Site icon World 24 News Network

ভালোবাসা আসলেই কার জন্য ?!

মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে ভালোবাসা দান করেছেন। এই ভালোবাসা মূলত তাঁর সৃষ্টিকে টিকে রাখার জন্যই। সন্তানের প্রতি বাবা-মার, বাবা-মার প্রতি সন্তানের ও স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা প্রকৃতিজাত এবং যা প্রকৃতিজাত তাই ইসলাম।

প্রকৃতির রাজ্যে গাছ-গাছালি, পশু-পাখি, জীব-জানোয়ার এককথায় আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টির প্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ও সেটি উপভোগ করা এবং তা থেকে উপকৃত হওয়া বান্দার অধিকার। আল্লাহপাক এই পৃথিবীকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করেছেন এবং এর সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি করেছেন তীব্র আকর্ষণ। মানুষ আল্লাহর এই সৃষ্টিকে ভালোবাসবে এবং কৃতজ্ঞতায় তাঁর প্রতি অবনত হবে, এটিই স্বাভাবিক। দুর্ভাগ্য, অজ্ঞতা ও শয়তানের প্ররোচনায় স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে অনেক সময় মানুষ সৃষ্টির পূজারি হয় এবং এরই নাম শিরক। কুরআন মজিদ খুলে আমরা প্রথম যে শব্দটি পাই, সেটি হলো ‘আলহামদু লিল্লাহ’। এই শব্দটির মাধ্যমে ব্যক্তিপূজা ও সৃষ্টিপূজার মূলোত্পাটন করা হয়েছে।

মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার সবচেয়ে বড় হকদার হলেন মহান স্রষ্টা আল্লাহ রব্বুল আলামিন। আর সকল ভালোবাসা হতে হবে তাঁর অধীন। কারো প্রতি ভালোবাসা তাঁকে ছাড়িয়ে গেলে সেটি হয়ে যায় শিরক। ভালোবাসা একটি প্রকৃতিগত এবং অন্যটি আইনগত। স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির ভালোবাসা অনেকখানি প্রকৃতিগত। নিরেট নাস্তিক না হলে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধা অধিকাংশ মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যায়। আইনগত হলো আখিরাতে নাজাতের লক্ষ্যে আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসা। এমতাবস্থায় মানুষ আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর নাফরমানি পরিহার করে আনুগত্য করবে। সুরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থসম্পদ ব্যয় করে। অর্থাৎ মানুষের কাছে কোনো বিনিময় প্রত্যাশা করে না। মানুষের নেক আমল তখনই নেক আমল হয় যার পশ্চাতে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি বা ভালোবাসা।

মানুষ আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় সৃষ্টি। মানুষের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রসুল আল্লাহ তায়ালা প্রেরণ করেছেন এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নবি-রসুলদের আনুগত্য অপরিহার্য করে দিয়েছেন। সর্বশেষ নবি ও রসুল হলেন আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.। তাঁর জীবনাদর্শের মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ এবং আল্লাহর ভালোবাসা তখনই সম্ভব যখন মুহাম্মদ সা.-কে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা হয়। (এ প্রসঙ্গে ভিন্নতর আলোচনা করবো ইনশা-আল্লাহ; আজকে আলোচনা করবো সামাজিক জীবন নিয়ে)।

মাতা-পিতা, স্বামী/স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয়- স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, সহপাঠী, সহকর্মী ও সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সদাচরণ মানুষের প্রকৃতিতে দিয়ে রাখার সাথে সাথে আল্লাহপাকের নির্দেশও রয়েছে। এতে রয়েছে প্রভূত সওয়াব এবং অন্যথা হলে রয়েছে গুনাহ। যেমন, মাতাপিতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশনা কুরআন-হাদিসে অসংখ্য রয়েছে। তাঁরা জান্নাতে যাওয়ার সিঁড়ি। বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদের সম্মুখে উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ করা যাবে না। সবসময় বিনয় ও দয়ার আচরণ করার তাগিদ রয়েছে।

স্বামী-স্ত্রীর বিষয়টিও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী-স্ত্রীর মর্যাদা আল্লাহপাক নির্ধারণ করেছেন বন্ধু ও সাথী এবং পরস্পর পরিচ্ছদ হিসেবে। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সদাচরণের উপর জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিয়ামতের দিন স্ত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে এবং তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আবার স্ত্রী সম্পর্কে বলা হয়েছে আল্লাহর হক পালনের সাথে যে নারী তার স্বামীর হক আদায় করে সে নারীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে বলা হয়েছে যে দরজা দিয়ে খুশি সে জান্নাতে প্রবেশ করুক।

বর্তমানে আমাদের দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবন নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দাম্পত্য জীবন তো এজন্যই, স্বামী-স্ত্রী পরস্পর থেকে সুখ-শান্তি ও পরিতৃপ্তি লাভ করবে। পাশ্চাত্যের মতো আমাদের পারিবারিক জীবন ধ্বংসের মুখোমুখি। অথচ আল্লাহপাক আমাদের দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘পরোয়ারদেগার! স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা আমাদের চোখকে শীতল করে দাও।’ দাম্পত্যকলহ খুবই স্বাভাবিক। আমাদের রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনেও ঘটেছিল। এমন কিছু ঘটলে দ্রুত মিটিয়ে ফেলার তাগিদ রয়েছে এবং মিটিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে যে প্রথমে এগিয়ে আসবে সে অশেষ সওয়াবের ভাগিদার হবে।

মনে রাখতে হবে, আজকের বধূ আগামী দিনের মা ও শাশুড়ি। আরো মনে রাখতে হবে, স্বামী/স্ত্রী আমাদের সন্তানদের বাবা-মা। ফলে সন্তানের স্বার্থটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের রোগ- ব্যাধিতে মা-বাবা বিনিদ্র রজনী যাপন করে। কিন্তু সেই বয়স অতিক্রম করলে রোগ-ব্যাধি ও দুঃখ-কষ্টে আজীবন পরস্পর সাথী হন স্বামী-স্ত্রী। দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনে সুখ দুনিয়ার জীবনে সর্বোত্তম প্রাপ্তি। এজন্য প্রয়োজন পরস্পর ছাড় দিয়ে চলা, ত্যাগ স্বীকার ও ক্ষমাশীল আচরণ করা।

আত্মীয়-স্বজনসহ সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা পোষণও ইসলামের নির্দেশ। জমিনে যারা আছে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করো তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। আল্লাহর পরিবারের সদস্যদের সাথে সদাচরণ করলে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যাবে। ইতর প্রাণীও সদাচরণ পাওয়ার হকদার। একটি বিড়াল ছানার প্রতি ভালোবাসার কারণে আব্দুর রহমান হয়ে গেলেন আবু হুরায়রা। পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পানের বিনিময়ে এক মহিলা পেলেন ক্ষমার ঘোষণা। তাহলে উপলব্ধি করা যায়, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমে স্রষ্টার ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব।

আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড রয়েছে। ভালোবাসা হতে হবে আল্লাহরই জন্য। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহরই জন্য কাউকে ভালোবাসলো ও আল্লাহরই জন্য কারো সঙ্গে শত্রুতা করলো এবং আল্লাহরই জন্য কাউকে কিছু দান করলো ও আল্লাহরই জন্য কাউকে কিছু দেয়া থেকে বিরত থাকলো সে তার ঈমান পূর্ণ করলো। আবার আল্লাহ বলেছেন, তোমরা পিতা ও ভাইকেও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে না যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে অধিক ভালোবাসে। এতে বোঝা যায়, আল্লাহর কোনো শত্রু মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না। অবশ্য উত্তম ব্যবহার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো শত্রু-মিত্র নেই।

ভালোবাসা বলতেই আমাদের দৃষ্টিতে ছেলে-মেয়ের মাঝে প্রেম-প্রীতি, ভালোলাগা, ভালোবাসা মনে হয়। হ্যাঁ, ছেলে-মেয়ের মাঝেও এই ভালোবাসা দোষের কিছু নেই যদি তা সীমা অতিক্রম না করে। এই ভালোবাসা দেখা-সাক্ষাতে হতে পারে, ফেসবুকে হতে পারে বা কারো কাছে শুনেও হতে পারে। এই ভালোবাসার পেছনে যদি উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর নির্ধারিত সীমা মেনে পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখি জীবন যাপন করা, তাহলে সেটা হবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা। জনৈক সাহাবি রসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে এসে বলেন, আমি অমুক মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। জবাবে তিনি বলেন, তুমি কি তাকে দেখেছ?

