অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা
আমাদের প্রিয়তম নবি এবং তাঁর অধিকাংশ সাহাবি পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী।
বহুবিধ কর্মের সমষ্টি মানুষের জীবন। খণ্ডিতভাবে কোনো সময় রাজনৈতিক জীবন, কোনো সময় অর্থনৈতিক জীবন, আবার কোনো সময় ধর্মীয় জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে মনে করা হয় এটিই মানুষের জীবনের প্রধান দিক। ফলে মানুষ ও সমাজজীবনে সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। যখন মনে করা হয় অর্থনীতিই মানুষের জীবনের মৌলিক বিষয়, তখন ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়ে সে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে ধাবিত হয় এবং সমাজটা তখন শোষণ-জুলুমে ক্ষত-বিক্ষত হয়।
আবার যখন রাজনীতিকেই কেউ তার জীবনে বড় মনে করে, সে তখন স্বৈরাচারে পরিণত হয় এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজের গোলামে পরিণত করে। আবার ধর্মকেই (দার্শনিকদের ধারণা মতে ধর্ম) নিজের জীবনের সবকিছু মনে করে তখন সে ক্রমান্বয়ে সংসারত্যাগী সন্যাসীতে পরিণত হয়। আসলে আল্লাহপ্রদত্ত দ্বীন ইসলামে জীবনকে এভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করার সুযোগ নেই।
আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদেরকে হেদায়াত দানের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ দানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী। এ সমস্ত দায়ী ইলাল্লাহ সবাই ছিলেন মানবজাতির জন্য মডেল। সবারই সুনির্দিষ্ট পেশা ছিল। কেউ কৃষক, কেউ মজুর, আবার কেউবা ব্যবসায়ী। নিজ হাতে উপার্জন করাকে সম্মান ও মর্যাদার বলে মনে করতেন। কোনো কাজই তাঁদের কাছে ছোট ছিল না। অন্যান্য মানুষের মতো সমাজে তাঁরা চলফেরা করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, ঘর-সংসার করেছেন। বরং কাফির-মুশরিকরা অভিযোগ করেছে, তারা কেমন রসুল যে তাদেরই মতো জীবন-যাপন করে।
জবাবে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে, মানুষের হেদায়াতের জন্য মানুষকেই রসুল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে এবং ‘তারা তোমাদের মতই মানুষ’। রসুলগণ তাঁদের কাজে কখনই কোনো বিনিময় প্রত্যাশা করেননি। কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘তোমরা সেই রসুলদের আনুগত্য করো যারা নিজেরা হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চান না’।
আমাদের প্রিয়তম নবি এবং তাঁর অধিকাংশ সাহাবি পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। নিজ শ্রমলব্ধ উপার্জন রসুল সা. খুবই পছন্দ করতেন। তাঁর কাছে বড় বিষয় ছিল হালাল উপার্জন। উপার্জনে সামান্যতম বিচ্যুতি তিনি বরদাশত করতেন না। হালাল উপার্জনকে আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগি বা দোয়া-প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার শর্ত বলে উল্লেখ করেছেন। একদিন মসজিদে নববিতে এক লোক আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করছে ও সাহায্য কামনা করছে। এমতাবস্থায় রসুল সা. বলেন- ‘ওর দোয়া কবুল হবে কী করে? ওর খানা হারাম, ওর পরিধানে যা তাও হারাম’।
হাদিসের ভাষ্য মোতাবেক অবৈধ উপার্জনে গঠিত শরীর জাহান্নামে যাওয়ারই উপযুক্ত। উপার্জনের সকল বৈধ উপায়-উপকরণকে অনুমোদন করলেও তিনি নিজে যেমন ব্যবসায়ী ছিলেন, তেমনি তিনি তাঁর উম্মতদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্যে উৎসাহ যুগিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রুজির দশভাগের নয়ভাগ রয়েছে ব্যবসায়’। ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভ্যান ও রিক্সাচালক, শাক-সব্জি ও তরকারি বিক্রেতা, চা-পান বিক্রেতা, ক্ষুদ্র মুদি দোকান্দার থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প- কারখানা ও আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত অসংখ্য মানুষ ব্যবসা- বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
