আম্মা বলতেন ১৯৪৩ সালের ‘বড় অভাব’-এর কথা, যার মুখ্যকারণ ছিল ঔপনিবেশিক দুঃশাসন। অভাবের কারণ সম্পদহীনতা নয়, সুষম বন্টনহীনতা। ক্ষুধার কারণ খাদ্যাভাব নয়, প্রাপ্তির অধিকারহীনতা। গৃহহীনতার কারণ আবাসের অপর্যাপ্ততা নয়, অলভ্যতা। দারিদ্র্যের কি নৃতাত্তিক কারণও আছে? আফ্রিকায় দারিদ্র্য বেড়েছে কিন্তু এশিয়ায় কমেছে, কেন? আফ্রিকার মানুষ হয়ত জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করে।
পরিশ্রম করলেই দারিদ্র্য দূর হয় না। মানুষ কি দরিদ্র হয় নিজগুণে, নাকি অন্যের কারণে? কে তাকে দরিদ্র বানিয়ে রাখে–নিয়তি প্রকৃতি সমাজ সুযোগ, কার ভূমিকা কতটুকু বুঝা দায়। গ্রাম-শহর, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, এদেশ-ওদেশ ভিন্ন হলে দারিদ্র্যের কারণ ও ধরন বদলায়, দারিদ্র্যের চেহারা সর্বত্র সর্বযুগে একই রয়ে যায়। দারিদ্র্যের ফলশ্রুতিতে কী হয়? শিক্ষাবঞ্চিত হয়, স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে, মানসিক দোর্বল্যে ভোগে, জীবনের আয়ু কমে, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে যায়।
দারিদ্র্য ও প্রাচুর্যের মাঝখানে বসবাস করে বৈষম্য। তথ্য ও পরিসংখ্যান ভয়াবহ, তার চেয়েও ভয়াবহ সত্য ও বাস্তব। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ দরিদ্র এবং অধিকাংশ দেশের শতকরা ১০-২০ ভাগ মানুষ চরম দারিদ্র্যে নিপতিত। পৃথিবীর দুইহাজার অতিধনীর সম্পদ ৪৬০ কোটি দরিদ্রের সমান। ২০০০ সালে পৃথিবীর সম্পদের ৪.৪% ছিল বিলিয়নিয়ারদের হাতে, এখন ১৪% তাদের কব্জায়। নিম্নবিত্তের ৫০% জনগোষ্ঠী কোনোদিন ১০%-এর বেশি সম্পদের মালিক হতে পারেনি। বাংলাদেশেও উপরের ১০% লোকের দখলে আছে জাতীয় আয়ের প্রায় অর্ধেক, অথচ নীচের ১০% লোকের বরাতে মিলে ৪%। অতিধনীর সংখ্যা ও সম্পদ বাড়ছে, অতিদরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে সম্পদ কমছে।
দারিদ্র্য কি নূতন? ইতিহাস বলে মানবজন্মের শুরু থেকেই অভাব: খাদ্যের আশ্রয়ের পরিধেয়ের, আনন্দ বিনোদন ভালবাসারও। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, কথাটা কি সত্য? না। মানুষ অতীতকে স্মৃতিকে শৈশবকে জন্মের উৎসকে ভালবাসে, তাই এসব বলে। আমজনতা মনে করে জনাধিক্যের কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে, পণ্ডিতেরা মনে করে স্বল্পকিছু ব্যক্তির হাতে অর্থ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে দারিদ্র্য বাড়ে। অতীত কিন্তু সেকথা বলে না। জনসংখ্যা ও শাসনব্যবস্থা যা-ই থাক, মানবেতিহাসের অধিকাংশ সময়ে সংখাগরিষ্ঠ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেছে।