মূলে প্রাকৃত হলেও বাংলা হচ্ছে একটি সঙ্কর ভাষা, যার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে সংস্কৃত হিন্দি আরবি ফারসি তুর্কি পর্তুগিজ ইংরেজি ইত্যাদি ভিনদেশী ভাষা দিয়ে। যেমন ‘নকল’ একটি আরবি শব্দ কিন্তু আমাদের সমাজে এটি এমনভাবে মিশে গেছে, মনে হয় যেন সে বাংলারই জাতভাই। তবে ‘নকল’ বলতে আগে শহুরে শব্দ মনে হতো, অর্থাৎ গ্রামীণ জীবনে নকলের প্রাদুর্ভাব ছিল কম, গ্রামে ‘নকল’ বলতে শুধু পরীক্ষায় নকল বুঝাত। এখন তো গ্রাম আর শহর একাকার।
গত শতাব্দীর আশির দশকে গ্রাম ছেড়ে যখন শহরে এলাম, পড়তে, পত্রিকা হাতে নিলেই চোখে পড়ত কোনা-কাঞ্চিতে ছড়িয়ে থাকা সতর্কবাণী: নকল হইতে সাবধান! কিসের নকল? আলমের বল সাবান, আদি আকিজ বিড়ি, একনম্বর বিক্রমপুরী লুঙ্গি, লালবাগের কবিরাজি ঔষধালয়। তবুও নকল হতো, নকলের দৌরাত্ম্যে মহাজনের ঘুম হতো না, ক্রেতার পেট খারাপ হতো। দুদিক থেকেই তাই সাবধানতার প্রসঙ্গ আসত।
আর কিছু? নকল মানে অনুলিপি অপূর্ণ অবিকল অভিন্ন নমুনা (মডেল) ছদ্মবেশ বিকৃত লুকোচুরি প্রতিকল্প প্রতিবিম্ব প্রতিরূপ প্রতিলিপি হুবহু…। পশ্চিমা সভ্যতায় নকল একটি গর্হিত কাজ–লজ্জাজনকই শুধু নয়, শাস্তিমূলকও। তবু সেখানে নকল হয় বলেই এর এতসব প্রতিশব্দ। সেজন্য তারা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকারস্বত্ব’ নামে আইনও করেছে, যা শুধু নিজ দেশে নয়, বিদেশেও প্রয়োগ করে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের মাধ্যমে।
অনেকে বলে, পণ্য নকলে চাইনিজরা এতবেশি সিদ্ধহস্ত এবং ‘কাজ’টাকে এত সহজ স্বাভাবিক করে নিয়েছে যে, আসলটার হদিস পাওয়া যায় না। তখন বলে, এটা একনম্বর নকল, অর্থাৎ মূলের কাছাকাছি। সুতরাং আরও আছে: নকল নাম্বার ২ বা ৩… যাদের কদর ও দাম পড়তে থাকে ক্রমান্বয়ে। বাঙালিও কম যায় না, নকলের গায়ে লাগায় নকল স্টিকার: নকল হইতে সাবধান! যিনি নকলামি করেন তিনি হলেন নকুলে কিন্তু আমাদের আছে ‘নকলা’ উপজেলা, যেখানে সবাই হয়ত নকলে নাকাল। যাবেন কোথায়, নকলনবিস বা প্রতিলেখক (কপিস্ট) একটা স্বীকৃত দরকারি পেশাও বটে।
মানুষ বৃক্ষেরও নকল করে বানায় কলম, বনসাই, জিএম ফুড। পরীক্ষাগারে প্রাণীরও নকল/ক্লোন হয়। মানুষ নিজেও নকল হয়? কেন নয়। যে ব্যক্তি কথায় কথায় রঙ বদলায়, যার চরিত্র বুঝা যায় না, তাকে বলি নকল মানুষ। সুতরাং বস্তুগত এবং অবস্তুগত উভয়েরই নকল হতে পারে।
অন্যের কণ্ঠস্বর বা ঘটনা নকল করলে হয় কৌতুক, অন্যের লেখালেখি নকল করলে হয় প্লেজারিজম। আধুনিক সভ্যতায় এটি একটি ব্যাপক নিত্যনৈমিত্তিক, অথচ অপরাধমূলক কাজ।
চলবে-