Site icon World 24 News Network

আল্লাহর ইবাদতের পরেই পিতামাতার সাথে সদাচরণের হুকুম

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার প্রসঙ্গে সুরা বনি ইসরাইলের ২৩ ও ২৪ নং আয়াত উদ্ধৃত করেন- ‘তোমার রব আদেশ করেছেন, তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো; তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদের সাথে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং কখনো তাদের ধমক দিয়ো না, তাদের সাথে সম্মানজনক ভদ্রজনোচিত কথা বলো। অনুকম্পায় তুমি তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো, তুমি বলো, হে আমার রব, তাদের ওপর তুমি দয়া করো, যেমনি করে শৈশবে তারা আমাকে লালন পালন করেছেন।’

খতিব মহোদয় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত দুই জুমায় আসতে না পারায় তাঁর মুসল্লি ও শুভাকাঙ্ক্ষীগণ হাসপাতাল ও বাসায় খোঁজ-খবর নেয়াসহ দোয়া করেছেন এবং মসজিদে দোয়া করার জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ইমাম সাহেব দুই জুমায় খুতবা প্রদান করায় তিনি তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। পাঁচটি দিন তিনি হাসপাতালে ছিলেন এবং আল্লাহপাক দয়া করে তাঁকে সুস্থ করে দেয়ায় তাঁর দরবারে তিনি শুকরিয়া আদায় করেন। আলহামদু লিল্লাহ।

খতিব মহোদয় বলেন, আমার আপনার এই সুন্দর ও অসংখ্য নেয়ামতেভরা পৃথিবীতে আগমন আল্লাহপাকের একান্ত ইচ্ছা ও অনুগ্রহ এবং সেটি সম্ভব হয়েছে আমাদের পিতা-মাতার কল্যাণে। মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করেছেন। একটি সন্তানের জন্ম যেন মার পুনর্জন্ম লাভ। মার প্রসববেদনার সাথে কোনো বেদনার তুলনা হয় না। মা সবকিছু অকাতরে সহ্য করেন সন্তানের চেহারা একনজর দেখার জন্য। এ-সময় সকল মা জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলেন। যে মা বা বাবা সন্তানের জন্মের পূর্বে নিজেদের আরাম-আয়েশ নিয়ে ভাবতো সেই মা-বাবা সন্তান জন্মের পর তাদের সকল চাওয়া-পাওয়া, বাজারে কেনাকাটা সবই সন্তানকে কেন্দ্র করে। সন্তান জন্মের পর দুধপান থেকে শুরু করে তার লালন-পালন, শিক্ষাদান ও প্রয়োজন পূরণে মা-বাবার কোনো বিরক্তি নেই। নিজেদের প্রয়োজন অপেক্ষা সবসময় সন্তানের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।

সন্তানের জন্য মাতা-পিতার দরদ ও ভালোবাসা এবং ত্যাগ স্বীকারের কারণে আল্লাহ তায়ালা পিতা-মাতার মর্যাদা অনেক উচ্চে তুলে ধরেছেন। বান্দার প্রতি আল্লাহ তায়ালার প্রথমত নির্দেশ, তাঁকে ছাড়া আর কারো ইবাদত করা যাবে না। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি’- সুরা আয যারিয়াত ৫৬। মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কারো গোলামী বা হুকুম পালন করতে পারে না। এই নির্দেশের সাথে সাথে বলা হয়েছে তোমরা পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। সদ্ব্যবহার বলতে পিতামাতার ভরণপোষণ ও সকল প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি আচরণ, কথাবার্তায় তাঁরা যাতে কষ্ট না পান বা বিরক্ত না হন সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। বার্ধক্যে মানুষের মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়, সামান্যতেই রাগ করে বসে; এমন অবস্থায় পিতামাতা উপনীত হলে আল্লাহপাকের নির্দেশ তাদের উদ্দেশ্যে ‘উহ’ শব্দটিও উচ্চারণ করা যাবে না। ধমকের সুরে কথা বলা যাবে না, সবসময় বিনয়াবনত হয়ে থাকতে হবে। তাদের জন্য দোয়ার হাত প্রসারিত করে রাখতে হবে। আল্লাহপাক সন্তানকে পিতামাতার জন্য দোয়া করার ভাষাও শিখিয়ে দিয়েছেন- ‘হে আমার রব, তাদের ওপর তুমি দয়া করো, যেমনি করে শৈশবে তারা আমাকে লালন পালন করেছেন।’

পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালন সম্পর্কে হাদিসে অনেক বর্ণনা রয়েছে। বহুল প্রচলিত হাদিস উল্লেখ করে খতিব মহোদয় বলেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ রসুলুল্লাহ সা. আরো বলেছেন, ‘সন্তানের জন্য পিতামাতা হয় জান্নাত নয় তো জাহান্নাম।’ একটি মুসলিম সন্তানের কাছে পিতামাতা বোঝা হতে পারে না। বৃদ্ধাশ্রম অমুসলিম সমাজে মানায় কিন্তু মুসলিম সমাজ, সন্তানের কাছে পিতামাতা যেখানে জান্নাত অথবা জাহান্নাম সেখানে পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে সন্তান তার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে সুখি জীবন যাপন করতে পারে না। পিতামাতাকে কষ্টে রেখে সন্তানের কোনো ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর দরবারে গৃহিত হয় না। এমন ব্যক্তির হজও মূল্যহীন।