বর্তমান সমাজ বড় জটিল। পরস্পরকে দেখা, ভালো লাগার দিকগুলো খুঁজে বের করা, পছন্দ করা সবই বৈধ। আজীবনের জন্য জীবনসঙ্গী করার ক্ষেত্রে ছেলেদের মধ্যে মাদকাশক্তি, স্বভাব-চরিত্র-আচরণ, রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে জানার অধিকার একটি মেয়ের থাকতেই পারে আবার ছেলেরও মেয়ে সম্পর্কে তার আচার-আচরণ জানার অধিকার রয়েছে। এব্যাপারে উভয়ের অভিভাবকের দায়িত্ব ছেলে-মেয়েদের পরস্পরকে পছন্দ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। অবশ্য সন্দেহপ্রবণ হওয়া ও অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে বেড়ানো নিন্দনীয়। আবার বিয়ে-সাদীর পরেও অনেক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই আল্লাহর উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

ইসলামে বিয়েকে সহজ ও অনাড়ম্বর করা হয়েছে। দুজন বয়োপ্রাপ্ত নর ও নারী দুজন সাক্ষীর মোকাবেলায় পরস্পর ইজাব কবুল করলেই বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু সেটি হতে হবে প্রকাশ্যে এবং মহল্লাবাসী বা পরিচিত জনরা তা জানবে। আমাদের ঐতিহ্য হলো ছেলে- মেয়ের পছন্দ হলে তা অভিভাবককে অবহিত করা বা অভিভাবকের পছন্দ হলে ছেলে-মেয়ের সম্মতি নেয়া। ছেলে-মেয়ের সম্মতির প্রয়োজন অনুভব না করে অভিভাবকের একতরফা সিদ্ধান্তে অনেক সময় ছেলে-মেয়ে সম্মতি জানায়, এতে বিয়ের শর্ত পূরণে কোনো সমস্যা নেই। তবে এটি ঝুঁকিপূর্ণ। দায়দায়িত্ব সব অভিভাবকের ওপরই বর্তায়।

ছেলে-মেয়ের পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া না হলে প্রায়ই তারা বেঁকে বসে এবং তখনই ঘটে বিপত্তি। এতে অনেক সময় তারা বিয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং অভিভাবককে শাস্তি দান করতে গিয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের প্রতিই জুলুম করে। জিদ ও হটকারিতা কোনো অবস্থাতেই ভালো নয়। এমন অবস্থায় প্রয়োজন ছেলে-মেয়েকে ধৈর্য ধারণ করা এবং ধৈর্যের বিনিময়ে রয়েছে পুরস্কার। সবচেয়ে ভালো হয় তকদিরকে মেনে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা।
দুনিয়ার জীবনটা খুবই সংক্ষিপ্ত। প্রয়োজন আবেগকে সংযত করে বাস্তবতায় ফিরে আসা।

নানা কারণে ডিভোর্সের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখলাম ৭০% ডিভোর্স ঘটে মেয়েদের চাওয়ার প্রেক্ষিতে। অন্যতম কারণ হতে পারে মেয়েদের মতামতের প্রতি গুরুত্ব প্রদান না করা। ডিভোর্স হলে ছেলে-মেয়ে উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি একটি বড় সামাজিক সমস্যা। এব্যাপারে ছেলে-মেয়ে ও অভিভাবক উভয়কেই ভাবতে হবে। জিদ ও আবেকপ্রবণতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলে সমস্যার সমাধান অনেকখানি সম্ভব। আল্লাহপাক আমাদেরকে সাহায্য করুন।

Exit mobile version