ফেসবুকের নজর এখন ভার্চুয়াল দুনিয়ায়
বছরজুড়ে টেকবিশ্বের বিশেষ ঘটনা
বজায় ছিল চিপ সংকট
২০২০ সালে শুরু হওয়া চিপ সংকট এখনো শেষ হয়নি, ফলে এ বছর ক্রেতাদের তালিকা থেকে সর্বশেষ এএমডি প্রসেসর বা গ্রাফিকস কার্ড অনেক ক্ষেত্রেই বাদ পড়েছে। বেশ কিছু প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান নতুন করে পুরনো মডেলের প্রসেসর ও জিপিইউ বাজারে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, যেমন—এনভিডিয়া নতুন করে বিক্রি করছে আরটিএক্স ২০৬০ জিপিইউ এবং কোয়ালকম ফিরিয়ে এনেছে স্ন্যাপড্রাগন ৮৫৫ এবং ৮৬৫ নতুন ৮৬০ এবং ৮৭০ নামে। শুধু ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ পিসিই নয়, গেমিং কনসোল এবং স্মার্টফোনেও পড়েছে চিপ সংকটের চাপ। এর ফলে এ বছর উচ্চক্ষমতার পিসি বা ফোন—কোনোটিই বিক্রির তুঙ্গে ছিল না। এদিকে এএমডি প্রসেসরের ঘাটতির ফলে ইন্টেল আবারও তাদের হারানো বাজারের অনেকটাই ফিরে পেয়েছে, কোয়ালকম প্রসেসরের অবর্তমানে মিডিয়াটেক এবং নতুন ব্র্যান্ড ইউনিসকও বাজার দখলে এগিয়েছে অনেক দূর।
ইন্টেলের ফিরে আসা
গত কয়েক বছরে ইন্টেলের সাফল্য সামান্যই, শুরুতে তারা এএমডির কাছে বাজারের নেতৃত্ব হারায়, এরপর অ্যাপল তাদের ম্যাক থেকে ইন্টেল প্রসেসর বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু নতুন লিডারশিপ এবং রোডম্যাপে ইন্টেল আবারও তাদের অবস্থান ফিরে পেতে শুরু করেছে। তাদের ১২তম প্রজন্মের প্রসেসরগুলো বর্তমান এএমডি প্রসেসরের চেয়ে শক্তিশালী এবং তাদের দাবি, ১২তম প্রজন্মের ল্যাপটপগুলো অ্যাপল প্রসেসরকে পারফরম্যান্সে ছাড়িয়ে যাবে। নতুন প্রসেসরগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে পারফরম্যান্স এবং এফিশিয়েন্সি কোর, ঠিক যেমনটা এআরএম প্রসেসরে দেখা যায়। ইন্টেলের দাবি, এই সিস্টেম ব্যবহারের ফলে ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ দুটিতেই অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় এবং তাপ উৎপাদন কমে আসবে।
নতুন উইন্ডোজের দেখা মিলল
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজের সর্বশেষ সংস্করণ বাজারে এনেছে মাইক্রোসফট। ইউজার ইন্টারফেসে উইন্ডোজ ১০-এর সঙ্গে তেমন বড় পার্থক্য নেই, অ্যাপের দিক থেকেও উইন্ডোজ ১০-এর সঙ্গে এখনো উইন্ডোজ ১১-এর মিল রয়েছে অনেক। তবে আগামী দিনে উইন্ডোজ ১১ নতুন সব ফিচারসমৃদ্ধ হয়ে ১০-এর থেকে বহুগুণ এগিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে মাইক্রোসফট। তবে উইন্ডোজ ১১ খুব সমাদৃত হয়নি, মূলত মাইক্রোসফট নতুন হার্ডওয়্যার ছাড়া সব পুরনো পিসিকে উইন্ডোজ ১১ সমর্থন থেকে বাদ দিয়েছে। এর সঙ্গে বাদ পড়েছে ৩২বিট অপারেটিং সিস্টেম সমর্থন এবং সিকিউরবুট ছাড়া পিসি চালনা। মাইক্রোসফটের দাবি, তারা আগামীর কথা চিন্তা করে পুরনো প্ল্যাটফর্ম সমর্থন বাদ দিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতের সফটওয়্যার বর্তমানের হার্ডওয়্যারকে সমর্থন করার জন্য পিছিয়ে না থাকে।
