মিশরীয়দের দাফন কাজ, ভিন্নতা রয়েছে বেশকিছু পদ্ধতিতে
আফছার হোসাইন কায়রো ,মিশর থেকে।
দীর্ঘ দিন মিশরে বসবাস করার সুবাদে বেশ কজন সহকর্মীর মৃত্যুর পর তাদের জানাজা ও দাফনে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এ দেশে মুসলিমদের জানাজার নামাজ আমাদের দেশের মত (ইসলামিক রীতি অনুযায়ী ) আদায় করলেও দাফন করা হয় একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে।
মিশরীয়রা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করার পর তাদের লাশ হাসপাতাল থেকেই গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে যথাসম্ভব খুব দ্রুত কাছের কোন মসজিদে জানাজার নামাজ আদায় করে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় তাদের পরকালের বাড়িতে (?) হাঁ, প্রত্যেকটি মিশরীয় পরিবারের দুটি করে বাড়ি থাকে (!), একটি ইহকালের আরেকটি পরকালের।
আফ্রিকার বৃহত্তম শহর কায়রোর বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে ডেড সিটি নামের এক মৃতপুরী বা শহর। আর সেই শহরেই প্রতিটি মিশরীয় পরিবার কিনে রেখেছেন এক বা দুই রুমের একটি করে পরজগতের বাড়ি।
ডেড সিটি ঘুরে দেখা যায় পরজগতের কোন কোন বাড়ির নিছে (আন্ডার গ্রাউন্ড) লাশ দাফন আর উপরে স্বাভাবিক জীবনে বসবাস করছেন বাস্তহারা কোন একটি পরিবার। আবার কোন কোন বাড়ি খালি থাকলেও রমজান, ঈদ কিংবা মৃত বেক্তির মৃত্যু বার্ষিকীতে দুই তিন দিন পর্যন্ত বসবাস করেন পরিবার সদস্যরা।
প্রাচীন মিশরীয়দের মৃত্যুর পর লাশ মমি করে রাখা হত সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী তাদের সমাধী ক্ষেত্রে। যেমন ফেরাউনদের লাশ রাখা হত পিড়ামিড ও লাক্সোর রাজ্যের নীলনদের রাজ/ রানী উপত্যকায়। আর সাধারণ মিশরীয়দের লাশ দাফন করা হত আধুনিক মিশরের কবরস্থান গুলোর মত সমাধীক্ষেত্রে।
আমি আমার মিশরীয় দুই সহকর্মীর দাফনে সরাসরি তাদের পরজগতের বাড়ীতে ঢুকেছি লাশের সাথে।
প্রতিটি বাড়ির (কবর) মাঠির নিছে দুটি করে রুম বা চেম্বার থাকে। একটি পুরুষদের জন্য অন্যটি মহিলাদের জন্য। অর্থাৎ বাবা, দাদা, বড় দাদা, বড় বাবা সহ তাদের পূর্ব পুরুষরা চির নিদ্রায় শায়ীত থাকে ডান পাশের রুমটিতে। আর মা, দাদি, বড় দাদী সহ সেই পরিবারের মৃত মহিলারা বাম পাশের রুমটিতে।
কোন পরিবারের সদস্য মৃত্যুবরণ করার পর পরেই সেই পরিবারের দু’তিন জন চলে যান পরজগতের বাড়ির নিছে (কবর) প্রবেশ পথের সিঁড়ির পাঠাতন সরিয়ে ভিতরে থাকা গ্যাস বা দুর্গন্ধ বাহির করতে। অনান্য সদস্যরা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে নামাজে জানাজা পড়ে লাশ নিয়ে যান দাফন করতে।
আমি আগেই বলেছি, দুটি পরিবারের কবরের ভিতর আমি ঢুকেছি এবং দুজনকে দুই ভাবে সমাহিত করতে দেখিছি। ১ম জনের লাশ নিয়ে বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে নিছে নামার পর একটি গুহার ভিতর একজন আলেম ঢুকলেন। সেই গুহায় থাকা পূর্বের মৃত্যুবরণ কারী লাশের হাঁড়গুর এক পাশে রেখে ইশারা দিলেন লাশটি ধাক্কা দিয়ে প্রবেশ করানোর জন্য। চার বা ছয়জন লাশ বহনকারী লোক কফিনটিকে ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিলে ভিতরে থাকা সেই আলেম বেক্তি লাশটিকে কেবলা মুখী নিশ্চিত করে বেরিয়ে আসলেন গুহা থেকে। একটি পাথরের স্লেভ ও সিমেন্ট দিয়ে গুহার মুখ বন্ধ করে সবাই উঠে আসলাম উপরে। সিঁড়ি দিয়ে নিছে ঢুকার প্রবেশ পথটিও পাথরের কয়েকটি পাঠাতন ও সিমেন্ট বালি দিয়ে সিল করে দেওয়া হল। সবাই মৃত্যু বেক্তির জন্য দোয়া করে চলে এলাম নিজ নিজ আবাসস্থলে।
২য় দাফনটি ছিল একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে, সহকর্মীর লাশবাহী গাড়ীর পিছনে দুতাবাসের একটি গাড়ি করে গেলাম মৃত্যুপূরীর তার পরিবারিক কবরস্থানে। পিড়ামিড আকারের একটি কবরের ভিতর টুকলাম কফিনের পিছনে। মেঝেতে দেখলাম সাহারা মরুভূমির মুঠা বালির স্তর। ঢুকেই লক্ষ্য করলাম ডানে ও বামে দেওয়াল বিহীন দু’টি রুম।
ডান পাশের রুমটিতে পাঁচটি ধবধবে সাদা কফিন। আর বাম পাশে রাখা আছে কয়েকটি কফিন। সহকর্মীর মৃত্যু আগে এই পরিবারের মৃত্যুবরণকারী সদস্যদের কফিন এগুলো। কাফনের কাপর দেখে মনে হচ্ছিল এই মাত্র বোধহয় এদেরকে রাখা হয়েছে এখানে। কাফনের ভিতরে লাশের কি অবস্থা এক মাত্র আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন ই জানেন।
আমার সহকর্মীর কফিনটি ডান পাশে তার পিতা, দাদা সহ শতশত বছরের পূর্বপুরুষদের সাথে রেখে বেড়িয়ে আসলাম উপরে। এখানেও পাথরের পাঠাতন বসিয়ে সিমেন্ট বালির প্রলেপ দিয়ে বন্ধ করে করে দেওয়া হল সিঁড়ি। যতদিন না অন্য কেউ মৃত্যুবরণ করবে এই পরিবারের। আমরা সবাই দোয়া করে চলে এলাম নিজ বাড়িতে।
পরিবারের সদস্যরা জানালেন তিন দিন তার স্ত্রী, ছেলে মেয়ে আর আত্মীয় স্বজন সকাল বিকাল আসবে এখানে। দোয়া কালাম পড়বে ও কিছু সময় কাটাবে তার আপন জনের সান্নিধ্যে। আর তাদের ইহকালের বাড়ির সামনে সামিয়ানা টানিয়ে শোক (আযযা) প্রকাশ করবে এবং একজন ক্বারী সাহেব মধুর সুরে তিলাওয়াত করবেন পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে। এখানেও থাকে সামাজিক এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। কার আযযায় কত লোক হল, কে কত বড় ও ফেমাস ক্বারী আনলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।