কভিড-১৯-এর ছোবলে যুক্তরাজ্যে মারা গেছেন কারি ইন্ডাস্ট্রির অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কভিড মহামারিকালে যুক্তরাজ্যে কারি ইন্ডাস্ট্রিসহ হসপিটালিটি খাতে হাজারও মানুষের মৃত্যুর প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক প্রচারিত কারি হাউস ম্যাগাজিন কারি লাইফের কালিনারি ওয়ার্কশপ।
গত ২৫ জুলাই রবিবার লন্ডনের ক্রাউন প্লাজা ডকল্যান্ড হোটেলে ঝাকজমকপূর্ণ কারি লাইফের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন শহর থেকে আসা রেস্টুরেটার্স, শেফ, ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্ট ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা। কভিড শুরু হওয়ার পর থেকে সরাসরি সমবেত হওয়ার মাধ্যমে এটি ছিল কারি ইন্ডাস্ট্রির সর্বপ্রথম বৃহৎ অনুষ্ঠান। মহামারি শেষ না হলেও প্রায় দেড় বছর পরে একটি অনুষ্ঠানে এভাবে একে অন্যের সাথে সামনা সামনি দেখা করতে পেরে সবাই ছিলেন উচ্ছ্বাসিত। কারি লাইফের আয়োজনকে সবাই প্রশংসা করেন এবং ইন্ডাস্ট্রির মানুষজনদের উৎসাহ যোগাতে এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে এই অনুষ্ঠান সহায়তা করবে বলে মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানের দিন রবিবার বিশিষ্ট ক্যাটারার্স, ব্রিটিশ বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইয়াফর আলীর মৃত্যুতেও শোক প্রকাশ করা হয়।
কভিড মহামারিকালে বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হসপিটালিটি খাত। আর এই ক্ষতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয় যুক্তরাজ্যের হাজার হাজার কারি রেস্টুরেন্ট এবং টেকওয়ে। বার বার লকডাউনও ও মহামারির ভয়াবহতায় বিপর্যস্ত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। গত ১৯শে জুলাই দেশটির সরকার কভিড সংক্রান্ত অনেক বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ায় প্রায় এক বছর পর খুব সাবধানে রেস্টুরেন্টগুলো খোলা শুরু হয়েছে। কিন্তু ‘পেনডেমিক’ আর ‘আইসোলেশন’ হলো সেখনকার সবচেয়ে আলোচিত দুটি শব্দ। মহামারি দূর হয়নি। সংক্রমণের হার খুব দ্রুত বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে আইসোলেশনে যাওয়ার কারণে স্টাফ সংকটে অনেক রেস্টুরেন্ট আবার বন্ধ হতে শুরু করেছে। ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটছে। নানা সমস্যা ও আর্থিক সংকটে জর্জরিত ব্যবসাগুলো কিভাবে সচল রাখা যায় এ নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞ ও নেতৃবৃন্দ কারি লাইফের এই কালিনারি ওয়ার্কশপে আলোচনা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কারি লাইফের সম্পাদক সৈয়দ বেলাল আহমদ। তিনি বক্তব্যের শুরুতেই কভিড ১৯-এ কারি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত যারা মারা গেছেন তাদের কথা স্মরণ করেন। কভিডের সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা বিভিন্ন ফ্রন্টলাইন স্টাফদের জন্য রেস্টুরেন্ট টেকওয়ে আংশিক খোলা রেখে খাবার সরবরাহ করেছেন সেসব ‘কারি হিরোদের দুঃসাহসিক কাজের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, মহামারি শেষ হয়নি, সংকট কাটেনি। পেনডেমিক ও আইসোলেশনে থাকার কারণে ব্যবসা সাফার করছে। আমাদের অনুষ্ঠানও আজ এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। আমাদের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্যে নির্ধারিত তিনজন প্রেজেন্টার আইসোলেশনে যাওয়ায় উপস্থিত হতে পারেননি।
