ো করেন না বরং ফিরে আসার জন্য অবকাশ দেন। কিন্তু সেটি তারা উপলব্ধি না করে আজাব আসায় বিলম্বের জন্য বিদ্রুপ করে। সেকথাটিই এখানে বলা হয়েছে, আল্লাহর আজাব যখন আসবে তখন তা ফেরানোর সাধ্য কারো থাকবে না। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেন না; তিনি ধরবেনই।
করোনা নামক মহামারি বিশ্ববাসীকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ লোকের প্রাণহানি (৪৩ লক্ষাধিক) এবং আক্রান্তও হয়েছে বিপুল পরিমাণ (২০ কোটিরও অধিক)। করোনার নিত্যনতুন রূপান্তর ঘটছে। কোনো কিছুই আল্লাহর অগোচরে নয়। আল্লাহপাক এসব বিপদ-মুসিবত দেন তাঁর বান্দাদের ফিরে আসার জন্য। করোনা আল্লাহর অনেক বান্দাকে পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ দান করেছে। এরা সত্যই ভাগ্যবান। ইমানদারগণও অনেক সময় হতাশ হয়ে পড়েন। তাদের কোনো হতাশা নেই। সম্মুখে বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই এসব বিপদাপদ। সবচেয়ে বড় বিপদ জাহান্নামের শাস্তি। হ্যাঁ, এসব বিপদাপদে যারা ধৈর্য অবলম্বন করে তাদের জন্যই সুসংবাদ। যেমন, প্রিয়তম নবি সা. বলেছেন যে, ইমানদারদের মধ্যে যারা মহামারিতে মারা যাবে তারা শহিদ। আল্লাহর ফয়সালা মানুষ সবসময় বুঝতে পারে না। তাই সুখ ও দুঃখ সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ থাকার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ। প্রসঙ্গক্রমে খতিব মহোদয় সুরা কাহাকে উল্লিখিত তিনটি ঘটনা ব্যাখ্যা করেন যা সাধারণ জ্ঞানে বোঝার কোনো উপায় নেই।
সুরা কাহাফে দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে, এখানে কেবল ঘটনা তিনটির উল্লেখ করা হলো। মুসা আ. আল্লাহর নবি, আল্লাহ তাঁর নবি আ.-কে খিজির আ.-এর কাছে প্রেরণ করেন। মুসা আ. তাঁর সাথে থাকতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটি শর্তে থাকতে পারেন, তা হলো আমার কাজে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না’। মুসা আ. রাজি হয়ে চলতে থাকেন। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির কারণে নদী পারাপারে কোনো নৌকা নেই। অনেক তালাশ করার পর একজন মাঝি পাওয়া গেলে তিনি রাজি হন। নদী পার হওয়ার পর খিজির আ. নৌকাটি ফুটো করে ডুবিয়ে দেন। মুসা আ. বলেন, আপনি করলেন কী? খিজির আ. বলেন, আমি বলেছি আপনি প্রশ্ন করতে পারবেন না। আবার কিছুদূর চলার পর দেখেন বাচ্চারা খেলাধুলা করছে এবং তাদের মধ্য থেকে একজন বাচ্চাকে ধরে আছাড় মেরে হত্যা করেন। মুসা আ. তাঁর প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। আবার কিছুদূর চলার পর ক্লান্ত-শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে তাঁরা মানুষের কাছে খাদ্য চান। কিন্তু সেই জনবসতির লোকেরা তাঁদেরকে খাদ্য তো দেয়নি উপরন্তু দুর্ব্যবহার করে। ফেরার পথে খিজির আ. একটি ধ্বসে পড়ার মতো দেয়াল মেরামত করে দেন। তখনও মুসা আ. প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। মুসা আ. যা করেছেন সেটিই যথার্থই। কারণ তিনি ভবিষ্যৎ জানেন না। ভবিষ্যতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর এবং তিনি কাউকে দান করলে সেটি স্বতন্ত্র। খিজির আ.-কে আল্লাহ দান করেছিলেন।
উপরোক্ত ঘটনার ব্যাখ্যা হলো, সেদেশের স্বৈরশাসক ভালো নৌকাগুলো অধিগ্রহণ করছিল কোনো বিনিময় ছাড়াই। গরীব মাঝির একমাত্র সম্বল ঐ নৌকাটি, ত্রুটিযুক্ত হওয়ায় নৌকাটি আর বাদশার লোকেরা নেয়নি। দ্বিতীয়ত, ঐ ছেলেটি বড় হলে তার বাবা-মার দুঃখের কারণ হতো এবং ছেলেটিসহ তারা জাহান্নামে যেত। হত্যা করার ফলে আল্লাহপাক তাকে আর একটি নেক সন্তান দেবেন এবং সবাই মিলে (নিহত ছেলেটিসহ) জান্নাতে যেতে পারবে। তৃতীয়ত, এক নেক বান্দা তাঁর সন্তানদের জন্য কিছু সম্পদ দেয়ালের নিচে লুকিয়ে রেখেছেন যাতে বড় হয়ে তারা তা লাভ করে।
আমরা আল্লাহপাকের রহমতের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছি। কিন্তু আমরা খুব কমই শোকরগুজার। আল্লাহ তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাকে পছন্দ করেন এবং কৃতজ্ঞতার বিনিময়ে নেয়ামত বাড়িয়ে দেন। বান্দার উচিত সকল সময় তার রবের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। সেটি হতে হবে অন্তরে অনুভব, মুখে উচ্চারণ ও কাজে-কর্মের মাধ্যমে। কৃতজ্ঞ বান্দা কখনই আল্লাহর নাফরমানি করতে পারে না। সামান্য দুঃখ-কষ্টেই কিছু মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যে আল্লাহ তাকে কিছু দেননি। আবার আল্লাহর নেয়ামত পেয়ে কিছু বান্দা অহংকারী হয়ে পড়ে ও মানুষের সঙ্গে দুর্বব্যবহার করে। আবার আল্লাহর এমন কিছু বান্দা রয়েছে বিপদাপদে যারা হতাশ হয় না, আবার নেয়ামত পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে অহংকারীও হয় না। এরা সবসময় ধৈর্য অবলম্বন করে ও নেক কাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।
মানবজীবনে সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সুখ ও দুঃখ সবই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। এই পৃথিবী একটি পরীক্ষাগার। আল্লাহপাক নানাভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করছেন। আমরা সবকিছু নিজেদের জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারবো না। সুরা কাহাফ সেটিই আমাদের শিক্ষা দান করছে। তাই সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা ইমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। খতিব মহোদয় আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যাতে আমরা তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে চলতে পারি।