আসলে মুসলমান এখন আর ইসলাম নয়, ইসলামের নামে সহজিয়া ধর্মের উপাসক। তার পরহেজগারি তাকওয়া সুন্নাতের অনুসরণ জিকির-ফিকির সবই ইসলামের বৈপ্লবিক আপোষহীন দাবীর মুখে পলায়নপরতারই নামান্তর। কী হবে না-হবে আল্লাহপাক ভালো জানেন।
আমাদের সামান্য বুদ্ধিতে ধারণা হয়, ইবলিসের মোকাবেলায় এই ধরণের ভীরু ও ভয়ার্ত মুসলমানের কোনো বন্দেগি আল্লাহপাকের কাছে চূড়ান্ত বিচারে প্রত্যাখাত হবারই সমূহ সম্ভাবনা। কারণ, ইবলিসের মোকাবেলায় যার ভূমিকা নিরপেক্ষ, সে-ব্যক্তি নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের দলভুক্ত নয়। সে বরং ইবলিসেরই পরোক্ষ সহযোগী।
জার্মান নাট্যকার ব্রেখট বলতেন, সমাজতন্ত্রকে আমি ভালোবাসি, কিন্তু এই ভালোবাসার কারণে আমি আমার গাড়ি-বাড়ি ও সচ্ছল নিরাপদ জীবন ত্যাগ করতে অক্ষম। বহু মুসলমান আজ বহুলাংশে ব্রেখটের মতই। তারা ইসলামকে ভালোবাসে, ইসলামের বিজয়ও কামনা করে, কিন্তু নিজে কোনো ত্যাগ বা ঝুঁকির মধ্যে প্রবেশ করতে নারাজ। অর্থাৎ এই মুসলমানেরা রসুল সা.-কে ভালোবাসে, কিন্তু এই ভালোবাসার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে সারবস্তু কিছু নেই। এটা ইসলামের প্রকৃত লক্ষ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে হতে পারে অথবা আখেরাতের তুলনায় পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার কারণেও হতে পারে।
কিন্তু যেটাই হোক ইসলামের সঙ্গে, মুসলমানিত্বের সঙ্গে এই ধরনের আত্মপরিচয়-বিস্মৃত ক্লীব ও বিকৃত মুসলমানের সম্পর্ক অত্যন্ত শিথিল। শুধু শিথিল নয়, কখনো কখনো সাংঘর্ষিকও বটে। অতএব এরা যখন রসুল সা.-এর অনুগত অনুসারী বলে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে, সেই আত্মশ্লাঘার মধ্যে কোনো প্রকৃত প্রাণসত্তা বলে কিছু থাকে না। পুরোটাই একজাতীয় লঘু তামাশার বস্তু হয়ে ওঠে।
আসলে রসুল সা.-এর সুন্নাত মানে আল্লাহপাকের পথনির্দেশ অনুযায়ী রসুল সা. যে-জীবনাদর্শ পেশ করেছেন, সেই পার্থিব জীবনাদর্শ। এই জীবনাদর্শের নিঃশর্ত অনুসরণই মানুষকে তার সর্বোচ্চ কামিয়াবির দিকে নিয়ে যায়। মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের সন্ধান পায় ও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সর্বোচ্চ কামিয়াবি ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য কী-জিনিষ, এই বিষয়ে যে-কোনো মুসলমানের প্রকৃষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক; অন্যথায় তার পক্ষে নির্ভুল সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব।
মুসলমান বিশ্বাস করে, তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ সাফল্য হলো আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি। কারণ আল্লাহপাকের নিজস্ব ঘোষণা, ‘ওয়া রিদওয়ানুম মিনাল্লাহি আকবার জালিকা হুয়াল ফাউজুল আজিম’- আল্লহপাকের সন্তুষ্টিই জীবনের শ্রেষ্ঠতম সাফল্য (সুরা তওবা)।
আর তাঁর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য হচ্ছে, পার্থিব সকল পরীক্ষা ও আখেরাতের হিসাব-নিকাশ উত্তীর্ণ হয়ে, আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ মাথায় নিয়ে অনন্তকালের জান্নাত। এই জান্নাত এমন একটি অভাবনীয় অকল্পনীয় পুরস্কার যে, আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ’ফাদ খুলি ফি ইবাদি ওয়াদ খুলি জান্নাতি’ (সুরা ফজর)। আমার দাসত্ব করো এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো। এ-থেকে বোঝা যায়, আল্লাহপাক তার প্রীতিভাজন বান্দাদের জন্য যে-পুরস্কার নির্দিষ্ট রেখেছেন, তার নাম জান্নাত।
অবশ্য জান্নাত জাহান্নাম ও আখেরাতকে যারা বিশ্বাসই করে না, তারা নামত মুসলমান হলেও, তারা এই বর্তমান আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়। বর্তমান এই আলোচনার লক্ষ্য সেই সকল মুসলমান, যারা আসন্ন আখেরাত ও বিচারদিনের প্রতি গুরুত্বের সঙ্গে ইমান রাখে এবং প্রকৃত কামিয়াবি ও প্রকৃত গন্তব্যের কথা আন্তরিকভাবে বিবেচনা করে। অর্থাৎ যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির মধ্যে আশ্রয়লাভে আকাঙ্ক্ষী এবং যাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য জান্নাতে প্রবেশাধিকার। কিন্তু এই দুটো বস্তু লাভ করার প্রকৃষ্ট উপায় কী?
