দুঃখ-দারিদ্র্যের অনন্ত ধারা–এজ ইউজুয়াল! (পর্ব- ৩)
দারিদ্র্যে কি সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে? দুর্নীতি কি গরিব অশিক্ষিতদের কাজ?
সংগ্রাম আন্দোলন করেও বৈষম্য কমে না, বরং বাড়ে। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-৯৯) মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমায়নি, সামাজিক সচেতনতা বাড়িয়েছে যদিও। বরং ব্রিটেনে উদ্ভূত শিল্প বিপ্লবের (১৭৬০-১৮৪০) কারণে দারিদ্র্যের প্রকোপ কমে মধ্যবিত্তের সৃষ্টি হয়েছিল। ফ্রী মার্কেট ক্যাপিটালিজমের প্রবক্তা নিউলিবারেলিজমদের দাপটে ১৯৮০-এর পর থেকে বৈষম্যের মাত্রা বাড়তে থাকে।
একদল ধনী হলে অন্যগোষ্ঠী হবে গরিব–এই স্বাভাবিকতাকে যারা অস্বাভাবিক ভাবেন, মেনে নিতে চান না, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়–কেউ নীরব কর্মী, কেউ সরব কর্মবীর। অন্যদিকে কেউ আবার দুরবস্থা জিইয়ে রাখতে চান, লুণ্ঠনের সুবিধার্থে। এটি ব্যক্তি ও বিচ্ছিন্ন পর্যায়ে যেমন, সামষ্টিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তেমনি সত্য।
যতবেশি ধনী, ততবেশি সম্পদ বৃদ্ধির হার। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৫ সালে দৈনিক ব্যয় ১.৯০ মার্কিন ডলার ধরলে সারা বিশ্বে প্রায় ৭০ কোটি লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করছে। করোনা ও যুদ্ধের কারণে খাদ্য ও জ্বালানীমূল্য বাড়ছে বলে মানুষ দরিদ্রতর হচ্ছে, অন্যদিকে এতদ্ব্যবসায়ীদের সম্পদ ফুলেফেঁপে উঠছে। ২০২০-২১ সময়ে মহামারীর দুবছরে ৫৭৩ জন শতকোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে ডলারে।
শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি হয় ধনিক সমাজে, সরকারি অর্থ ও সুবিধাদি হাতিয়ে নেয় ধনিক গোষ্ঠী। সুতরাং ধনী আরো ধনী তো হবেই। দুর্নীতি কি গরিব অশিক্ষিতদের কাজ? দারিদ্র্যে কি সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে? তা-ও নয়, নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতেই ধনকুবের ক্ষমতাশালীগণ স্টেটাসকূ বজায় রাখবে, ‘চুইয়ে পড়া’ মধু খাইয়ে গরিবদের বাঁচিয়ে রাখবে।
দারিদ্র্যসীমা কোনো ব্যক্তির আয়ের একটি সীমারেখা যা ঐ ব্যক্তির জীবনযাপনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মৌলিক দ্রব্যসমূহের খরচের সমষ্টি। বিভিন্ন দেশের দারিদ্র্যসীমা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন, পানি সরবরাহ ও বিদ্যুতের মত ব্যাপারগুলি দারিদ্র্যসীমাতে গণনা করা হয় না বলে এই সূচকটি দিয়ে জনগণের জীবনযাত্রার মান পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়।
ইদানীং বলে দৈনিক মাথাপিছু ২.১৫ ডলার খরচ করতে না পারলেই গরিব কিন্তু শুধু টাকার অঙ্ক দিয়ে দারিদ্র্যসীমা মাপা যায় না বলে আজকাল ব্যবহার করে ‘ক্রয়ক্ষমতা’র মাপকাঠি। সে হিসাবে উপরে লুক্সেমবার্গ, নীচে বুরুন্ডি, বাংলাদেশ ১২৮। জনপ্রতি আয়ের হিসাবে বাংলাদেশ ১৩৮-তম, সর্বোচ্চে-মোনাকো, সর্বনিম্ন-বুরুন্ডি। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের স্থান ১২৯, শিখরে নরওয়ে, তলানীতে নাইজার। ব্যক্তির মতো রাষ্ট্রও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খায়।