নবদম্পতিদের উদ্দেশ্যে

আমাদের ছেলেরা হোক বৌ পাগল এবং মেয়েরা হোক পতিপরায়ণা (স্বামী পাগল)

বিশেষ দ্রষ্টব্য
  • দেশে দাম্পত্যকলহ ও তালাকের হিড়িক পড়ে গেছে, একটি মুসলিম সমাজে যা কখনই কাম্য নয়। এটি একটি সামাজিক সমস্যা। সামাজিক সমস্যাসমূহ সাধারণত আমার দৃষ্টি এড়ায় না। দাম্পত্যজীবন মধুর হোক, এটি আমাদের একান্ত কাম্য। এটি শুধু তরুণদের নয়, আমাদের মতো বুড়োদেরও দরকার। স্বামী-স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে আমাদের জীবন আনন্দে ভরে উঠুক - আল্লাহ তায়ালার দরবারে সেটিই আমাদের প্রার্থনা।

আল্লাহপাক প্রতিটি জীবকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। নর ও নারী পরস্পরের মাঝে দিয়ে রেখেছেন আকর্ষণ। তাইতো সৃষ্টির আদি থেকে তারা জুটি বেঁধে চলার চেষ্টা করেছে, এবং তা অব্যাহত রয়েছে। যিনা, ব্যাভিচার ও ধর্ষণের মূলে রয়েছে বিপরিত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ প্রকৃতিগত, জোর করে দমিয়ে রাখা বা অস্বীকার করা কোনোটাই ইসলাম সমর্থন করে না।

মানুষের জীবনের অনেক দিকের মধ্যে যৌনজীবন অন্যতম। বিবাহের মাধ্যমে ইসলাম যৌনজীবনকে সুশৃঙ্খল করেছে। যৌন চাহিদা পূরণের একমাত্র উপায় হিসেবে বিবাহকে নির্ধারণ করেছে। বিবাহ বহির্ভূত যৌনজীবন তা হোক কথা, আচরণ, অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যা যৌনপীড়ন বা যিনা-ব্যাভিচার, ধর্ষণ সবই হারাম, ঘৃণিত ও নিন্দনীয়। বিবাহের মাধ্যমে যে জীবন (স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে আনন্দ দানের জন্য সকল কথা-বার্তা, আচরণ, খুনসুটি, দৈহিক মিলন সবই) তা পবিত্র ও প্রশংসিত ও সওয়াব হিসেবে বিবেচিত।

ইসলাম বিবাহের মাধ্যমে নারী-পুরুষের দাম্পত্যজীবনকে খুব সম্মান-মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে। দাম্পত্যজীবন অর্থ হলো স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মধ্যে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা ও পরস্পরের প্রতি দায়িত্বপালন। দাম্পত্যজীবন ও পারিবারিক জীবনে সুখী হতে হলে উভয়েরই দায়িত্বপূর্ণ আচরণ দরকার। বিবাহের মাধ্যমে যে জীবন তা শুধু দু’জন নর ও নারীর মাঝে সম্পর্ক নয়, সম্পর্ক দু’টি পরিবারের। পরস্পরের পিতা-মাতা (শ্বশুর-শাশুড়ি) ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ পারিবারিক জীবনে শান্তি ও স্বস্তি দান করে। অভিভাবকরা নবদম্পতির মাঝে আনন্দ-স্ফূর্তি ও স্বতস্ফূর্ততা দেখতে চায় এবং তাদের আনন্দ অভিভাবকদের চোখকে শীতল করে।

দু’টি ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা। বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে ভিন্ন পরিবেশে একাত্ম হতে একটু সময় লাগারই কথা। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের আন্তরিক সহযোগিতায় খুব দ্রুতই তা কেটে যায়। স্বামী-স্ত্রীর প্রকৃতিতে আল্লাহপাক পরস্পরের মাঝে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা ঢেলে দেন। তারা দ্রুত আত্মার আত্মীয় ও সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে যায়। প্রকৃতিতে দেয়ার পরও শরীয়ত তাগিদ দেয় স্বামী-স্ত্রী একে-অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসার প্রতি। আল্লাহর রসুল সা.-এর জীবন থেকে আমরা সে শিক্ষাই পাই। তিনি তাঁর স্ত্রীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্ববান ও গভীরভাবে তাঁদেরকে ভালোবাসতেন।

