দাম্পত্য ও পারিবারিক কলহে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
সর্বোত্তম ব্যয় হলো আপন পরিবারের জন্য যেটি ব্যয় করলে
ইসলাম একজন ব্যক্তির দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে। পরিবারের ভরণপোষণ ও সুখ-শান্তি নিশ্চিত করাকে ইবাদত হিসেবে বিবেচনা করে। পরিবারের জন্য ব্যয়কে সদকা শুধু নয় বরং সর্বোত্তম ব্যয় হিসেবে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি পয়সা তুমি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, একটি পয়সা দাসমুক্ত কাজে এবং একটি পয়সা আপন পরিবারের জন্য খরচ করলে- এর মধ্যে সর্বোত্তম ব্যয় হলো আপন পরিবারের জন্য যেটি ব্যয় করলে।
পারিবারিক জীবনে সুখ-শান্তি সকলের জীবনে কামনা-বাসনা। আল্লাহপাক দোয়াও শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘পরোয়ারদেগার! স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা আমাদের চোখকে শীতল করে দাও এবং আমাদের করে দাও মুত্তাকিদের ইমাম’- সুরা ফুরকান ৭৪। দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনে প্রশান্তি দুনিয়ার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। যারা এই প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত তারা হতভাগা এবং দুনিয়ার জীবন হয়ে উঠে নিরানন্দের ও বেঁচে থাকার আগ্রহও অনেক সময় হারিয়ে ফেলে।
দুনিয়ার জীবন একটি পরীক্ষাগার। পরীক্ষা ছাড়া আল্লাহপাক কাউকে পুরস্কৃত করবেন না। নানাভাবে পরীক্ষা আসবে। ভয়-বিপদ-অনশন, জানমালের ক্ষতি, রোগব্যাধি নানা প্রক্রিয়ায়। স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মাধ্যমেও আসতে পারে। স্বামী/স্ত্রী ও আদরের সন্তান সবসময় চোখ শীতলকারী হয় না; বরং অনেক সময় দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো। আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু’- সুরা তাগাবুন ১৪।
আল্লাহপাক শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। মানুষ সাধারণত স্বামী/স্ত্রী এবং সন্তানের মায়ায় বড় কাতর থাকে। তাদের মনোরঞ্জন ও সুখ-শান্তির জন্য মানুষ প্রায়ই হারাম- হালাল বিবেচনা না করে সম্পদের পেছনে ছুটে। অনেক সময় স্ত্রী তার স্বামীর হালাল উপার্জনে সন্তুষ্ট না থেকে অন্যদের সাথে তুলনা করে স্বামীর জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে তুলে। এক পর্যায়ে স্বামী অন্য সহকর্মী ও বন্ধুদের মতো অন্যায়ের পথে পা বাড়ায়। আবার অনেক স্বামী আছে যারা স্ত্রীর পর্দা ও ইসলামের পথে চলাটা পছন্দ করে না এবং ঝগড়া-ঝাটি করে স্ত্রীর জীবনটাকে বিষিয়ে তুলে। এমন অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী পরস্পর শত্রুর মতই আচরণ করে। আবার ছেলে-মেয়েও অনেক সময় বাবা-মার তাকওয়া-পরহেজগারি পছন্দ করে না এবং ভোগবিলাসে জীবনটা কাটাতে চায়।
পক্ষান্তরে অনেক বাবা-মাও সন্তানের ন্যায় ও কল্যাণের পথে চলাটা অপছন্দ করে। অনেক পরিবারেই এমনটি রয়েছে। এদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলেছেন তোমাদের শত্রু। স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের কারণে নিজের পরকাল ধ্বংস করা কখনই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পরবর্তী আয়াতে এগুলোকে পরীক্ষার সামগ্রী হিসেবে উল্লেখ করে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি একটি পরীক্ষা। আর কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই আছে বিরাট প্রতিদান’- সুরা তাগাবুন ১৫।
এমতাবস্থায় করণীয় কী? স্বামী/স্ত্রীকে কি পরস্পরকে তালাক দিবে এবং সন্তানদেরকে কি ত্যাজ্য করবে? আল্লাহপাক তা বলছেন না। তিনি বলছেন, তোমরা তাদের থেকে সতর্ক থাকো। অর্থাৎ ওরা যেন আল্লাহর নাফরমানি করার ক্ষেত্রে তোমাদেরকে প্রলুব্ধ না করে এবং অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত না করে। বরং আল্লাহ বলেছেন, আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু। স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানের অন্যায় আচরণ ক্ষমা করার কথা বলেছেন এবং তার বিনিময়ে পাবে আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ। ক্ষমা করার মাধ্যমে সংশোধনের সুযোগ থাকে। পরস্পর যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেয় তাহলে সংশোধনের সকল সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
