দুনিয়ার জীবন একটি সরল রেখায় চলে না, এটি একটি পরীক্ষাগার। মানুষ প্রতিনিয়তই পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা দুঃখ বলে কিছু নেই। সুখের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে, কতো রঙিন স্বপ্নে বিভোর; হঠাৎ করেই ছন্দপতন ঘটতে পারে। স্বপ্নগুলি সব ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এজন্যই প্রয়োজন ধৈর্যধারণ। এই পরীক্ষাগারে কতজনই না কতভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে। আল্লাহপাক পরীক্ষা নেবেনই, পরীক্ষা ছাড়া কাউকে তিনি পুরস্কৃত করবেন না। বিশেষ করে ইমানদারদের।
সুরা বাকারায় ১৫৫-৫৬ আয়াতে নানাভাবে পরীক্ষার কথা উল্লেখ করে আল্লাহপাক বলেন, যারা ধৈর্য অবলম্বন করে এবং বলে, আমরা আল্লাহরই জন্য ও তাঁরই কাছে ফিরে যাবো, তাদের জন্যই সুসংবাদ। সুরা বাকারার ১৫৩ নং আয়াতে ইমানদারদের ডেকে বলা হয়েছে, তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। পরীক্ষা কতভাবে আসতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। রোগ-ব্যাধি, প্রিয়জন হারানো, আর্থিক ক্ষতি, নিজের চাওয়া-পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি উপায়ে।
ধৈর্য অর্থ বিপদাপদে হতাশ না হওয়া বা ভেঙে না পড়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রার্থনা কবিতায় বলেছেন,
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে যেন আমি না করি ভয়।
একজন অমুসলিম হয়েও তিনি তাঁর স্রষ্টার কাছে সাহস -হিম্মত প্রার্থনা করেছেন। মুসলমানদের নির্ভর করার ও চাওয়ার জন্য একজন সত্তা রয়েছেন। তিনি অফুরন্তু ক্ষমতার অধিকারী এবং তাঁর ভাণ্ডারও সীমাহীন। দেয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর মধ্যে কোনো কার্পণ্য নেই। সেখানে একজন ব্যক্তি তার সকল চাওয়া পেশ করে হতাশা মুক্ত হয়ে নিরুদ্বিগ্ন জীবন যাপন করতে পারে। চাওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহপাক নামাজ ও ধৈর্যের কথা বলেছেন। রসুলুল্লাহ সা. যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি হলে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং আল্লাহর কাছেই পেশ করতেন। নামাজ বান্দার সাথে রবের গোপন কথাবার্তা বিশেষ করে বান্দা যখন সেজদায় চলে যায় তখন আল্লাহর খুব নিকটবর্তী হয়ে পড়ে। আল্লাহ নিজেই নামাজের মাধ্যমে চাইতে বলেছেন। না প্রাপ্তির কোনো কারণ নেই। না পাওয়া গেলে বুঝতে হবে কাঙ্ক্ষিত জিনিস পাওয়ার মধ্যে তার কোনো কল্যাণ নেই।
সুরা বাকারার ১৮৬ নং আয়াতে আল্লাহপাক তাঁর নবিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমি বান্দার অতি নিকটে, যে ডাকে আমি তার ডাক শুনি ও জবাব দেই। বান্দার প্রতিটি ডাক আল্লাহর কানে পৌঁছে। মানুষের কাছে এমন কি পিতামাতার কাছে চাইলেও তারা বিরক্ত হন। কিন্তু আল্লাহর কাছে না চাইলেই তিনি অসন্তুষ্ট হন। চাওয়ার মাধ্যমেই মানুষ প্রমাণ করে যে, আমি আল্লাহর বান্দা এবং তিনি আমার রব।
তাই আল্লাহর কাছে চাইতে হবে বেশি বেশি করে এবং মনে করতে হবে আল্লাহর দেয়ার সামর্থ ও ইচ্ছা দুইই রয়েছে। আল্লাহর কাছে চাওয়া একটি ইবাদত, সওয়াবের কাজ এবং বান্দা চাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রশান্তি খুঁজে। বান্দার চাওয়া এ দুনিয়ায় অপূর্ণ থাকলে আল্লাহ সবই জমা করে রেখে আখেরাতে পূর্ণমাত্রায় দান করবেন। তাই আল্লাহর কাছে চাওয়া থেকে কখনই আমরা বিরত হবো না। যা প্রয়োজন সবই চাইবো- তা চাকরি, স্বামী/স্ত্রী, ব্যবসায়ে সাফল্য, সুস্বাস্থ্য, সন্তান সবই চাইতে পারি।
আমরা তো আল্লাহর কাছে চাই এই মনে করে যে আল্লাহর ভাণ্ডার অফুরন্ত এবং তিনি বড় উদার ও দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে কোনো কার্পণ্য বা হীনমন্যতা নেই। তাঁর বান্দা ও প্রতিনিধি হিসেবে আমাদেরকেও উদার হতে হবে এবং হিংসামুক্ত হয়েই আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। হিংসা জঘন্য অপরাধ এবং হিংসুকের জান্নাত নেই (আজকের নয়া দিগন্তে ‘হিংসুকের জান্নাত নেই’- মর্মে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে)। লাইলাতুল কদরে সবাইকে ক্ষমা করা হবে কিন্তু মুশরিক ও হিংসুকের ক্ষমা নেই।
পারস্পরিক আচার-আচরণ ও লেনদেনে আমরা যদি পরস্পর কষ্ট পেয়ে থাকি তাহলে ক্ষমা করার মধ্য দিয়ে আমরা পরিচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারি এবং আল্লাহর ক্ষমা লাভে ধন্য হতে পারি। ক্ষমা করার চেয়ে বড় গুণ আর নেই। প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে এবং তা হতে হবে সমপরিমাণ, একটুও বাড়াবাড়ি করা যাবে না। কিন্তু আল্লাহর পছন্দ ক্ষমা করা এবং এর বিনিময়ে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহপাক আমাদেরকে উদার ও ক্ষমাশীল হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।