সৈয়দ বেলাল আহমদ বলেন, রেস্টুরেন্ট কমিউনিটির মধ্যে সবসময়ই একটি নেতিবাচক প্রচার চালান একটি গোষ্ঠী। এই শত শত, হাজার হাজার রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি বলি এসব প্রচারণা বন্ধ করুন। নিজেরা সস্তা পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য যতটা না ঘটছে তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে বলা বন্ধ করুন। এতে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। তারা নিজেদের ব্যবসায় যতটা মনোযোগ দেয়ার কথা ততটা দিতে পারেন না। সুতরাং তাদের উৎসাহ দিন, সমাধানের পথ খুঁজুন, তাদের সাহায্য করুন। তাহলেই ইন্ডাস্ট্রি ঠিকে থাকবে।
তিনি বলেন, কারি লাইফ ম্যাগাজিন ইন্ডাস্ট্রির প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থেকে এক ইঞ্চিও সরে দাঁড়ায়নি। দুই বার ব্যর্থ উদ্যোগ নিয়েও সুযোগ পাওয়া মাত্রই কালিনারি ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছে। আমরা ব্যবসায়ীদের ব্যবসার প্রতি মনোযোগ দেয়ার জন্যেই এই আয়োজন করেছি। কিভাবে তারা উপকৃত হতে পারবেন, কিভাবে সেবার মান বাড়ানো থেকে খাবার নিউ ট্রেন্ড ভেগান অর্থাৎ প্লান্ট বেইজড বা উদ্ভিদ ভিত্তিক মজাদার খাবার পরিবেশন করতে পারবেন সেজন্য একজন সিলেব্রিটি শেফ মৃদুলা বালজেকারকে নিয়ে এসেছি। তিনি শাকসবজি দিয়ে দুশো ধরনের ইন্ডিয়ান খাবারের একটি রেসিপি বইও প্রকাশ করেছেন। তিনি সবাইকে নতুন ট্রেন্ড ফলো করার আহবান জানান।
কারি লাইফ কালিনারি ওয়ার্কশপে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট বাঙালি শেফ ওলি খান এমবিই। টেকনোলজি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন এমন একজন শেফ ওলি খান কারি লাইফকে বলেন, টেকনোলজির ব্যবহার অবশ্যই আমাদের অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে। অনেক সুফল নিয়ে এসেছে, এফিসিয়েন্সি বৃদ্ধি করেছে। টেকনোলোজির ব্যবহার করে ব্যবসাও বাড়ানো গেছে। কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক বিষয় নজর রাখার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। অনেক ধরনের কম্বি ওভেন বেরিয়েছে এবং আমি ব্যবহারও করেছি। বিশেষ করে ছোট রেস্টুরেন্টে এগুলো ব্যবহার করে আমাদের উপমহাদেশীয় খাবারের অনেক বৈশিষ্ট বজায় রাখা যায় না বলে আমি মনে করি। যেমন তান্দুরী ওভেনে যে স্লো কুকিং এর খাটি স্বাদ পাওয়া যায় সেটা হয়তো আপনি এসব ওভেনে পাবেন না। ছোট রেসস্টুরেন্টের জন্য বড় বিনিয়োগও হয়তো আর্থিকভাবে যৌক্তিক নয়। ওলি খান, খাবার মজাদার রাখার ক্ষেত্রে শেফদের নজর রাখার আহবান জানান, কারণ মানুষ রেস্টুরেন্টে আসে অথেনটিক খাবারের জন্য, কুইক ফিক্স এর জন্য নয়।