রসুল সা.-এর বর্ণনা মোতাবেক ব্যবসায়ে রুজির প্রশস্ততা আমরা একটু খতিয়ে দেখতে পারি। একজন কৃষকের এক একর জমি যার আনুমানিক মূল্য ১৫ লক্ষ টাকা। দেখা যায় এক একর জমির ওপর একজন কৃষক তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে সবাইকে নিয়ে পরিশ্রম করে কোনো রকমে সংসার পরিচালনা করে। হয়তো তার ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠাতেও সক্ষম হয় না। অথচ দশ হাজার টাকা পুঁজিতে একজন চা-পান বিক্রেতা স্বাচ্ছন্দের সাথে তার সংসার পরিচালনা করে ও ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠায়। ব্যবসায়ে যে রুজির প্রশস্ততা রয়েছে সেটাই এ উদাহরণ দ্বারা আমি বোঝাতে চেয়েছি।
ব্যবসায়ে রুজির প্রশস্ততার সাথে মর্যাদাও অনেক উচ্চে। রসুল সা. বলেছেন, ‘একজন সৎ ব্যবসায়ী সিদ্দিকদের সমপর্যায়ভূক্ত’ এবং ‘একজন সৎ ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবি-রসুল ও সিদ্দিকদের সাথে উত্থিত হবেন’। এতবড় সম্মান ও মর্যাদা সেই সব ব্যবসায়ীদের যারা তাদের ব্যবসায়ে সততা অবলম্বন করে। মানুষ ব্যবসা করে লাভের উদ্দেশ্যে এবং ইসলাম লাভের কোনো সীমা-পরিসীমা বলে দেয়নি। অর্থাৎ ১০% বা ২৫% লাভ করা যাবে বা এর বেশি করা যাবে না, এমন কোনো বক্তব্য ইসলামে বলা হয়নি। বাজারে চাহিদা ও যোগান দ্বারা দাম এবং লাভের অংক নির্ধারিত হয়।
এ ক্ষেত্রে ইসলামের বক্তব্য স্পষ্ট। মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা যাবে না, ওজনে কম-বেশি বা ভেজাল দেয়া যাবে না, উৎকৃষ্ট পণ্যের সাথে নিকৃষ্ট পণ্যের মিশ্রণ বা ধোকা-প্রতারণার আশ্রয় নেয়া যাবে না, মিথ্যা কসম খাওয়া যাবে না বা জনস্বার্থে ক্ষতিকর কোনো কিছুই করা যাবে না। একজন অমুসলিম ব্যবসায়ে সফলতা লাভের উদ্দেশ্যে সততা অবলম্বন করতে পারে, কারণ সে জানে ‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’। সততার মাধ্যমে সে যদি ব্যবসায়ে একবার সুনাম অর্জন করতে পারে তাহলে সে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাবে এবং দ্রুতই সাফল্যের শিখরে আরোহণ করবে। সন্দেহ নেই, ব্যবসায়ে সুনাম বা Good will একটি সম্পদ (অর্থনীতির ভাষায় সম্পদের সকল বৈশিষ্ট্য এর মধ্যে বিদ্যমান) এবং সুনাম অর্জনের অন্যতম উপায় হলো ব্যবসায়ে সততা। কিন্তু ব্যবসায়ে সততা ইসলামে কেবল সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাই নয়, সাথে সাথে আখিরাতে নাজাতেরও উপায়।
তাই একজন মুসলিম দুনিয়ার উন্নতি ও আখিরাতে নাজাতের লক্ষ্যে অবশ্যম্ভাবী সততা অবলম্বন করবে। দুর্ভাগ্যই আমাদের, আমরা প্রায়ই শুনে থাকি সততা নিয়ে ব্যবসায়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কথাটি আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর প্রতি মিথ্যাচার বৈ আর কিছুই নয়।
ব্যবসায়ে পুঁজি বা মূলধন অবশ্যম্ভাবী এবং বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য একান্তভাবে পুঁজিনির্ভর। মূলধন উৎপাদনশীল, অর্থাৎ মূলধন সহযোগে উৎপাদন বাড়ে, তাই পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মূলধনের পারিতোষিক হিসেবে সুদ দেয়া হয় এবং সুদ ঝুঁকিমুক্ত ও পূর্বনির্ধারিত। পুঁজিবাদী অর্থনীতির দৃষ্টিতে ঝুঁকিবহন কেবল উদ্যোক্তার এবং ঝুঁকিবহনের পুরস্কারই হলো মুনাফা। ইসলামে সুদকে শর্তহীনভাবে হারাম করা হয়েছে এবং উদ্যোক্তা ও মূলধন মালিক উভয়কে একই কাতারে নিয়ে এসে মুনাফর অংশীদার করেছে। আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিনিয়োগের বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে অন্যতম হলো মুদারাবা ও মুশারাকা পদ্ধতি। মানুষের নৈতিক মানের ঘাটতির কারণে ব্যাংকগুলো মুদারাবা ও মুশারাকা পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারছে না।
