প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে এখন কনটেন্টের গুণগত মানে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে বলে বলছেন নীতি-নির্ধারক ও বিশ্লেষকরা ।
শনিবার রাজধানীর গুলশানে রবির প্রধান কার্যালয়ে রবি আয়োজিত ‘প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ বিষয়টি উঠে আসে।
সভায় আলোচক ছিলেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, দেশের প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম টেকশহর ডটকম এর সম্পাদক মুহম্মদ খান, টেলিকম রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি)-এর সভাপতি রাশেদ মেহেদী, বিজয় ডিজিটালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন জুঁই ।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিটিআরসির সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ।
রবির চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলমের সঞ্চালনায় এই সভায় আরও বক্তব্য রাখেন রবির ভারপ্রাপ্ত সিইও রিয়াজ রশীদ এবং রবির চিফ কমার্শিয়াল অফিসার শিহাব আহমদ ।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, বাংলার ব্যবহারকে আরও এগিয়ে নিতে বাংলায় গুণগত কনটেন্ট নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ভাষা নদীর মতো বহমান। ভাষার কিছু অপব্যবহার সত্ত্বেও প্রবাহমান নদীর মতো বাংলা আপন গতিতে প্রবাহমান থাকবে। এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তরুণ প্রজন্মকে সংশ্লিষ্ট করে প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাষার অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারের ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পে’র আওতায় ১৬টি টুলস উন্নয়নের কাজ চলছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, শুধু ভাষাকে নয়, বাংলার বর্ণমালাকেও ভালবাসতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশই বাংলার রাজধানী। বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এ দেশের মানুষকেই কাজ করতে হবে।
ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার প্রবর্তক মোস্তাফা জব্বার বলেন, বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের আগে ডিজিটাল যন্ত্রে বিজ্ঞানসম্মত বাংলা লেখার কোনো উপায়ই ছিলনা।
তিনি বলেন, এই সফটওয়্যারে ৪৫৪ বর্ণকে মাত্র ২৬টি বোতামে নিয়ে আসা হয়েছে। অবস্থা এমন ছিলো যে, মেকিন্টোস কম্পিউটারে এসেম্বলি ভাষায় বাংলা সফটওয়্যারের প্রোগ্রামিং করার লোক ছিলনা দেশে। ভারতের দেবেন্দ্র যোশিকে দিয়ে একটি বাংলা সফটওয়্যার তৈরির মাধ্যমে কম্পিউটারে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাংলা ব্যবহারের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৩ সাল এর মধ্যে দেশের প্রায় সকল পত্রিকা এবং বইসহ বিভিন্ন প্রকাশনা বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রকাশনা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে প্রকাশনা ও মুদ্রণ শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়
দেশের প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম টেকশহর ডটকম এর সম্পাদক মুহম্মদ খান বলেন, কনটেন্ট ক্ষেত্রে মান নিয়ে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার যে উপস্থিতি তাতে সন্তুষ্টির মাত্রাটা ৫০ শতাংশের বেশি নয় । তাই এখানে আরও ৫০ শতাংশ কাজ করার বিষয় আছে বলে মনে করেন তিনি।
এক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি আরও সরকারি উদ্যোগ আসবে বলে আশা প্রকাশ করে মুহম্মদ খান বলেন, এখন অনেক বড়ভাবে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার ও কাজ করার সময় এসেছে।
টেকশহর সম্পাদক বলেন, বাংলা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও অনেক কাজ করার রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই নাগরিক সেবা প্লাটফর্মে অনেক ভাষায় যোগাযোগ ও সেবা পাওয়া যায়। এতে প্রবাসীরা নিজ নিজ ভাষায় সহজে যোগাযোগ করতে পারে। দেশগুলোর এসব প্লাটফর্মে যেনো বাংলা ভাষাও থাকে সে বিষয়ে দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
রাশেদ মেহেদী বলেন, ইন্টারনেটে বাংলার পরিভাষাভিত্তিক শব্দভাণ্ডার নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তি-নির্ভর সাহিত্যও প্রযুক্তিতে ভাষার ব্যবহারকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণের জন্য সরকার ১৬টি টুলস উন্নয়নের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে বড় পরিবর্তন আসবে।
মূল প্রবন্ধে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম বলেন, প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার অন্তর্ভূক্তির ফলেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা সম্ভব হয়েছে। জনসংখ্যার বিচারে বাংলা সপ্তম অবস্থানে থাকলেও ইন্টারনেট ব্যবহারে শীর্ষ ৪০টি ভাষার মধ্যে বাংলা ঠাঁই পায়নি। তাই বাংলার মাধ্যমে প্রযুক্তিকে সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে।
তিনি বলেন, মোবাইল আর্থিক সেবা বাংলায় সহজলভ্য হওয়ার কারণেই কিন্তু দেশের আর্থিক অগ্রগতি ত্বরাম্বিত হচ্ছে। প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার যত বাড়বে, ডিজিটাল বিভক্তি তত দূর হবে ।
জেসমিন জুঁই বলেন, শিশুকে প্রথম কিন্তু ‘এ’ শেখানো হয় না, শেখানো হয় ‘অ’। এটা উপলব্ধির ব্যপার। তাই প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহারকে আরও তরাম্বিত করতে সেই উপলদ্ধির জায়গাটা থেকে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, বিজয় ডিজিটালের আওতায় শিশুতোষ উপায়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিশুদের কাছে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তাদের পাঠ্যপুস্তকের পাঠগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। সেই উপস্থাপন বাংলায় বলেই তাদের কাছাকাছি পৌঁছানো গেছে।
শিহাব আহমদ বলেন, বাংলা কনটেন্টে বিনোদন নির্ভরতা থেকে সরে এসে প্রায়োগিক দিকটিতে মনোযোগ দিতে হবে। মানুষ যেন তার নিত্যদিনের প্রয়োজন বাংলা ভাষায় প্রযুক্তির মাধ্যমে সারতে পারেন।
সাহেদ আলম বলেন, তারা হাতে-কলমে বাংলায় কারিগরি শিক্ষা দেয়ার জন্য শিগরির নতুন একটি উদ্যোগ নিচ্ছেন। প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহারকে সহজলভ্য করতে তাদের প্রচেষ্টা অব্যহত থাকবে।
আলোচনা সভার সমাপনী বক্তব্যে রিয়াজ রশীদ বলেন, প্রযুক্তিতে বাংলাকে এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন মানুষ তা সহজে বুঝতে ও ব্যবহার করতে পারেন।