রাজধানী কায়রোর মুনিব বাস টার্মিনালের সৌচাগারের ফটকে দুই শিশু সন্তান সহ বসা প্রবাসী বাংলাদেশি তানিয়াকে দেখে যে কোন মানুষ আতকে উঠবে। মানসিক ভারসাম্যহীন প্রবাসী এই নারীর মুখ দেখে মনে হয়েছে দীর্ঘদিনের ক্ষুধার্ত। কারও সঙ্গে তেমন কোনো কথা বলছিলেন না। কেহ বিরক্ত করলে তেড়ে আসছেন মারতে। কেহ কিছু খেতে দিলে নিজে না খেয়ে তুলে দিচ্ছিলেন তার আদরের দুই সন্তানের মুখে।
তার সঙ্গে কি হয়েছে? কি কারণে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মুনিব বাস টার্মিনালের ফঠকে পরে আছেন সেটাও প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়নি। গত ২৩শে ডিসেম্বর ২০২১ স্থানীয় সময় রাত নয়টায় একটি পুলিশ ভ্যানে করে দুই শিশু সন্তান সহ তানিয়াকে কায়রোস্থ বাংলাদেশ দুতাবাসের সামনে রেখে চলে যায় এক দল পুলিশ।
খবর পেয়ে দুতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) ইসমাঈল হোসেন দ্রুত চলে আসেন তানিয়াদের কাছে ও তার সহকর্মীদের সহযোগিতায় অনেকটা জোড় পুর্বক দুতাবাসের বেসমেন্টের একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয় অসহায় প্রবাসী পরিবারটিকে। প্রথমেই কিছু খাবার ও পানীয় দিয়ে ইসমাঈল হোসেন জানতে চেষ্টা করেন কি হয়েছে তাদের সাথে। কোথায় তার স্বামী? তানিয়াকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হলে সে সঠিক উত্তর না দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে থাকেন।
পর দিন ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ তানিয়া এবং তার দুই সন্তানের জন্য শীতের কাপড়, কম্বল, শুকনো খাবার কিনে দিয়ে দুইদিন রাখা হয় দুতাবাসের নীচ তলার একটি রুমে। ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ রবিবার দাপ্তরিক কাজে বিঘ্ন ঘটতে পারে বিধায় তানিয়া এবং তার দুই সন্তানকে দূতাবাস এলাকায় আরব ঈল মা’দী নামক স্থানে প্রবাসী এক নারীর সাথে রাখা হয়।
অন্য দিকে দুতাবাসের শ্রম বিভাগ যোগাযোগ করতে থাকে মিসর সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সাথে। ২৮শে ডিসেম্বর তানিয়াকে আশ্রয় দাতা প্রবাসী নারী দুতাবাসে টেলিফোন করে জানিয়ে দেন যে, তার বাসায় মানসিক ভারসাম্যহীন তানিয়াকে রাখা সম্ভব নয়। কারন, মানসিক অসুস্থ হওয়ায় বাসা নোংরা, কাপর নষ্ট, জিনিসপত্র ভাঙ্গা, বিভিন্ন অলংকার নষ্ট, কম্বল, চাদর, রান্না ঘর. বাথরুমসহ পুরো বাসা এলোমেলো করে ফেলেছে সে।
এক কথায় বাসাটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাছাড়া ও কেহ বাসায় তার সাথে দেখা করতে গেলে কিংবা খাবার দিতে গেলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে তানিয়া। তাই থাকে অন্য কোথাও স্থানান্তর করার অনুরোধ করেন। অবস্থা অবনতি হওয়ায় প্রথম সচিব (শ্রম) বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে কায়রো বিমান বন্দরের কাছে মার্গ এলাকায় একটি খালি বাসার সন্ধান পান। মার্গের বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নূর নবীর সাথে কথা বলে অসুস্থ তানিয়াকে তার দুই সন্তানসহ শ্রম কল্যাণ বিভাগ এর গাড়ি যোগে আরব ঈল- মা’দী থেকে মার্গে স্থানান্তর করেন।
প্রথম সচিব (শ্রম) ঈসমাইল হোসেন জানান, কায়রো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের সাথে সাক্ষাৎ করে তিনি জানতে পারেন যে, গত ২০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখ তারা ৪ জন মিসর হতে বাংলাদেশে যাওয়ার লক্ষে কায়রো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গমন করে। বিমান বন্দররে পুলিশের নিকট আল- আমিন নামে একজন বাংলাদেশির নাম রেড লিস্টে থাকায় আল আমিনকে পুলিশ আটক করে। আল আমিনের স্ত্রী তানিয়া এবং দুই সন্তানকে বিমান বন্দরের পুলিশ বাংলাদেশে পাঠাতে চায়।
কিন্তু তানিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় তার সন্তানদের নিয়ে বাংলাদেশে যাবে না মর্মে জানিয়ে দেয় ও অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্য বিমান বন্দর ত্যাগ করে। ইমিগ্রেশন কতৃপক্ষ আরো জানান, মিসর জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা হতে ছাড়পত্র পাওয়া গেলে তানিয়ার স্বামী আল আমিন বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি পাবেন।
মিসরের বন্দর নগরী শহর আলেক্সান্দ্রিয়ার পোশাক শিল্পের শ্রমিক আল-আমিনকে তার স্ত্রীর সার্বিক বিষয় অবহিত করা হলে এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার নিকট হস্তান্তর করার বিষয়ে জানানো হলে, আল আমিন তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার অধীনে না দিয়ে তাদেরকে দেশে পাঠানোর জন্য দুতাবাসকে সহযোগিতা করতে অনুরোধ করেন।
অবশেষে, মিসরের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগ সহ কোথাও তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় কায়রোস্থ নুজহাত আদালতের রায়ে ও বাংলাদেশ দুতাবাসের সার্বিক সহযোগিতায় গতকাল ৯ জানুয়ারি ২০২২ আল আমিন, তানিয়া এবং তাদের দুই শিশু সন্তান বিমানযোগে বাংলাদেশের উদ্দেশ্য মিসর ত্যাগ করেন ।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তারা নিরাপদে বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪:৫৫মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দর পৌঁছান ও তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যান।
আল আমিন এর টিকানা- পিতা হাবিবুর রহমান, গ্রাম- সারে পাঁছানী, থানা- উত্তর মতলব, জেলা- চাঁদপুর।