মানুষের মধ্যে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের এবং সেই সাথে ব্যাংকসহ সবারই। দুর্ভাগ্যই আমাদের, জনগণকে Motivation বা উদ্বুদ্ধকরণের সহজ উপায় হাতে থাকার পরও আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা ব্যাংকগুলো থেকে প্রায়ই ঋণখেলাপীর কথা শুনি এবং আরো শুনে থাকি যে, ব্যবসায়ীরা একাধিক খাতা সংরক্ষণ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণখেলাপী অর্থ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী অর্থাৎ মুনাফিক, যার অবস্থান জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে। আর একাধিক খাতায় হিসাব রাখা অর্থাৎ সে তার পার্টনার বা অংশীদারকে ঠকায় বা আয়কর ফাঁকি দেয়। এ সবই তো কবিরা গুনাহ। কোনো ঠগ বা প্রতারক কখনই মুসলমান হতে পারে না, সে নিরেট কাফির বৈ আর কিছু নন।
আর একজন ব্যক্তি, যে নিজেকে ঈমানদার দাবী করে, সে কখনই আয়কর না দিয়ে পারে না। একজন ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে হিসেব করে যেভাবে জাকাত দেয়, ঠিক তদ্রুপ হিসেব করে আয়কর দেয়াও তার ঈমানী দায়িত্ব। সরকারি বিধি-বিধানের আওতায় যতটুকু সুবিধা দান করা হয়েছে ততটুকু ভোগ করার অধিকার তার রয়েছে। এ ছাড়া মিথ্যা বর্ণনা দিয়ে আয়কর কম দেয়া একজন ঈমানদারের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। সরকার আয়কর নির্ধারণে জুলুম করলেও তাকে বিধি-বিধান মোতাবেক আয়কর দিতে হবে এবং এ জন্য সে বাড়তি সওয়াব পাবে সন্দেহ নেই। কিন্ত তাই বলে কর ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। হাদিসে রয়েছে- ‘যাকাত ছাড়াও সম্পদের আরো দেয়ার রয়েছে’। আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ব্যতিরেকে রাষ্ট্রের আনুগত্য অবশ্যম্ভাবী ।
ব্যবসায়-বাণিজ্যের একটি বড় বিষয় হলো চুক্তি। ইসলাম এই চুক্তিনামাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। এই চুক্তি লিখে রাখা ও সাক্ষী রাখা কুরআনেরই নির্দেশ। চুক্তিভঙ্গ করার কোনো সুযোগ ইসলাম কাউকে দেয়নি এবং একান্ত প্রয়োজন হলে উভয়পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে তা রদ বা পরিবর্তন করা যেতে পারে। কিন্তু এই চুক্তি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আমরা অনেক সময় উপেক্ষা করি এবং এই উপেক্ষা করা যে গুনাহের কাজ ও আমাদের ঈমান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে সে উপলব্ধিও আমাদের নেই। অথচ আমরা নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, জাকাত আদায় করি, কুরবানি দেই, আবার হজও করি এবং এর কোনো একটি ছুটে গেলে কষ্টও অনুভব করি।
আল্লাহপাক আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগি এজন্যই ফরজ করেছেন যাতে আমাদের মাঝে আল্লাহর ভয় ও স্মরণ জাগ্রত হয় এবং আমাদের ব্যবহারিক জীবন পরিশুদ্ধ হয়। তাইতো রসুল সা. বলেছেন, ‘যে নামাজ মানুষকে অন্যায় ও দুষ্কর্ম থেকে ক্ষান্ত করে না, সে নামাজ আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়ে দেয়’ এবং ‘রোজা রেখে যে ব্যক্তি মিথ্যা ছাড়লো না, সে রোজা রাখায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই’।
নামাজ-রোজার মাধ্যমে নিজের কদর্য চরিত্র আড়াল করে মানুষকে ধোঁকা দিতে সমর্থ হলেও আল্লাহকে প্রতারিত করা কখনই সম্ভব নয়। দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে বিভক্তি আনয়নের ফলেই আজ মুসলমানদের এ দুরবস্থা। জুমার দিনে আমাদের মসজিদসমূহ মুসল্লিদের উপস্থিতিতে উপচে পড়ে এবং প্রায়ই রাস্তায় দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। চরম অধপতনের মাঝে নিভু নিভু পর্যায়ে হলেও আমাদের মধ্যে ঈমান এখনো বর্তমান, এ দৃশ্য সেটাই বলে দেয়। এখন প্রয়োজন, এ লোকগুলোর মাঝে ইসলামের মূল শিক্ষা দান করা যাতে তারা পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের মধ্যে শামিল হয় এবং ধর্ম, রাজনীতি ও আর্থিক জীবনের মধ্যে পার্থক্য দূরীভূত হয়।
আল্লাহপাক আমাদের সঠিক উপলব্ধি দান করুন এবং তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন। আমিন।