কমোল ব্যবহারই পারে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সন্তানদের চোখ শীতলকারী হিসেবে গড়ে তুলতে। সন্তানদের সাথে রূঢ় আচরণ তাদের বিপথগামিতার পথে ঠেলে দেয়। তাদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে যাতে তারা তাদের সকল প্রয়োজন ও মনের কথাগুলো শেয়ার করতে পারে। একটি চমৎকার শ্লোগান, ‘শুধু হ্যাঁ বলুন’। হ্যাঁ, কথাটি অনেকাংশেই সত্য। বাচ্চাদের বকাঝকা বা শাসন করে নয়, শুধুই আদর করে যেটা সম্ভব শাসন করে সেটি কখনই সম্ভব নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি হলেও একটি জায়গায় তাদের মধ্যে মিল রয়েছে, সেটি হলো সন্তানের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা। সন্তানের দিকে চেয়ে সহজেই স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের তিক্ততা ভুলে যেতে পারে।
পরিবারে কলহ-বিবাদ আদৌ হবে না, এমনটি নয়। স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা. ও সাহাবিদের জীবনেও ঘটেছে। এটি দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে হবে এবং যে অগ্রসর হয়ে মিটিয়ে ফেলবে সে অগণিত সওয়াবের ভাগিদার হবে। হতে পারে তা হাজার রাকাত নফল নামাজ পড়া ও দিনের পর দিন নফল রোজা রাখার চেয়েও বেশি। আমার ধারণায় পরস্পর আদর করে একটু স্পর্শ করলেই মিটে যায়। মানুষ তো আদর ও ভালোবাসার কাঙাল। তাই একটু আদর ও ভালোবাসা কেউ যদি কাউকে দেয় প্রত্যুত্তরে সেও পাবে।
কুরআনে বর্ণিত কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। লুত আ.-এর স্ত্রী ছিলেন কাফির। সংশোধনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর যখন তার জাতির উপর আল্লাহর গজব নেমে আসলো তখনো লুত আ. তাঁর স্ত্রীকে ত্যাগ করেননি। বরং আল্লাহ তাকে সাথে নেয়ার ক্ষেত্রে না করে দিয়েছেন। হজরত ইব্রাহিম আ.-এর পিতা ছিলেন নমরুদের অনুসারী। সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করার সময়ও সে নমরুদের সঙ্গ ছাড়েনি। কিন্তু ইবরাহিম আ. পিতার জন্য দোয়া করা ত্যাগ করেননি যদিও আল্লাহ না করেছেন। হজরত নুহ আ.-এর ছেলে কেনান পিতার সাথে নৌকায় উঠতে অস্বীকার করে বড় পাহাড়ে আশ্রয় নেয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু যখন সে ডুবে মারা যাচ্ছে পিতৃহৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হলে আল্লাহ না করেন।
হজরত ইউসুফ আ.-এর ভাইগণ তাঁকে কুপে নিক্ষেপ করলেও তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। আছিয়া আ. জালেম ফেরাউনের স্ত্রী। ফেরাউনের আগুনে ভস্মিভূত হয়েছেন। কিন্তু স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা বলেননি। হজরত আইউব আ. দীর্ঘদিন রোগ-ব্যাধিতে জরাজীর্ণ কিন্তু তাঁর স্ত্রী রহিমা স্বামীকে ত্যাগ করেননি। এ-সবই আল্লাহপাক প্রদত্ত উদাহরণ।
আমাদের স্ত্রী নিশ্চয়ই লুত আ.-এর স্ত্রীর মতো কাফির নন, আমাদের স্বামী নিশ্চয়ই ফেরাউনের মতো জালেম নন, আমাদের পিতা নিশ্চয়ই নমরুদের প্রধান পুরোহিত আজরের মতো নয় আবার আমাদের সন্তান কেনানের মতো কাফির নন। আল্লাহপাক যেহেতু স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানকে শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেও ক্ষমাশীল আচরণ করার কথা বলেছেন। আমরা তাঁর হেদায়াত অনুসারে পরস্পরকে ক্ষমা করি। ক্ষমার সংস্কৃতি আমরা শুরু করি নিজ পরিবার থেকে।
আমাদের জীবন খুবই সংকীর্ণ। ৫০/৬০ বা বড়জোর একশ বছর। অথচ মৃত্যুর পরে যে জীবন তা অসীম এবং কোনোভাবেই পরিমাপযোগ্য নয়। আমরা যদি এই দুনিয়ায় ক্ষমা করি তাহলে আল্লাহপাক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে তিনি আখিরাতে ক্ষমা করবেন। আমরা ক্ষমা করি স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে, সন্তানসহ নিজ পরিবার, অফিস-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, সমাজ ও রাষ্ট্রে। কেবলমাত্র ক্ষমা ও উদারতা বয়ে আনতে পারে এই দুনিয়ায় আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বহু আকাঙ্ক্ষিত শান্তি-স্বস্তি ও নিরাপত্তা এবং আখিরাতে আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাতের সুসংবাদ।
আল্লাহপাক আমাদেরকে উদার ও ক্ষমাশীল হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।