বিচিত্র এ ভূস্বর্গে চিত্রের কোনো স্বল্পতা নেই। নানা ঢঙে ফুটে ওঠে কৃত্রিম এ জগতের অসংখ্য রূপের ছটা। মুখরিত হয় প্রতিটি রোমাঞ্চিত হৃদয়। পুলকিত আবেশ ছড়িয়ে পড়ে দেহমনের সর্বত্রে।
এ ভূস্বর্গে রঙিন সভ্যতা-সংস্কৃতির রঙিন মঞ্চের কখনো অভাব পড়েনি। হতদরিদ্র দেশ থেকে নিয়ে শিল্পের সর্বোচ্চ আসরে সমাসীন দেশগুলোর কোনটির মাঝেই আনন্দ বিনোদনের কোন কমতি হামেশাই হয়না। যাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাস যত দীর্ঘ তাদের বিকাশ এবং উৎযাপনও ততটাই চমকপ্রদ ও মুগ্ধকর। মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস পৃথিবীর প্রাচীনতম তাই এর বিকাশও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। যেহেতু সমৃদ্ধ বিকাশ তাই এর উৎযাপন অবশ্যই নজরকাড়া এবং হৃদয় জাগানিয়া হবে এটাই কাম্য এবং যুক্তিযুক্ত।
যাইহোক, সভ্যতা-সংস্কৃতি উপলক্ষ্য করেই মিশরে আয়োজিত হলো নতুন আরো একটি মেহেরজান বা বাৎসরিক উৎসব। প্রায় বিশটি দেশের আনন্দঘন অংশগ্রহণে উৎযাপিত হলো অপূর্ব সাংস্কৃতিক বর্ণাঢ্য উৎসব।
আমন্ত্রিত দেশের স্টুডেন্টস: মিশর সরকার কর্তৃক আয়োজিত এ উৎসব উপলক্ষে প্রতি বছর ঘটা করে প্রায় পঞ্চাশটি দেশের স্টুডেন্টদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের আশংকাজনক পরিস্থিতির কারণে এবছরের আসরে অনেক বাধা-নিষেধ অনুসরণ করে ত্রিশটির মতো দেশ আমন্ত্রণ পেয়েছে। অবশ্য সময় স্বল্পতা এবং অন্যান্য রেস্ট্রিকশনের কারণে মোটামুটি বিশটির মতো দেশের স্টুডেন্টস তাদের কালচারাল প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে পেরেছিল।
অংশগ্রহণ কারী দেশসমূহ: মিশর, জর্দান, সুদান, সৌদি আরব, চাঁদ, ইয়েমেন, ইরিত্রিয়া, কুয়েত, ক্যামেরন, মৌরিতানিয়া, বাহরাইন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ভারত এবং প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ সহ প্রায় বিশটির কাছাকাছি দেশের স্টুডেন্টস। যেসব দেশের স্টুডেন্ট ক্যাপাসিটি কম ছিল, তারা দর্শক হয়েই উপভোগ করেছে।
অনুষ্ঠান পরিকল্পনা এবং ইভেন্টস: মিশরের সরকারি ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত প্রায় দুই রাত, দুইদিন ব্যাপী এই বাৎসরিক উৎসবটি চারটি ইভেন্টে বিভক্ত ছিলঃ
০১ ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী।
০২ স্টোর সাজানো।
০৩ স্টেইজ পারফরম্যান্স।
০৪ ফিরে দেখা/ নিজের দেশ।
০১ প্রথম সন্ধ্যায়: পর্দায় প্রদর্শনী ও বড় আসরের প্রস্তুতি।
– সন্ধ্যায় থিয়েটারের বাহিরে স্টেজে অনুষ্ঠান রিলেটেড কিছু ভিডিও প্রদর্শিত হচ্ছিল। কেউ কেউ সেসব দেখছিল আবার অনেকে পরবর্তী দিনের কালচারাল ইন্ট্রুমেন্ট দিয়ে নিজেদের সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রদর্শনী হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য স্টল সাজাচ্ছিল।
– মোটামুটি সন্ধ্যার পর যারা পার্টিসিপেট করবে তাদের অধিকাংশই উপস্থিত হয়ে পড়েছিল তাই প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় পাওয়া গেছে বলেই মনে হলো।
০২ প্রভাতের আলোয় নতুন জগতের ছোঁয়া: ভেবে দেখুন তো, আপনি অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে আপনার বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন কিন্তু ঘুম থেকে ওঠে দেখতে পাচ্ছেন পৃথিবীর দিক-দিগন্তের নানা দেশ আপনার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কেমন লাগবে বলুন তো?! জাস্ট ইম্যাজিন !! আমার তো লিখতে গিয়ে বারবার দৃশ্যটি চোখের সামনে চলে আসছে!! কি অপূর্ব !! ভাবছি আর আনন্দের অতিমাত্রায় মুখের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে!!