খতিব মহোদয় পিতামাতার খেদমত বিষয়ে নবি-রসুলদের আমল আলোচনা করেন। আমাদের প্রিয়তম নবি তাঁর পিতাকে দেখেননি। মা অতি শৈশবে মারা গেছেন। মুহাম্মদ সা.-এর পিতার কবর মদিনায় এবং পিতার কবর জিয়ারত শেষে মক্কায় ফেরার পথে মা মক্কা ও মদিনার মাঝপথে ইন্তেকাল করেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির বছরে মক্কা যাওয়ার পথে নবি মুহাম্মদ সা. মায়ের কবরের পাশে যাত্রাবিরতি করে মার জন্য অঝোরে কেঁদেছেন। তাঁর দাঁড়ি মোবারক ভিজে যায় এবং তাঁর কান্নায় সাহাবায়ে কেরাম পেরেশান হয়ে পড়েন। রসুলুল্লাহ সা. তাঁর দুধমা হালিমা রা.-এর প্রতি অত্যন্ত ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে গেছেন। একদিন তিনি মসজিদে নববিতে তসরিফ আনলে রসুলুল্লাহ সা. তাঁর পাগড়ি খুলে মেঝেতে বিছায়ে দেন। সাহাবায়ে কেরাম আশ্চর্য হয়ে জানতে চান কে এই মহিলা যাঁকে স্বয়ং নবি করিম সা. এত সম্মান দেখালেন। শেষে তিনি জানালেন যে, তাঁর দুধ হযরত হালিমা রা.।

হজরত ইব্রাহিম আ. সমগ্র মুসলিম জাতির পিতা এবং অত্যন্ত মর্যাদাবান পয়গম্বর। তাঁর জাতি কঠিন শিরকে নিমজ্জিত এবং তাঁর দাওয়াত তো গ্রহণ করেইনি উপরন্তু মূর্তির বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে নমরুদ তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল। হজরত ইব্রাহিম আ.-এর পিতা সন্তানের পক্ষ অবলম্বন না করে মূর্তির পক্ষ নিয়ে নমরুদের দলভুক্ত হয়ে চরম বিরোধীতা করেছিল। পিতা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে ইব্রাহিম আ.-এর জন্য সেটি ছিল বড় কষ্টের। তাই তিনি পিতাকে দাওয়াত দিয়েছেন। কুরআনে সেটি উল্লেখ রয়েছে, ‘যখন সে তার পিতাকে বললো, হে আমার পিতা, তুমি কেন এমন একটি জিনিসের পূজা করো, যে দেখতে পায় না, শুনতে পায় না, না সে তোমার কোনো কাজে আসে’- সুরা মারইয়াম ৪২। মাতাপিতা যদি কাফের হয় তারপরও তাদের প্রয়োজন পূরণ ও তাদের সাথে সদাচরণ করতে হবে। এটি সন্তানের কাছে পিতামাতার মর্যাদা।

হজরত ইসা আ.-এর জন্ম ছিল আল্লাহপাকের এক কুদরত। জন্মের পর মা শিশু ইসা আ.-কে কোলে করে তাঁর জাতির কাছে আসলে সবাই মারইয়াম আ.-কে অপবাদ দিতে থাকে, এমতাবস্থায় তিনি তাঁর শিশুর দিকে ইশারা করেন। শিশুটি বলে উঠে, ‘আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবি বানিয়েছেন, যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে তাঁর অনুগ্রহভাজন করবেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন আমি বেঁচে থাকি ততদিন যেন আমি নামাজ প্রতিষ্ঠা করি এবং জাকাত প্রদান করি। (তদুপরি) আমি যেন মায়ের প্রতি অনুগত থাকি, (আল্লাহর শোকর) তিনি আমাকে না-ফরমান ও হতভাগ্য করে বানাননি’- সুরা মারইয়াম ৩০-৩২।

আল্লাহর সকল নবি-রসুল পিতামাতার প্রতি ছিলেন অনুরক্ত এবং পিতামাতার সাথে সদাচরণ করার জন্য তাঁর অনুসারীদেরকে তাগিদ দিয়েছেন। সন্তানের প্রতি পিতামাতার দরদ প্রকৃতিগত এবং সকল সৃষ্টির মধ্যে সেটি লক্ষণীয়। আর পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা ও দরদ প্রকাশ প্রকৃতিগত হওয়ার সাথে সাথে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। পিতামাতার সাথে দুর্ব্যবহারকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে ইসলামে উল্লেখ করা হয়েছে। খতিব মহোদয়ের পিতা আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন এবং মা এখনো জীবিত আছেন। মা-বাবার খেদমত করার সুযোগ দান করায় তিনি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। তিনি তাঁর মুসল্লিদের কাছে জানতে চান কার কার বাবা-মা উভয়ই বা শুধু মা বা শুধু বাবা বেঁচে আছেন এবং কাদের মা-বাবা উভয়ই মারা গেছেন। তখন এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বাবা-মার খেদমত করে জান্নাতে যাওয়ার পথ মসৃণ করার জন্য তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন, তাঁদের মনে কষ্ট দিয়ে হজ করে আসলেও কোনো লাভ হবে না। পরবর্তী জুমায় মা-বাবার প্রতি কর্তব্য বিষয়ে আরো আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং সকলের বাবা-মার জন্য দোয়া করেন।

Exit mobile version