আল্লাহ তায়ালা চান তাঁর বান্দারা তাঁরই মতো হবে উদার ও প্রশস্ততার অধিকারী। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। মানুষ অন্যায় করবে আর ধরে ধরে জাহান্নাম পূর্ণ করবেন, এটি আল্লাহর অভিপ্রায় নয়। বান্দা ভালো কাজের নিয়ত করলেই সওয়াব এবং কর্ম সম্পাদন করলে তার সওয়াব দশ থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে মন্দ কাজে নিয়ত করলে কোনো গুনাহ নেই। মন্দ কাজ করলে সমপরিমাণ গুনাহ লেখা হয় এবং গুনাহ করে তওবা করলে সেই গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। ছোট গুনাসমূহ ভালো কাজের বিনিময়ে এমনিতেই ক্ষমা করে দেয়া হয়। এটি বান্দার প্রতি আল্লাহর উদারতা ও ক্ষমাশীলতারই বহিপ্রকাশ।
আল্লাহপাক তাঁর বান্দার মধ্যে উদারতা ও ক্ষমাশীলতার গুণ দেখতে চান। মানুষ তো তাঁরই প্রতিনিধি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কার্পণ্য ও সংকীর্ণতার ঊর্দ্ধে দেখতে চান এবং কল্যাণ ও সাফল্য রয়েছে উদারতার মধ্যে। তাঁর বাণী- ‘যে ব্যক্তি স্বীয় মনের সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সে-ই কল্যাণ লাভ করলো’- সূরা তাগাবুন ১৬।
‘যেসব লোককে তাদের মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফলকাম’- সূরা হাশর ০৯।
শুহ্-হা শব্দটি আরবি ভাষায় অতি কৃপণতা ও বখিলি বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এর সাথে নাফসিহি যোগ হওয়ায় তখন তা দৃষ্টি ও মনের সংকীর্ণতা, পরশ্রীকাতরতা এবং মনের নীচতার সমার্থক হয়ে যায়। যাদের অন্তর বা মন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে তারা মানুষের গুণের প্রশংসা করতে পারে না। অন্যদের দেয়া দূরের কথা, কেউ কাউকে দিক সেটাও পছন্দ করে না। রসুল সা. মনের সংকীর্ণতাকে নিকৃষ্টতম স্বভাব বলে গণ্য করেছেন যা সকল বিপর্যয়ের উৎস।
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. রসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তোমরা শুহ্-হা (সংকীর্ণতা) থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কারণ এটিই তোমাদের পূর্বের লোকদের ধ্বংস করেছে। এটিই তাদেরকে পরস্পরের রক্তপাত ঘটাতে এবং অপরের মর্যাদাহানি নিজের জন্য বৈধ মনে করে নিতে মানুষকে প্ররোচিত করেছে। এটিই তাদের জুলুম করতে উদ্বুদ্ধ করেছে, তাই তারা জুলুম করেছে। পাপের নির্দেশ দিয়েছে, তাই পাপ করেছে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতে বলেছে, তাই তারা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছে।
আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন। নবি করিম সা. বলেছেন, ‘ঈমান ও মনের সংকীর্ণতা একই সাথে কারো মধ্যে অবস্থান করতে পারে না’ (ইবনে আবি শায়বা, নাসায়ী)।
আবু সাঈদ খুদরি বর্ণনা করেন, নবি সা. বলেছেন : ‘দু’টি স্বভাব এমন যা কোনো মুসলমানের থাকতে পারে না, তা হলো কৃপণতা ও দুশ্চরিত্রতা’- আবু দাউদ, তিরমিযী, বুখারি।
রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, কৃপণ ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। টাকা-পয়সা খরচে কৃপণ বড় কথা নয়; মনের কার্পণ্য ভয়ঙ্কর। এখানে মনের সংকীর্ণতা উদারতা-প্রশস্ততার বিপরীতে ব্যবহৃত হয়েছে। সংকীর্ণ ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বত্রই সমস্যা সৃষ্টি করে।
মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ এবং একে অপরের প্রতি জুলুম-নির্যাতনের মূলে রয়েছে সংকীর্ণতা। মানুষকে ক্ষমা করার জন্য প্রয়োজন হৃদয়ের প্রশস্ততা। সংকীর্ণ মানুষ ক্ষমা করতে জানে না। সে তার নিজের দোষ দেখে না, শুধু অপরের দোষ তালাশ করে এবং শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকায় অন্যান্যদের ছোট ভাবে। সে শুধু নিজের প্রশংসা শুনতে চায়। তার চতুর্দিকে জড়ো হয় চাটুকার।
বাংলাদেশে ক্ষমা নয়, হিংসার চাষ হয় এবং মনে করা হয়, আমিই সেরা। এ যেন আরব জাহিলিয়াতকেও ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে ছিল বংশ পরম্পরায় ঝগড়া-বিবাদ ও মারামারি; আমাদেরও তাই। নেলসন মেন্ডেলরা অমুসলিম হয়ে যা পারে আমরা পরকালে বিশ্বাসী হয়েও তা পারি না। ধিক এ-সব মুসলিম নামধারী শয়তানের অনুসারীদের। লাইলাতুল কদরসহ বিশেষ বিশেষ রাতে আল্লাহপাক তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন। বাদ থাকে কেবল মুশরিক ও হিংসুক।
যে ক্ষমা করবে সে আল্লাহর ক্ষমা পাবে। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, দুনিয়ায় যে তার ভাইকে ক্ষমা করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে ক্ষমা করবেন। হ্যাঁ, প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ আছে কিন্তু একেবারে মেপে মেপে। আল্লাহর বাণী, ‘অন্যায়ের প্রতিবিধান সমপরিমাণ অন্যায়; কিন্তু যে ক্ষমা করে ও সংশোধন করে নেয় তার পুরস্কার আল্লাহর জিম্মায়। আল্লাহ জালেমদের পছন্দ করেন না’- সূরা শূরা ৪০।
আমাদের সমাজের ধারণা ক্ষমা করা দুর্বলতা। কিন্তু আল্লাহ বলেন ভিন্ন। তাঁর বাণী, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে এবং মানুষদের ক্ষমা করে দেয় (সে যেন জেনে রাখে), অবশ্যই এটা হচ্ছে সাহসিকতার কাজসমূহের অন্যতম’- সূরা শূরা ৪৩। ক্ষমা করা সহজ কাজ নয়। সংকীর্ণদের পক্ষে তো নয়ই, ক্ষমা করার জন্য প্রয়োজন মনের ঔদার্য ও আল্লাহপাকের অনুগ্রহ।
একজন মুসলমান তার হন্তাকেও ক্ষমা করতে পারে। সেটি আল্লাহপাক সূরা ইয়াসিনে (১৩-৩০) বর্ণনা করেছেন, একটি জনপদে তিনজন রসুল পাঠানো হয়েছিল। তাঁদের চেষ্টায় একজন ব্যক্তি মুসলমান হলে সেই আল্লাহর বান্দা তাঁর জাতির কাছে এসে দাওয়াত দিলে তারা তাঁকে হত্যা করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়, দাখিল হও জান্নাতে। সে সময়ে তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়, ‘হায়! আমার জাতির লোকেরা যদি বুঝতো কিসের বদৌলতে আমার রব আমাকে ক্ষমা করলেন ও সম্মানিত লোকদের মধ্যে গণ্য করলেন’। কোনো অভিশাপ নয়, বদ দোয়া নয় বরং মৃত্যুর সময়ও এই শরিফ ব্যক্তিটি তাঁর হন্তাদের কল্যাণ কামনা করেছেন। একজন ঈমানদার ব্যক্তির হত্যার বদৌলতে আল্লাহপাক সেই জাতিকে ধ্বংস করে দেন। শত জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে আল্লাহর একদল বান্দা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকেন বলেই তিনি পৃথিবীকে টিকিয়ে রেখেছেন।
আল্লাহপাক আমাদেরকে সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে উদার হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।