স্মার্টফোন বাজারে ওলটপালট
বছরের প্রথমার্ধেই ইলেকট্রনিকস নির্মাতা এলজি স্মার্টফোন বাজার থেকে সরে দাঁড়ায়, এরপর অপো ঘোষণা করে ওয়ানপ্লাস ব্র্যান্ডটি আর স্বতন্ত্র থাকছে না। স্মার্টফোন বাজারে এই বড় দুটি নির্মাতার সরে যাওয়া, সঙ্গে মটরোলা এবং নোকিয়ার বড়সড় ব্যাবসায়িক ক্ষতি প্র্রমাণ করে, বাজারটি আর পরীক্ষামূলক নেই, বরং এখন ক্রেতাদের চাহিদা একটি নির্দিষ্ট কাতারের ব্র্যান্ডই মিটিয়ে ফেলছে; পরীক্ষামূলক এবং সবার থেকে আলাদা ফিচারসমৃদ্ধ ফোনের আর স্থান নেই। ওয়ানপ্লাস ফোনগুলোর বিক্রির পরিমাণ এবং লাভের মার্জিন আলাদা করে সেগুলো ডিজাইন এবং সফটওয়্যার সমর্থন দেওয়ার মতো যথেষ্ট নয় বলেই সেটি অপোর মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলা হচ্ছে, আর এলজির অসাধারণ ডিজাইন গ্রাহকদের মনও জয় করতে পারছে না। মজার বিষয়, ২০২১ সালে দেখা গেছে সনি এক্সপেরিয়ার ফিরে আসা। তাদের নতুন ফোনগুলো খুব অল্প পরিমাণ বিশেষায়িত ক্রেতাদের জন্য তৈরি করা হলেও, সেই গ্রাহকরা ফোনটিকে সাদরে গ্রহণ করেছে, ফলে তাদের বিক্রির মাত্রা পূর্ণ হয়েছে সহজেই।
ল্যাপটপের দুনিয়ায় আর্ম প্রযুক্তি
২০২০ সালের শেষের দিকে অ্যাপল তাদের নিজস্ব ডিজাইনের আর্ম প্রযুক্তির প্রসেসরসমৃদ্ধ দুটি ল্যাপটপ ও একটি ডেস্কটপ বাজারে বিক্রি শুরু করে। প্রসেসরটির ব্যাটারি সাশ্রয় করেও অত্যন্ত শক্তিশালী পারফরম্যান্স সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। এ বছর অ্যাপল সেই প্রসেসরটির আরো শক্তিশালী দুটি সংস্করণসমৃদ্ধ ল্যাপটপ বাজারে বিক্রি শুরু করেছে। ফলে শক্তিশালী ওয়ার্কস্টেশন ল্যাপটপের ক্রেতারাও উইন্ডোজ ফেলে ম্যাকের দিকে ঝুঁকছে। আর্ম প্রসেসরসমৃদ্ধ ম্যাকগুলোর সফলতা দেখে মাইক্রোসফট ও অন্য নির্মাতারাও আর্ম ল্যাপটপ এবং আর্ম উইন্ডোজ ট্যাবলেটের দিকে নতুন করে নজর দিচ্ছে, যা গত আট বছরেও দেখা যায়নি। আগামী দিনে ইন্টেল ও এএমডির পাশাপাশি আর্মভিত্তিক ডেস্কটপ ও ল্যাপটপও যদি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে, সেই পরিবর্তনের কারণ আজকের অ্যাপলই।
ফেসবুকের ‘মেটা’
শুধু ওয়েবসাইট নয় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সেবা নয়—ফেসবুক নিজেদের ‘মেটাভার্স’-এর জনক হিসেবে দেখতে চায় বলে ঘোষণা করেছে এ বছর। ভার্চুয়াল এই দুনিয়ায় ব্যবহারকারী কাজ, বিনোদন, যোগাযোগ থেকে শুরু করে সবই করতে পারবে, তারই স্বপ্ন দেখছে ফেসবুক। তারা নিজেদের নামও বদলে ‘মেটা’ করে ফেলেছে এর মধ্যেই। অকিউলাস হেডসেট পরে ব্যবহারকারী প্রবেশ করবে মেটাভার্সে, আর সেখানে ব্যবহারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করবে অন্যান্য ব্যবহারকারী, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তার অফিসও মেটাভার্সের একটি রুমে পরিণত হবে। তবে মেটাভার্সের চেয়ে ফেসবুক তাদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযোগ থেকে নিস্তার পেতেই নাম বদল করেছে, এমনটাই ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা।
এনএফটি, ব্লকচেইন এবং ওয়েব৩
ব্লকচেইন প্রযুক্তির বড়সড় দুটি ফল ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং এনএফটি। ক্রিপ্টো নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, বছরজুড়ে ক্রেতারা নানাবিধ কয়েনে তাদের সঞ্চয় খোয়ানোর খবর গণমাধ্যমে স্থান করে নিয়েছে। ক্রিপ্টো মাইনিংয়ের ফলে ব্যাহত হয়েছে গ্রাফিকস কার্ডের বাজার, এমনকি বড়সড় শিপমেন্ট চুরির ঘটনাও ঘটেছে। তবে এনএফটির উল্টো, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠছে দ্রুতই। ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল পণ্যের মালিকানাও করা হয়েছে নিশ্চিত, ফলে ডিজিটাল পণ্য এনএফটি আকারে চড়া মূল্যে সংগ্রহ করেছে অনেক ক্রেতা। বলা যায়, আর্ট, অ্যান্টিক বা অন্যান্য নিলামের চেয়েও এনএনফটি নিলামে আগ্রহের পরিমাণ বর্তমানে অনেক বেশি। ভবিষ্যতে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেটে অন্যান্য সেবাও দেওয়ার কথা ভাবছে সেবাদানকারীরা, ফলে তাদের আর সার্ভারের ওপর নির্ভর করতে হবে না। ইন্টারনেটের এ বিকেন্দ্রীকরণকেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘ওয়েব৩’ প্রযুক্তি, আগামী দিনে যার দেখা পাওয়া যাবে দ্রুতই।
নতুন সুপার টেলিস্কোপের যাত্রা
মহাকাশের অসাধারণ সব ছবি কয়েক দশক ধরে আমাদের উপহার দিয়েছে হাবল টেলিস্কোপ। পৃৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত এই বিশাল টেলিস্কোপকে বলা যায় একটি শক্তিশালী ক্যামেরা, যার কাজ অনবরত সব কিছুকে পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করে যাওয়া। এবার হাবলের বদলে আরো শক্তিশালী একটি টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করবে নাসা, যার নাম জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। ২৪ ডিসেম্বর টেলিস্কোপটি মহাশূন্যের উদ্দেশে যাত্রা করে। নতুন টেলিস্কোপটির মূল দর্পণ ২১ ফুট চওড়া, যা হাবলের সাত ফুটের চেয়ে তিন গুণ বড়। ক্ষেত্রফল এবং নতুন ক্যামেরা প্রযুক্তির কল্যাণে হাবলের চেয়ে তিন গুণ নয়, বরং ৯ থেকে ১০ গুণ বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হতে যাচ্ছে এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। আগামী কয়েক দশকে নতুন সব আবিষ্কারের সঙ্গে এই যন্ত্রটির নাম দেখা যাবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস এটির নির্মাতা বিজ্ঞানীদের।
গুগলের প্রথম নিজস্ব প্রসেসর
অবশেষে গুগল তাদের নিজস্ব ডিজাইনের প্রসেসর ব্যবহার করে তৈরি করেছে দুটি স্মার্টফোন। পিক্সেল ৬ এবং ৬ প্রো ফোন দুটিতে তাদের টেনসর প্রসেসরের দেখা মিলেছে। স্যামসাং এক্সিনস সিরিজের একটি প্রসেসর ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি টেনসরের মূল ক্ষমতা গেমিং বা মাল্টিটাস্কিং নয়, বরং ক্যামেরার ছবি আরো দ্রুত প্রসেস করতে পারা। পিক্সেল ফোনে এবারই প্রথম ৫০ মেগাপিক্সেল সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ ছবির তথ্য মুহূর্তেই লাইভ প্রসেস করার জন্য টেনসর প্রসেসরটি বিশেষভাবে ডিজাইন করেছে গুগল। সামনের পিক্সেলগুলোতেও গুগলের প্রসেসর দেখা যাবে।
ফোল্ডেবল ফোনের বাজার বেড়েছে
শুরুতে ভাঁজযোগ্য ডিসপ্লের ফোন ছিল বলা যায় শুধু প্রযুক্তি অনুরাগীদের জন্য তৈরি বিশেষায়িত ডিভাইস। এ বছর সেটি বদলে গেছে, উল্টো বছরে সর্বাধিক বিক্রীত ফোনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ‘গ্যালাক্সি জি ফোল্ড৩’। এ বছর নির্মাতা টিসিএলও একটি পরীক্ষামূলক ভাঁজযোগ্য ডিসপ্লের ফোন দেখিয়েছে, যদিও সেটি বাজারে আসেনি। শাওমিরও একটি ফোল্ডিং মডেল মি মিক্স আলফা বাজারে এসেছে এ বছরই। চীনা নির্মাতা অপো বছরের একেবারে শেষে তাদের ফোল্ডিং ফোন ফাইন্ড এন উন্মোচন করেছে, বেশির ভাগ প্রযুক্তি অনুরাগীরাই বলেছেন, অপোর ডিভাইসটির মূল্য ও ডিজাইন তাদের ভালো লেগেছে। আগামী দিনে ভাঁজযোগ্য ডিসপ্লের ফোন বাজারে আরো নিজের স্থান শক্ত করবে সন্দেহ নেই।
ট্যাবলেট নিয়ে গুগল ও মাইক্রোসফটের অগ্রগতি
বলা যায় গুগল ট্যাবলেট বাজার এক প্রকার অ্যাপলের হাতে ছেড়েই দিয়েছিল বিগত বছরগুলোতে। এ বছর হঠাৎ করেই গুগল অ্যানড্রয়েডের একটি ট্যাবলেট ও বড় ডিসপ্লের জন্য বিশেষায়িত সংস্করণ নিয়ে কাজ শুরু করেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে অ্যানড্রয়েড ১২এল। ক্রোম ওএসের পাশাপাশি আগামী দিনে গুগল আবারও অ্যানড্রয়েডভিত্তিক ট্যাবলেট তৈরি করতে পারে। মাইক্রোসফট চুপিসারে কাজ করে যাচ্ছে আর্ম প্রসেসরে উইন্ডোজ চালানো নিয়ে। তাদের প্রথম আর্ম ট্যাবলেটগুলো ছিল সারফেস আরটি এবং ২, যদিও সেগুকো সফটওয়্যারের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তবে বর্তমানে সারফেস এক্স বাজারে নিজের অবস্থান ভালোই ধরে রেখেছে, যদিও পারফরম্যান্সে আইপ্যাড প্রো এর চেয়ে রয়েছে অনেক পিছিয়ে। কিন্তু উইন্ডোজ ১১-এর ট্যাবলেটকেন্দ্রিক ফিচার, বর্তমান ইন্টেল অ্যাপ আর্মে সমর্থনের সিস্টেম দেখে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনের আর্মভিত্তিক সারফেস ট্যাবলেট আইপ্যাডকে টেক্কা দিতেও পারে।