আত্মোন্নয়ন বলতে আসলে কি বুঝায়!
আত্মোন্নয়ন মানে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভের লক্ষ্যে নিজেকে গড়ে তোলা
একজন মুসলিম হিসেবে আত্মোন্নয়ন বলতে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভের লক্ষ্যে নিজেকে গড়ে তোলা বুঝে থাকি। ইসলামে যেমন বৈরাগ্যবাদ নেই, তেমনি নিরেট দুনিয়াপুজারী স্বার্থপরতাও নেই। ইসলাম মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী একটি দ্বীন। দুনিয়ায় ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত ও ক্ষমতায় বড় হওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামে কোনো বাধা নেই। তবে অবশ্যই তা নীতি-নৈতিকতা ও আল্লাহর বিধানের সীমারেখার মধ্যে হতে হবে।
ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, মনিব-ভৃত্য, মালিক-শ্রমিক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত ও নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই এবং কোনো কিছুর মাঝে শ্রেষ্ঠত্বও নেই, শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে কেবল তাকওয়ায়; যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে সেই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদান। হাবশী গোলাম হযরত বেলাল (রা)ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খলিফা হযরত ওছমান গণি (রা)-এর মধ্যে মর্যাদায় কোনো পার্থক্য ছিল না। মি’রাজ থেকে ফিরে এসে রসূল (সা) বলেন, জান্নাতে বিলালের পদধ্বনি শুনতে পেলাম।
আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের তাঁর কাছে প্রার্থনার ভাষা শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘হে আমাদের রব! তুমি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দান করো’। দুনিয়ায় কল্যাণ (ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মান-ইজ্জত) লাভের লক্ষ্যে যে কর্মপ্রচেষ্টা তা দ্বীনেরই অংশ। ফরজ নামাযান্তে রুজির জন্য বেরিয়ে পড়ো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো। নামায নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণ এবং আল্লাহরই বাণী, যখন আযান হয় তখন বেচাকেনা বন্ধ করে আল্লাহর স্মরণের (সালাতের) দিকে দৌড়ে যাও। বোঝা যায়, নামায ও নামাযের বাইরের যিন্দেগী উভয়ক্ষেত্রেই আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। উভয় অবস্থায় যে আল্লাহকে স্মরণ করে সেই যথার্থ মুসলিম।
আজ আমরা এক দুর্ভাগা জাতিতে পরিণত হয়েছি। অতীত যুগের গজবপ্রাপ্ত জাতির মতো আমরা আমদের কর্মময় জীবন থেকে ধর্মকে পৃথক করে নিয়েছি। তাই একজন সাধারণ মানুষ থেকে নেতা-নেত্রী সবাই অনর্গল মিথ্যা বলে, আমাদের অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য কোথাও ন্যায়-নীতি ও ইনসাফের লেশ নেই। আমরা যে একটি বিশ্বাসী জাতি তা ভুলেই গেছি। পরকালে বিশ্বাসবিবর্জিত একজন নিরেট নাস্তিক যা করে একজন বিশ্বাসী হয়ে আমরাও তাই করি।
প্রত্যেকে তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য নিজেকে অপরিহার্য মনে করে। সে বলতে চায়- পরিবার, সমাজ ও দেশের স্বর্থে ভালো-মন্দ একটু করতেই হয়। সব অপকর্মের পেছনে তারা যুক্তি খোঁজে। ভোট ডাকাতিতে সহায়তা করে তারা বলে, দেশের স্বার্থেই এমনটি করতে হয়েছে। তাদের যুক্তি- বুড়ো বাবা-মা ও গরীব আত্মীয়-স্বজনের প্রয়োজনে একটু বাড়তি আয় করা লাগে; গ্রামের মসজিদ-মাদ্রাসা-ইয়াতিমখানা আমার দানে চলে, নিজের বেতনের টাকায় কি আর সব সম্ভব? সামাজিক মর্যাদার দিকে খেয়াল রেখে ছেলে-মেয়েদের আর ফ্রি পাইমারিতে পড়াতে পারি না; বাধ্য হয়েছি তাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও দামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দিতে, বুঝেনই তো বেতনের পয়সায় কি আর এতো কিছু সম্ভব?
আল্লাহ বলেন, সন্তান-সন্ততি একটি পরীক্ষা। যে ব্যক্তি সন্তানের দোহাই দিয়ে দুর্নীতি করে সে মূলত পরীক্ষায় ফেল করে এবং আত্মীয়-স্বজন বা সমাজকে দেখিয়ে যে অন্যায় করে সে মূলত নিজেকেই ধ্বংস করে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সাথে সাথে সবকিছু তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আল্লাহর আদালতে প্রত্যেকে তার নিজ আমলনামা নিয়ে উত্থিত হবে, সেখানে কোনো সাহায্যকারী বা সুপারিশকারী থাকবে না। এমন কি সেদিন স্বামী/স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তান, নেতা ও কর্মী পরস্পর থেকে পালাবে। না জানি, কে কার বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে অভিযোগ দায়ের করে।
পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের খেদমত, মসজিদ-মাদ্রাসায় দান বা সমাজের কল্যাণে ব্যয় করাকে নিরুৎসাহিত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বক্তব্য, অবৈধ উপার্জনের অর্থ অপবিত্র এবং আল্লাহ ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। হারাম পথে উপার্জিত সম্পদ কল্যাণকর কাজে ব্যয়ে কোনো ছওয়াব নেই। হালাল উপার্জনের অর্থ যতো ক্ষুদ্রই হোক সেটি আল্লাহর কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করে এবং সেই দানকে তিনি বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। মানুষ হালাল পথে যা আয় করে তা তার নিজের ও পরিবারের জন্যই শুধু নয়, সেখানে হক রয়েছে তার আত্মীয়-স্বজন, সমাজ ও সর্বোপরি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায়। আল্লাহর রসূল (সা)-এর উক্তি, এক টুকরা খেজুর দিয়ে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো। সব দান-সদকা তখনই আল্লাহপাক কবুল করেন যখন সেটি হয় হালাল উপার্জন দ্বারা।
পৃথিবীতে সম্মান নিয়ে টিকে থাকার লক্ষ্যে সবারই উপার্জনের একটি ব্যবস্থা থাকা জরুরী। ভিক্ষাবৃত্তি অত্যন্ত ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক। আল্লাহর রসূল (সা) বলেছেন, ‘উপরের হাত সব সময় নীচের হাত অপেক্ষা উত্তম’। ওমর (রা) বলতেন, যে কাজ করে না তার খাওয়া অন্যায়। নামায শেষে মসজিদে কাউকে দীর্ঘ সময় বসে থাকা দেখলে তিনি মসজিদ থেকে বের করে দিতেন। রসূলুল্লাহ (সা) কোনো কাজকেই ঘৃণা করতেন না। শ্রমজীবী মানুষ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যে শ্রমিক কর্মক্লান্ত হয়ে নিদ্রা যায় সে তো ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে নিদ্রা যায়’। আমেরিকার জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর ছেলের শিক্ষককে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমার ছেলেকে বুঝতে দিবেন, পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি ডলার কষ্ট করে উপার্জন করা অনেক উত্তম’। দুনিয়ার জীবনে একজন সফল ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলাও ইবাদত।
মু’মিনকে দুনিয়ার জীবনে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি আখিরাতে সাফল্য লাভের জন্য সর্বাগ্যে প্রয়োজন হালাল রুজি, আল্লাহর বান্দাদের সাথে সদাচরণ এবং ইবাদত-বন্দেগীতে আন্তরিক হওয়া। আত্মোন্নয়ন বলতে আমি উভয়বিদ যোগ্যতা অর্জনকে বুঝিয়েছি। দুর্ভাগ্য, আমরা দুনিয়ার জীবন ও আখিরাতের জীবনের মধ্যে একটি বিভক্তি টেনে দিয়েছি। দুনিয়ার জীবনে ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মান-ইজ্জত-সম্মান অর্জনের ক্ষেত্রে ধর্মকে বাধা মনে করে আমরা ধর্মের বিধি-বিধান অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায় ও হালাল-হারাম মানতে অপরাগতা প্রকাশ করি।
একজন অমুসলিমের কাছে ধর্মের যে আবেদন ধর্মনিরপেক্ষ একজন মুসলিমের কাছেও একই আবেদন। ধর্মকে তারা ব্যবহারিক বা কর্মজীবনে মানতে রাজি নয়। এরা শুকরের মাংস না খাওয়ার ক্ষেত্রে যতখানি সিরিয়াস অফিসে ঘুষ খাওয়া, ওজনে কম দেয়া ও ভেজাল দেয়ায় ততখানি সিরিয়াস নয়। জু’মুআর দিনে উপচেয়ে পড়া মুছল্লি এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে বিশেষ করে ফজর ও এশার জামাতে মুছল্লির স্বল্পতার পেছনে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতা ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিই মূলত দায়ী।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যে নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটে সেটি দিয়েই কেবল সম্ভব দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন। আমিন।