বিএনপি প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরে তবু কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি
দুই দিনের সীমিত কর্মসূচি ঘোষণা
প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরে এসে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি বিএনপি। দলটির ভেতরে-বাইরে আলোচনা হলো, ২০২৩ সালের নির্বাচনে ফল ভালো না করতে পারলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্যও আগামী নির্বাচনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিএনপির ভেতরে-বাইরে আলোচনা চলছে। কারণ ওই নির্বাচনের ফলাফলের ওপরই তাঁর নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও কার্যকারিতা অনেকখানি স্পষ্ট হবে বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় তারেক রহমানের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ফল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি। সরকারের প্রভাব ও হস্তক্ষেপের কথা উঠলেও নির্বাচনে বিএনপির কর্মকৌশলেও ঘাটতি ছিল বলে পরবর্তীকালে দলের মধ্যে নানাভাবে আলোচনা হয়।
তবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, ‘বিএনপির কর্মকৌশল নয়, সরকারের হস্তক্ষেপে রাতের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই বিএনপির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো দেশে গণতন্ত্র পুনর্বহাল এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করা।’ তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ে প্রয়োজন হলে জনগণকে নিয়ে বিএনপি কঠোর আন্দোলন করবে।’
সুধীসমাজের প্রতিনিধি অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর মতে, ‘বিএনপির সামনে একটাই চ্যালেঞ্জ। সেটি হলো, দেশের জনগণের ইচ্ছা ও অনুভূতি অনুধাবন এবং সাহসিকতার সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।’ তিনি বলেন, ‘শুধু একটি রাজনৈতিক দল থাকলেই হয় না, সেই দলকে মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করতে হয় এবং সেই জাগরণ ও শক্তি দিয়েই বিএনপিকে সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করতে হবে।’
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে বিএনপির ভবিষ্যৎ নেই, কিন্তু সে ধরনের নির্বাচন করতে হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে, যেটা বিএনপি দাবি করছে।’ তিনি বলেন, ‘কিন্তু মনে রাখতে হবে ওই ব্যবস্থা বর্তমান সরকার বাতিল করেছে এবং এটি আদায় করতে হলে বিএনপিকে কঠোর আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যেটা আওয়ামী লীগ পেরেছিল।’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপির কর্মকৌশল কী, তার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করছে।’
২০২৩ সালে বিএনপির ক্ষমতার বাইরে থাকার ১৭ বছর পূর্ণ হবে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পর সংসদে দলটির ভূমিকা নেই বললেই চলে। শুধু রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে এখনো বিএনপি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। নানামুখী চাপ ও সরকারের বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি এখনো আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত। তবে আগামী নির্বাচনের পরেও সংসদে না যেতে পারলে সেই রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব কতটা কার্যকর থাকতে পারবে, তা নিয়ে সুধীসমাজের পাশাপাাশি দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেও প্রশ্ন আছে। অনেকের মতে, সরকারের দমন-পীড়নের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে দলটির নেতৃত্বাধীন জোট ও সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে। আর এই হতাশা কমাতে হলে হয় ক্ষমতায়, নয় অন্তত সংসদের বিরোধী দলে যেতে হবে। ফলে দলটির শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে আলোচনা হলো, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন নীতি ও কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে, যাতে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দো চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, ‘১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বড় বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে, দলটির নেতাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও মানুষের মধ্যে সেই দলের গ্রহণযোগ্যতা।’ তিনি বলেন, ‘দেশপ্রেমের শক্তি নিয়ে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করলে এক সময় না এক সময় বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবেই।’ ‘যেমন ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পরেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে’ যোগ করেন বিকল্প ধারার এই সভাপতি। অবশ্য তিনি স্বীকার করেন, ‘আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।’
যদিও আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কি না বা করলেও সেটি কার নেতৃত্বে, এ নিয়ে দলটির মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। একই সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন বা কী প্রক্রিয়ায় সরকারকে ‘ছাড়’ দিতে বাধ্য করা হবে, সে কর্মকৌশলও দলটি এখনো ঠিক করেনি। বিএনপি এখন চলছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একক কর্তৃত্বে। তিনি এজেন্ডাভুক্ত না করলে কোনো ইস্যুতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এখন আর রাজনৈতিক আলোচনা হচ্ছে না। ফলে তাঁর দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপরই দলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে বিএনপি নেতারা মনে করছেন। তারেকের নেতৃত্বে এবার দ্বিতীয়বারের মতো বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার কথা রয়েছে। আবার নির্বাচনে না গেলে আন্দোলনও করতে হবে তাঁর নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায়।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক মত ও পথের অনুসারীদের এক মঞ্চে এনে বিএনপির প্রতিষ্ঠা করেন। তবে প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরের মধ্যে ৩৬ বছরই দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া। রাজপথে ‘আপসহীন’ ভাবমূর্তি গড়ে তোলার পাশাপাশি তিনবার তিনি বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে গেছেন। আর সংসদে বিরোধী দল হিসেবে নিয়ে গেছেন দুইবার। অনেকের মতে, জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলেও আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দলকে ব্যাপক মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন খালেদা জিয়া। একটি দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ার পরে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হলে সেদিন থেকেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনা করছেন তারেক রহমান। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকলেও রাজনীতিতে তাঁর প্রজ্ঞা ও যোগ্যতার হিসাব-নিকাশ এখনো সামনে আসেনি।
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, ‘তারেক রহমান কত দূর কী করতে পারবেন আগামী নির্বাচনে তা প্রমাণ হয়ে যাবে। এবার তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার অগ্নিপরীক্ষা। তবে আমি মনে করি, নির্বাচনের সময় অন্য কাউকে নেতৃত্বে দিয়ে দিলে সেটি হবে তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয়।’ ‘আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করতে না পারলে বিএনপির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কঠিন হবে’ বলেন বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘এটা বিএনপি বোঝে কি না, আমি জানি না।’
বিএনপির একসময়ের প্রভাবশালী নেতা, বর্তমানে এলডিপির সভাপতি ড. অলি আহমদ মনে করেন, বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারায় দলটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না।’ তাঁর মতে, আগামী দিনে কার অবস্থান কী হবে, সেটি বলা মুশকিল। তবে বড় বড় দলের জন্য আগামী দিনগুলো সুখকর না-ও হতে পারে।’ প্রশ্নের জবাবে অলি আহমদ বলেন, অন্য কোনো দলের নেতা সম্পর্কে মন্তব্য করব না। বিএনপিসহ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অবস্থা কী হবে, সেটি আমি ২০০০ সালেই পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম।’
দুই দিনের কর্মসূচি
বিএনপির ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এর মধ্যে রয়েছে আজ ১ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১১টায় শেরেবাংলানগরে জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, হেল্প ক্যাম্প ও করোনা রোগীর সহায়তা প্রদান। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পোস্টার, ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে দলটি। আগামীকাল ২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার এ উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনপির উদ্যোগে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিটি জেলা ও থানা ইউনিটকেও আলোচনাসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দলের সঙ্গে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের জন্য বলা হয়েছে।