এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের মনে জাগে! শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, কেন্দ্রিয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিসহ বড় বড় দুর্নীতি করে যারা অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। যারা শিল্পকারখানা- বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ ও বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং যাদের দেশ-বিদেশে বাড়ি রয়েছে, বাসায় অনেক চাকর-বাকর ও অনেকগুলো গাড়ির মালিক তারই তো ধনী।
হ্যাঁ, কথাটি মিথ্যে নয় অন্তত তাদের জন্য যারা নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ (ব্যবহারিক জীবনে যারা ধর্মের ধার ধারে না)। হালাল-হারামের বাছ-বিচার ছাড়াই এ পৃথিবীতে এক শ্রেণির মানুষ সম্পদের পেছনে ছুটছে উন্মাদের মতো। কিভাবে অর্থ উপার্জন করবে সেটা তাদের দেখার বিষয় নয়। কন্টাক্টে গুম-খুন করে হলেও তাদের টাকার প্রয়োজন।
সমাজে বিশেষ এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যাদের অর্থবিত্তের পরিমাণ আমাদের ধারণারও বাইরে। কিন্তু তাই বলে কি তারা নিজেদেরকে ধনী মনে করে? কক্ষণই নয়। তারা নিজেদেরকে তুলনা করে টাটা, বিড়লা ও বিল গেটসের সাথে। মেধা-যোগ্যতা ও পরিশ্রম দিয়ে তারা নিজেদেরকে আজ এ পর্যায়ে উন্নীত করেছে।
কিন্তু আমাদের দেশের ধনীরা জনগণ ও রাষ্ট্রের অর্থ লুটেপুটে বড় হতে চায়। সমাজের অধিকাংশ সম্পদশালী মানুষের অবস্থা এমনই। আল্লাহর ভয় ও আখিরাতে জবাবদিহির অনুভূতি না থাকায় তাদের এ অবস্থা। তারা তাদের অবস্থানে সন্তুষ্ট নয়। তারা বেশি পেতে চায়।
আল্লাহ সুরা তাকাসুরে তাদের অবস্থার যথার্থই বর্ণনা করেছেন। রসুল সা. বলেছেন- ‘মানবশিশুর অবস্থা বড় আশ্চর্য, এক উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ দেয়া হলে সে আর একটি চায়; মাটি ছাড়া অন্য কিছু তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না’।
সম্পদশালী মানুষের একটি বড় অংশ ঋণখেলাপী এবং এদের মধ্যে অনেকে ঋণ মওকুপের জন্য ভিক্ষুকের মতো উপস্থিত হয় বা শক্তির দাপট দেখায়। ইসলামী অভিধানে ঋণখেলাফী অর্থ মুনাফিক যাদের অবস্থান জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে। অনেকের বুঝতে কষ্ট হচ্ছ। ঋণখেলাপী মানে ঋণ গ্রহণের সময় যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে তা সে রক্ষা করে না।
আর মুনাফিকের কয়েকটি খাসলত এবং এর মধ্যে অন্যতম হলো যারা ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি প্রদান করলে তা ভঙ্গ করে। এরাই দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জনকারী সবাই জালেম এবং আখেরাতে প্রতিটি অর্থের হিসেব দিতে গিয়ে তারা নিঃস্ব ও দরিদ্র হয়ে যাবে। যাদেরকে আমরা ধনী বলি রসুল সা.-এর ঘোষণা মোতাবেক এরা কেউ ধনী নয়, বরং ওরা আমলের দিক দিয়ে একেবারে দরিদ্র এবং জাহান্নামই তাদের ঠিকানা।
এই শ্রেণির মানুষের নামের পূর্বে আলহাজ লেখা এবং বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসা-স্কুল-কলেজের পৃষ্ঠপোষক/সভাপতি হওয়ার খুব সখ। ওরা মানুষকে প্রতারিত করতে পারলেও আল্লাহকে প্রতারিত করা কখনই সম্ভব নয়। কারণ হারাম উপার্জনে গঠিত শরীর জাহান্নামের জ্বালানী বৈ আর কিছুই নয়। এই সব লোকেরা আবার শ্রমশোষণকারীও। নিজেদের শিল্পকারখানার শ্রমিককে ন্যায্য মজুরি না দিলেও তারা দেশ-বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণে খুবই আগ্রহী।
ইসমাইল হোসেন সিরাজী কতো চমৎকারভাবেই না বলেছেন- ‘যে লোক বছর বছর হাওয়ায় জাহাজে করে হজ করে আসেন, তিনি যদি তাঁর কারখানার শ্রমিককে ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেন এবং মৃত্যুর পর তার কবরে সোনার চাবি রেখে দিয়ে আসলে সে চাবি দিয়ে বেহেশতের কোনো দরজাই খুলতে পারবে না’। মানুষের প্রতি জুলুম করে কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললে সে মোটেই ধনী নয়; বরং এই সম্পদ তার জন্য বিপদের কারণ হবে এবং আখিরাতে মজলুমের পাওনা পরিশোধ করতে গিয়ে সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়বে।
ধনী হওয়াটা একেবারে আপেক্ষিক ব্যাপার। রসুল সা. বলেছেন- ‘মনের ঐশ্চর্য প্রকৃত ঐশ্চর্য’। অর্থাৎ ধন থাকলেই ধনী হয় না, যার মন বড় সেই প্রকৃত ধনী। ভ্যানে করে যারা বেচাকেনা করে বা মসজিদের সামনে যে ভিক্ষুকটি হাত পাতে তাদের দিকে দৃষ্টি দিলে নিজেকে অনেক বড় মনে হয়। যে সমাজে আমরা বসবাস করি সে সমাজে চারিদিকে একটু দৃষ্টি দিলে নিজেকে শতকরা নব্বই জন অপেক্ষা অনেক ধনী ও সুখি ভাবা যায়। ভ্যানচালক, কুলি-মুটে-মজুর যাদেরকে আমরা দরিদ্র ভাবি তাদের সুস্থতা ও হাসিখুশি জীবন, অসুস্থ ও পারিবারিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত মানুষ অপেক্ষা অনেক সুখি এবং বলা যায় ওরাই সত্যিকার ধনী ও সম্পদশালী।
খুশি ও আনন্দময় এবং ঝামেলামুক্ত জীবনের স্বাদই আলাদা। তাদের সাথে তথাকথিত ধনীরা কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। এই সমাজে যে অল্পে তুষ্ট এবং ঋণমুক্ত সেইতো ধনী। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী বান্দা হয় অতীব ধৈর্যশীল ও তার রবের ওপর নির্ভরশীল এবং সংকীর্ণতা তাকে কখনই স্পর্শ করতে পারে না। সে হয় উদার ও প্রশস্ততার অধিকারী এবং সহজেই মানুষের ত্রুটি- বিচ্যুতি মাফ করে দিতে পারে; প্রতিশোধস্পৃহা তার মধ্যে কাজ করে না। হাদিসের ভাষায় এমন উদার ও প্রশস্ততার অধিকারীকেই ধনী বলা যা। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে তারা প্রশংসনীয় এবং তারাই হলো ভাগ্যবান।
আল্লাহপাক আমাদেরকে অল্পে তুষ্ট ও সুখী জীবন যাপনের তৌফিক দান করুন।