স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা শুধু অন্তরের নয়। কথা ও আচরণেও তার প্রকাশ দরকার। দাম্পত্যজীবনের বিষয়টি একান্ত গোপনীয়। তারপরও উম্মাহর জন্য অনুসরণীয় হিসেবে তাও প্রকাশ করা হয়েছে। আয়িশা রা. গ্লাসের যেখানে ঠোঁট লাগিয়ে পানি খেতেন অনেক সময় আল্লাহর রসুল সা. তাই করতেন। আবার একটি হাড়ের যেখানে কামড় দিয়েছেন হাতে নিয়ে তিনি সেখানে কামড় দিয়েছেন। এসবই করেছেন তাকে যে ভালোবাসেন তার বহিপ্রকাশ হিসেবে।

স্ত্রীর প্রতি সদাচরণের নির্দেশ প্রদান করে রসুল সা. বলেছেনঃ ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম’। আবার বলেছেন, আখেরাতে স্বামীর ব্যাপারে স্ত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি নারীর ব্যাপারেও বলেছেন। যে নারী আল্লাহর হক পালনের পাশাপাশি স্বামীর প্রতিও দায়িত্ব পালন করে ও যার ওপর স্বামী সন্তুষ্ট থাকে। জান্নাতের যে দরজা দিয়ে খুশি সে প্রবেশ করতে পারবে। আবার ভয়ও দেখিয়েছেন এই বলে যে জাহান্নামে অধিকাংশ দেখলাম নারী এবং তার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি দায়ী করেছেন পর্দাহীনতা ও স্বামীর প্রতি অবাধ্যচরণকে।

আমি আমার লেখার শিরোনাম করেছি। আমাদের ছেলেরা হোক বৌপাগল অর্থাৎ তারা গভীরভাবে তাদের স্ত্রীদেরকে ভালোবাসুক। সাথে সাথে মেয়েরা হোক পতিপরায়ণা (স্বামী পাগল) অর্থাৎ তারা তাদের স্বামীকে জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করুক। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের পরিপূরক, দুই অর্ধেক মিলে পূর্ণতা (এক)। আমি অনেক সময় নবদম্পতিকে সামনে নিয়েই কথা বলি ও লিখি এবং সাধারণে পোস্ট করি। আজকে সমাজের পরকীয়া, যিনা-ব্যাভিচার ও ধর্ষণের পেছনে দাম্পত্যকলহ অনেকাংশে দায়ী। তাই জীবনের শুরু থেকেই নবদম্পতিকে সজাগ থাকতে হবে। কোনো কথাবার্তা, আচার-আচরণ কখনই যেন এমন না হয় যাতে পার্টনার অনুভব করে, তাকে অবহেলা বা উপেক্ষা করা হচ্ছে। পরস্পরের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা একে-অপরকে কাছে টানে ও পরস্পরের সান্নিধ্য আনন্দ দান করে এবং ভিন্নতা ঘটলে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যায় ও অনৈতিক পথে শান্তি-স্বস্তি খুঁজে। অবশ্য আখেরাতে বিশ্বাসী ও আল্লাহর ভয়ে ভীত ব্যক্তিবর্গ সকল প্রতিকূল অবস্থায় পরম ধৈর্য অবলম্বন করে এবং আল্লাহপাক ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।

বিনোদনের হাজারো উপায় আছে। মানুষ আনন্দ খুঁজে বই পড়ায়, ভ্রমণে, নানাবিধ খেলাধুলা ইত্যাদিতে। আমার মনে হয় সুখী দাম্পত্যজীবন বিনোদনের সর্বোত্তম মাধ্যম। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের সদস্যদের সান্নিধ্যের মাঝে যে তৃপ্তি তা আর কিছুর সাথে তুলনীয় নয়। মহান আল্লাহ তাঁর ভাষায় বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন’- সুরা রুম ২১। ‘প্রশান্তি পাও’, কথাটি বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। হ্যাঁ, বিবাহিত জীবনের মূল লক্ষ্য স্বামী-স্ত্রীর একান্ত জীবন যাপনের মাঝে প্রশান্তি লাভ।

দাম্পত্যজীবনে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শনে ব্যর্থ হওয়া শুধু পারিবারিক জীবন নয় সামাজিক জীবনেও নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। আল্লাহপাক তাঁর নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে সকলকে সুখি দাম্পত্যজীবন উপভোগ এবং অনৈতিক সকল কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

কলামিস্ট এবং সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button