আল্লাহপাক বলেন, ‘ওয়ামা আতাকুমুর রসুলু ফাখুজুহু ওয়ামা নাহাকুম আনহু ফানতাহু’- রসুল সা. তোমাদেরকে যা প্রদান করেন, তা গ্রহণ করো, যা নিষেধ করেন তা-থেকে বিরত থাকো (সুরা হাশর)। অর্থাৎ রসুল সা.-এর প্রতি সর্ব বিষয়ে নিঃশর্ত আনুগত্য রক্ষাই ঐহিক ও পারত্রিক সাফল্যের মূলধন। কিন্তু দিনে দিনে যে-কোনো কারণেই হোক, মুসলমানের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। আসলে মহানবি সা. সমগ্র মানববংশের জন্য কী-পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন, কী উপহার পেশ করেছিলেন, সেই বিষয়টি সম্যক অনুধাবনের মধ্যেই রয়েছে তাঁর সুন্নাহর সার্থক অনুসরণ।
অথচ এইখানেই আমরা মারাত্মকরূপে দিকভ্রষ্ট, মারাত্মকরূপে বিভ্রমের শিকার। বহু মুসলমান জানেই না এবং জানতেও চায় না যে, রসুল সা. এর কাজটা কী ছিল এবং পরবর্তীদের উপর কী কাজের দায়িত্ব তিনি অর্পণ করেছেন।
মুসলমান আজ আলখাল্লার যতটা মূল্য দিচ্ছে, গুদ্ড়ি ধরনের দরবেশী-লেবাসের যতটা মূল্য দিচ্ছে, তার এক শতাংশ মূল্যও পৃথিবী-পরিচালনায় ইসলামের সাংবিধানিক রূপরেখাকে দিচ্ছে না। অবস্থা এমন যে, আজ মনে হচ্ছে আল্লাহর রসুল সা. পৃথিবীতে এসেছিলেন তাঁর উম্মতদেরকে টেলারিং শেখাতে, এসেছিলেন দোয়া- তাবীজের গোপন বিদ্যার পশরা নিয়ে। এবং হজরত জিব্রাইল আ.-ও যে সহস্র সহস্রবার আমাদের এই প্রিয়তম মানুষটির কাছে এসেছিলেন, আজ মনে হচ্ছে, সেটা কেবলই দরবার ও খানকাহ্ সাজানোর পরামর্শ নিয়ে অথবা নিষ্ক্রিয় দোয়া-দরুদ ও মুরাকাবা-মারেফাতির সবক দানের জন্য। না, এসব পরিহাসের কথা নয়।
বহু মুসলমানের সুন্নাতি- জিন্দিগীর যে নমুনা, তা থেকে অনিবার্যভাবে এ-রকম ধারণাই গড়ে উঠছে। অথচ এসব কোনটাই ইসলামের আসল কথা নয়। ইসলামের মূল বক্তব্য হলো, ফিতনা সমূলে উৎপাটিত না-হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে, ইবলিসী-তৎপরতার বিরুদ্ধে সর্বস্ব নিয়ে প্রতিরোধ রচনা করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহপ্রদত্ত সংবিধানকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে, কুরআনের সকল নির্দেশ ও নিষেধকে শিরোধার্য করে পৃথিবীকে সুন্দর ও পবিত্র করে তোলাই মোমিনের জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে কুণ্ঠার এতটুকু অবকাশ ইসলামের প্রথম যুগেও ছিল না, এখনো নেই।
এইজন্যই একজন মোমিন সর্বদায়ই একজন সার্বক্ষণিক মুজাহিদ। এটাই রসুল সা.-এর শিক্ষা, এটাই তাঁর সর্বপ্রধান সুন্নাত এবং এটাই সর্বকালের সকল মুসলমানের জন্য অবশ্য- অনুসরণীয় কাজ ও কর্তব্য।
প্রকৃতপক্ষে নবি মুহাম্মদ সা. ছিলেন সকল অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান এক বিপ্লবী মহানায়ক, এক অকুতোভয় সিপাহসালার। এবং এই কারণেই বদর যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে কিছু সাহাবির দ্বিধা ও দুর্বলতাদৃষ্টে তিনি ঘোষণা করেছিলেন তোমরা কেউ না-গেলে আমি একাকী যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হবো। এবং তিনি বলতেন, আল্লাহর যাঁরা নবি ও রসুল, তারা যুদ্ধের পোশাক পরিধান করার পর যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে আর পোশাক পরিবর্তন করতে পারেন না।
অথচ এই বিপ্লবী মহাপুরুষের উম্মত হিসাবে সুন্নাত সম্পর্কে আমাদের আজ কতই-না অভিনব ধারণা, ইবাদত- বন্দেগি ও রসুল প্রেমের আজ কতই-না ভ্রান্তিবিলাস! (চলবে)