মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই,
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
সাম্য, প্রেম, দ্রোহ আর মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যিক দোয়া ও ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত মসজিদের মুয়াজ্জিনের আজান তিনি শুনতে থাকবেন। বাংলা ১৩৮৩ সনের ১২ই ভাদ্র মোতাবেক ১৯৭৬ সালের ২৯ আগষ্টে বাংলা ভাষায় বাঙ্গালী মুসলমানের এযাবৎ কালের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সফল কবি, লেখক ও গীতিকারের মৃত্যু হয়, ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
যেখানেই অন্যায়-অবিচার, সেখানেই কবির কলম হয়ে উঠেছিল খাপখোলা তলোয়ার। তিনি আমাদের নজরুল; জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ মোতাবেক ১৮৯৯ সালের এই দিনে পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মের পর দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তার ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া। বাবার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম, মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। তবে নিজের দুঃখ নিয়ে নয়, তিনি জাতির দুঃখ-ক্লেশ, দৈন্য-লজ্জা ঘোচানোর জন্য ভাবতেন সব সময়।
নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহী কবি ছিলেন না, ছিলেন মানবতাবাদীও। তার সাম্য ও মানবতাবাদ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দ্যোতনা সৃষ্টি করে। তার আগে বাংলা কাব্য সাহিত্যে এমন মানবতাবাদ ও সাম্যের বাণী আর কেউ শোনায়নি। তিনি যেন মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে বাংলা সাহিত্য আকাশে উদিত হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের আকাশ যখন পুরোটাই দখল করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই সময় কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। সেই আবির্ভাব পর্বেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ধূমকেতু হতে আসেননি, ধ্রুব তারা হতে এসেছেন এবং ধ্রুব তারা হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাব ও তত্ত্বের জায়গায় প্রেম এবং দ্রোহ, নিগূঢ় দর্শনের জায়গায় সাম্য-মানবতার গান গাইলেন নজরুল। পাকা করে নিলেন বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান; যে স্থান আজ পর্যন্ত কেউ নিতে পারেনি।
ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটক লিখলেও কাজী নজরুল ইসলামের মূল পরিচয় কবি হিসেবে। তিনি প্রায় চার হাজার গান রচনা এবং সুর করেছেন, যা নজরুল সঙ্গীত হিসেবে পরিচিত। বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি ইসলামী সঙ্গীত বা গজলের নতুন এক ধারাও সৃষ্টি করেছেন। বাঙ্গালী হিন্দুর জন্য করেছেন ১৫০০ শ্যামা সঙ্গীত। কাজী নজরুলের রচিত ‘চল চল চল’ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। তিনি ১৯টি রাগের সৃষ্টি করেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, দোলন চাঁপা, ছায়ানট, ইত্যাদি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা তার উপন্যাস। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা ইত্যাদি তার বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ। তিনি সুগায়ক ছিলেন। ‘ধ্রুব’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেন। কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন তার বন্ধু। নজরুল যেমন রবীন্দ্রনাথকে তার বই উৎসর্গ করেছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করেন নজরুলকে।
কোমল আর কঠিনে মেশানো এক অপূর্ব ব্যক্তিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম। প্রেমে পূর্ণ, বেদনায় নীল, আবার প্রতিবাদে ঊর্মি মাতাল। তিনি আমাদের অনন্ত প্রেরণার উৎসও। বাংলার মানুষের সবচেয়ে কাছের, প্রাণের মানুষ তিনি।
মধ্যবয়সে কাজী নজরুল পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হন এবং এক সময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, তাকে ‘একুশে পদকেও’ সম্মানিত করা হয়। এই ক্ষনজন্মা মহাকবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
নজরুল বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন, তা বাস্তবায়নে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। এবি পার্টি বিশ্বাস করে আমাদের কর্ম, চিন্তা ও মননে নজরুলের উপস্থিতি বাঙালি জাতির প্রাণ শক্তিকে চিরকাল জাগরিত রাখবে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনো আপস করেননি। মাথা নত করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত ও বৈভবের কাছে। ‘চির উন্নত মম শির’ বলে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। জাতীয় কবির চেতনা ও আদর্শ চিরস্মরণীয় হয়ে আছে আমাদের জীবনে।