জি হ্যাঁ, এমনটিই ঘটেছিল সেদিন। ম্যানেজম্যান্ট থেকে নির্দেশনা ছিল প্রত্যেক দেশীয় স্টুডেন্টরা তাদের দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সভ্যতা ফুটিয়ে তুলবে। সবার জন্যই নির্দিষ্ট করে জায়গা দেওয়া হয়েছিল। সে সুবাদে সবাই নিজেদের দেশ ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে তেমনিভাবে নিজেদের সাজানোর পাশাপাশি ঐ নির্দিষ্ট জায়গাটুকুও সাজিয়ে রেখেছিল। এসব দেখে মনে হচ্ছিল প্রতিটি ছোট্ট জায়গা যেন একেকটি দেশ। সত্যিই চমৎকার ছিল।
০৩ মিশরের স্টেজে বাংলাদেশী সংস্কৃতি: বেলা তখন এগারো ছুঁই ছুঁই। উৎসব কর্তৃপক্ষ থেকে আহ্বান এলো সকল দেশের স্টুডেন্টদের সমবেত হওয়ার জন্য। সবাই চলে সমবেত হয়েছে নির্দিষ্ট ফিল্ডে। সবাই লাইন টু লাইন দাঁড়িয়েছে হাতে রয়েছে আপন দেশের পতাকা। প্রত্যেকেই গায়ে জড়িয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি ফুটে এমনি পোশাক। সবাই আনন্দে-উৎফুল্লে, হাসছে, কথা বলছে। একে অন্যের সাথে পরিচিত হচ্ছে। সাদাকালো আর লম্বা- বেঁটে সবাই সবার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। আহ্ কি সুন্দর দৃশ্য! কি অপূর্ব সংস্কৃতির মিলন মেলা। পরস্পর ভালোবাসা আর ভ্রাতৃত্বের কি চমৎকার সেতুবন্ধন।
ধারাবাহিকভাবে লাইন ধরে প্রত্যেক দেশের স্টুডেন্ট অডিটরিয়ামের দিকে প্যারেড সিস্টেমে হাঁটতে লাগলো। যেহেতু সরকারিভাবে আয়োজিত অনুষ্ঠান ছিল তাই টিভিতেও নিউজ হচ্ছিল বলে শোনা গেছে। একপর্যায়ে সবাই হলরুমে প্রবেশ করলো এবং শুরু হলো স্টেজ পারফরম্যান্স। প্রত্যেক দেশের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল মাত্র পাঁচ মিনিট করে। এমনিতেই সারা বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী এর মাঝে এমন বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা আবার তাতে জনমানুষের সমাগম ঘটবেই। সবকিছু বিবেচনায় রেখেই সময় কমিয়ে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
শুরুতে পরিচালক এবং সম্মানিত অতিথিবৃন্দ কিছুক্ষণ বক্তব্য দিয়েছেন তারপরেই শুরু হলো অনুষ্ঠানের মূল পর্ব।
প্রকৃতপক্ষে স্টেজে সংস্কৃতি প্রদর্শন বলতে কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিলো নানা দেশীয় সাংস্কৃতি। প্রত্যেক দেশেই তাদের বিভিন্ন উৎসব এবং উপলক্ষকে কেন্দ্র করে আনন্দ উল্লাস করে এবং দেশকে রিপ্রেজেন্ট করে থাকে। সেই প্রতিচ্ছবি এখানে ফুটে উঠুক এবং অন্যান্য দেশ ও সংস্কৃতির মানুষের কাছে সবাই আপন আপন দেশীয় সাংস্কৃতিক চিত্র তুলে ধরুক এটাই ছিল স্টেজ পারফরম্যান্সের মূল উদ্দেশ্য। মানুষ জানবে, শিখবে এবং আনন্দে মেতে থাকবে উৎসবের সময়টুকুতে।
প্রথমেই মিশরীয় পারফরম্যান্স। কয়েকজন স্টেজে আসলো এরাবিয়ান স্টাইলে পারফরম্যান্স করলো। স্টেজের সাইডে বড় স্ক্রিনে মিশরের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হচ্ছিল।