কারি লাইফ কালিনারি ওয়ার্কশপের প্রধান আকর্ষণ ছিল সিলেব্রিটি শেফ মৃদুলা বাজকারের কুকারী ডেমনস্ট্রিশন। তিনি একটি ভেগান ডিস ও ডেজার্ট কুক করে দেখান এবং অতিথিরা তা টেস্ট করেন। সবাই আগ্রহের সাথে মৃদুলার প্রেজেন্টেশন দেখেন। মৃদুলার সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্ডিয়ান ভেগান ও ভেজিটারিয়ান খাবারের উপর লেখা দুইশো রেসিপি সম্বলিত বইটি অংশগ্রহণকারী শেফদের উপহার দেওয়া হয়। এছাড়া যে সকল শেফ ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী কারি লাইফের পক্ষ থেকে সার্টিফিকিট ও উপহার পান। তারা হলেন- শেফ সলিম জাফর উদ্দিন (দ্যা ফ্যাট বৌদ্ধ), শেফ আবুল মনসুর (তাজ কুজিন), শেফ সৈয়দ জহরুল ইসলাম ( দ্যা ক্যাপিটাল), শেফ বিজয় সিং পানওয়ার, শেফ আব্দুল কাহের (ক্রাউন কিচেন) ও ব্যবসায়ী আব্দুল রহমান (টেইস্ট অব নওয়াব)। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন জান্নাত সৈয়দ।
অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ অ্যান্ট্রেপ্রোনার সালিমা ভেল্লানি। অস্ট্রেলিয়া, ইউএসএ ও যুক্তরাজ্যে তার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকস থেকে ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের ওপর গ্রাজুয়েট ও ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্সে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী সালিমার কেম্পানির নাম এবসার্ড বার্ড ও কে বক্স গ্লবাল। এই কেম্পানির নজর এখন ইন্টারন্যাশনাল ফুড মার্কেটে
সোশ্যাল মিডিয়ার উপকারিতার ওপর বক্তব্য রাখেন সাম স্মীথ। তিনি সবাইকে সোশ্যাল মিডিয়া এক্সপার্টদের সাহায্য নেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন। কারি লাইফের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা বলেন, আমরা মানুষের সাড়ায় অভিভুত। আবহাওয়া দুযোর্গপূর্ণ থাকায় অনুষ্ঠানে সবাই এসেছেন। তিনি অতিথিদের স্বাগত জানানা এবং বলেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রির আস্থা ফিরে আসবে এটাই আমি আশা করি। মহামারির চলাকালীন ইন্ডাস্ট্রির প্রথম অনুষ্ঠান করতে যারা সহযোগীতা করেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি। বিশেষ করে বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স, ইউকেবিসিসিআই ও বিবিসিএ’র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকায় তাদেরকেও ধন্যবাদ জানান। নাহাস পাশা জানান, ডার্লিংটন, নিউক্যাসল, মানচেস্টার, বেডফোর্ড, লিডস, কেন্ট, সাসেক্স, মিডল্যান্ড এসব এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা যোগদান করে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন অনুষ্ঠানটি।
কারি লাইফের নিয়মিত অনুষ্ঠান কালিনারি ওয়ার্কশপ ২০১৯ সালের পরে এই প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। গত ১৯শে জুলাই দেশটির সরকার কভিড সংক্রান্ত অনেক বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ায় এই অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়েছে বলে জানায় আয়োজক কারি লাইফ। গত ২৭ জুন অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু লকডাউন না খোলায় তা হতে পারেনি। আগামী ১০ অক্টোবর দুই বছর পরে আবারও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কারি লাইফের বৃহত অনুষ্ঠান কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ড। লন্ডনের রয়েল ল্যাংকাস্টার হোটেলে এই অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে ব্যাপকভাবে, এবং সাড়ায় অভিভুত জানান কারি লাইফ কতৃপক্ষ। জাস্টইটের পৃষ্ঠপোষকতায় কারি লাইফ কালিনারি ওয়ার্কশপে সহযোগিতা করে, ইউনিসফট, ট্রেভেল লিংক ও কোবরা বিয়ার। অনুষ্ঠানে শেষে ক্রাউন কিচেন ক্যাটারার্সের মজাদার খাবার পরিবেশন করা হয়।