তারপর ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য দেশের অংশগ্রহণকারীরাও স্টেইজ পারফরম্যান্সে অংশগ্রহণ করলো। আপন সংস্কৃতি তুলে ধরল।
আহলান সাহলান: আমরা বাংলাদেশী স্টোর সাজিয়েছিলাম বাঙ্গালী ঐতিহ্য ধারণ করে এবং বাংলাদেশের পরিচিতি ও অগ্রগতি ফুটে এমনি কিছু মূল্যবান জিনিসের সমন্বয়ে। যা আমরা এম্বাসেডর স্যারের সহযোগিতায় বাংলাদেশ এম্বাসি থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। এভাবে প্রত্যকে দেশের স্টুডেন্টস তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সর্বোচ্চরূপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে আপন আপন স্টোর গুলিতে। স্টেজ পারফরম্যান্স শেষ হওয়ার পর সকল দেশের রাষ্ট্রদূত এবং উৎসব পরিচালনা কমিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং মিশরের একজন সম্মানিত মন্ত্রী সবগুলো স্টোর পরিদর্শনে বের হন। সকল দেশের রাষ্ট্রদূত এবং পরিচালনা কমিটি আলাদাভাবে পরিদর্শনে আসেন। আমাদের বাঙ্গালী স্টোরে কয়েকজন রাষ্ট্রদূত পরিদর্শন করে যান। সর্বপ্রথম আসেন আমাদের বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত স্যার এবং খুবই প্রশংসা করেন।
এখানে একটা বিষয় না বললেই নয়- মিশরে অবস্থিত বাংলাদেশ এম্বাসীর মান্যবর রাষ্ট্রদূত মহোদয় জনাব মো. মনিরুল ইসলাম স্যার।
যেন একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। এই পুরো অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান সফল করার জন্য যিনি আন্তরিকতার সাথে আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। একটা তাঁবু বাংলাদেশী সাজে সজ্জিত করার জন্য অনেক কিছুর দরকার হয়েছিলো। যার সিংহভাগই এম্বাসেডর স্যার এম্বাসী থেকে আমাদের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এজন্য স্যারকে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও স্যারের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
এরপর ধারাবাহিকভাবে আরো কয়েকজন আসেন। আমরাও ফাঁকে ফাঁকে অন্যদের স্টোর গুলিতে ঘুরে এসেছি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে সৌদি আরব ও ইয়ামেনের স্টোর সাজানো। খুব হাই কোয়ালিটির জিনিস দিয়ে তারা সেখানে সাজিয়েছে।
একপর্যায়ে পরিচালনা কমিটি আমাদের স্টোরে আসলো। প্রবেশের পূর্ব থেকেই আমরা ‘আহলান সাহলান মারহাবান বিকুম’ বলে তাদেরকে স্বাগতম জানাচ্ছিলাম। সবাই সমস্বরে গানের সুরে বলছিলো তাই দৃশ্য এবং দৃশ্যপট চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছিল আমাদের পক্ষ থেকে একজন ইংলিশে ট্রান্সলেট করে সবকিছু তাদের বুঝিয়ে বলছিল। পরিদর্শন শেষে তারা আমাদের প্রশংসা করলো। আমরা অনুপ্রেরণা পেলাম এবং উৎসবের আমেজ সুন্দরভাবে উপভোগ করলাম।
দেখে শিখে ঘুরে ফিরে এভাবেই কেটে গেলো সারাদিন। সন্ধ্যায় আবার নতুন কিছুর অপেক্ষায় রইলাম।
০৪ চলুন দেশে ফিরে আসি: সন্ধ্যায় মাগরিবের পরপরই শুরু হয়ে গেলো শেষ পর্ব। বড় হলরুমের বড় স্ক্রিনে বিশ্বের প্রায় অনেক গুলো দেশকে নিয়ে ছোট্ট পরিসরে ডকুম্যান্টারি তৈরি করেছিল। সেটাই প্রদর্শিত হচ্ছিল বড় স্ক্রিনে।
দ্বিতীয়ত, যদিও ছোট ভিডিও ক্লিপ ছিল কিন্তু একটু কল্পনা করুন তো, অনেক গুলো দেশের মানুষ আপনার পাশে বসে আছে আর আপনি সেসব মানুষের পাশে বসে আপনার দেশটিকে দেখছেন সাথে তারাও দেখছে এবং প্রশংসা করছে তখন আপনার মনের অনুভূতি কেমন হবে !!
আবেগের জায়গা থেকে ভেবে দেখুন দেশের প্রতি ভালোবাসা অনেক বেড়ে যাবে। সত্যিই এসব অনুভূতি যতটুকু অনুভব করা যায় তার কিঞ্চিত অংশই শুধু লেখা যায় তারচেয়ে বেশি নয়।
এরপর যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো আমরা ফিরে এলাম আমাদের আপন আলোয় বা ঠিকানায়।
উক্ত মেহেরজানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, প্রোগ্রাম সফল করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে, বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন। ইত্তেহাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিভাগের তত্ত্বাবধানে আয়োজন টি সম্পন্ন হয়েছে।
যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ আয়োজন:
মো. শরীফ উদ্দীন আব্দুল মান্নান, সভাপতি- ইত্তেহাদ।
মো. আতিকুর রহমান, সেক্রেটারি- ইত্তেহাদ।
মো. সাইমুম আল মাহদী, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সেক্রেটারি- ইত্তেহাদ।
মো. আ. রহমান ও মো. নোমান, অর্থ বিভাগ ইত্তেহাদ।
এবং ইত্তেহাদ সাংস্কৃতিক বিভাগের প্রতিভাবান সদস্যবৃন্দ।
পরিশেষে, বিশ্বের মানচিত্রে প্রাণের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নতুনভাবে বর্ণীল আঙ্গিকে তুলে ধরতে পরে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন যারপরনাই আনন্দিত ও গর্বিত। মাতৃভূমিকে তুলে ধরার এমন চমৎকার একটি প্লাটফর্ম উপহার দেয়ার জন্য মিশর ও তার সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়কে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ। শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি মহান ব্যক্তিগণের প্রতি, যারা এই মহান কাজে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের পাশে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন।
ধন্যবাদ প্রিয় মিশর ধন্য হোক তোমার আতিথেয়তা! ধন্যবাদ হে প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ! ধন্য হোক তোমার স্থায়িত্ব ও সফলতা চিরজীবী হোক তোমার সূর্য সন্তানরা !!