শিক্ষানীতির রুহানিয়্যাত ও শিক্ষার অধিকার

মানব পরিচয়ের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য শিক্ষা । ‘মানব পরিচয়ে জন্মেছে যে, শিক্ষার আলোতে বাড়বে সে’ – এই নীতির ভিত্তিতে একটি জাতি তার পরিচয় তুলে ধরবে এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু শিক্ষার প্রশ্নে আমরা এখনো মানবতা ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিতই রয়েছি প্রকৃত অর্থে ।

পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার চেতনা আছে, সমাজ আছে, সভ্যতা আছে । সৃষ্টিগত ভাবেই মানব মস্তিষ্ক চিন্তা করার গুণ ও যোগ্যতা অর্জন করে । আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী সে ক্ষমতা পায় নি । দার্শনিকদের অনেকে তাই বলেছেনঃ ‘মানুষ বাকশক্তি সম্পন্ন প্রাণী’।

সেজন্যে সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের সাথে অন্য সকল প্রাণীর একটা মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় । মানুষ ছাড়া প্রায় সকল প্রাণীই প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে । কিন্তু মানুষ তা করে নি । বরং নিজের বাঁচার ও বিকাশের উপযোগী করে প্রাকৃতিক ও সামাজিক অবরুদ্ধ পরিবেশকে পাল্টাবার সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাঁচতে চেয়েছে । ভাঙ্গা ও গড়ার এই শ্রমসাধ্য কাজের সামনে দেখা দেয়া অসঙ্গতি দূর করতে করতে এগিয়েছে ।

সভ্যতা বিকাশের প্রয়োজনে , প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণের সীমা এবং সীমানা নির্ধারণ করতে করতে মানুষ মানবিক সম্পর্ক , প্রেম-ভালবাসা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত সংস্কৃতির আদি বুনিয়াদ গড়ে তোলে । সব কিছু মিলে জগত ও জীবন সম্পর্কিত এ বাস্তব ধারণাগুলোকেই আমরা বলি জ্ঞান বা শিক্ষা । এ শিক্ষা মানুষকে মানুষে পরিণত করেছে । আদিম থেকে আধুনিক করেছে ।

শিক্ষা মানুষকে দিয়েছে মনুষ্যত্ব , দিয়েছে উৎপাদন বিকাশের নিপুণ দক্ষতা । শিক্ষা মানুষকে সামাজিক অনাচার প্রতিহত করার শক্তি-সাহস যুগিয়েছে ; সংস্কৃতিমান করে গড়ে তুলেছে । সেজন্যেই শিক্ষার অধিকার অর্জনের মধ্য দিয়েই মানুষ মনুষ্যত্ব অর্জনের অধিকারী হয় । আর এ জন্যই শিক্ষার অধিকার মানবিক ।

সামাজিক চেতনা ও সমাজবিজ্ঞান বিকাশের ধারাকে অব্যাহত রেখে মানুষ শিক্ষার আলোকে বিস্তৃত করেছে এবং সমাজ সভ্যতা বিকাশের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করেছে । অক্লান্ত শ্রমের মধ্য দিয়ে মানুষ সমাজজীবন ও বস্তুজগতের বিকাশের নিয়ম সম্পর্কিত জ্ঞান ও শিক্ষা আয়ত্ব করেছে । মানবজাতির জ্ঞান ভাণ্ডার নানা শৃঙ্খলায় সাজানো ও বিন্যস্ত হয়ে আছে।

বস্তুতঃ শিক্ষাই মানুষকে পৃথক করে দিয়েছে পশু থেকে , মুক্ত করেছে পশুত্ব থেকে । সমাজে সুশিক্ষা যত বেশি প্রসারিত , সে-সমাজ ততো আলোকিত , সুসংগঠিত-সুসংহত । উচ্চতর মানবিক শিক্ষা ছাড়া উন্নত মানবিক সমাজ হয় না , শেষ পর্যন্ত সভ্যতা টিকে থাকে না , সমাজে নৈতিক শৃঙ্খলা আসে না । মানুষ পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।

ফরাসী চিন্তাবিদ রুশো বলেছেন, “আমাদের জন্মকালীন ত্রুটি , পূর্ণ মনুষ্যত্ব লাভে আমাদের যা কিছু প্রয়োজন , সে সবই পূরণ করে শিক্ষা” । গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন , “অশিক্ষিত মানুষ অপেক্ষা শিক্ষিত মানুষ ঠিক ততটাই উৎকর্ষের অধিকারী , যতটা জড় অপেক্ষা জীব”। 

অতএব, শিক্ষার অধিকার থেকে কোন মানুষকে বঞ্চিত করা মানেই তাকে আদিমতায় তথা পশুর স্তরে ঠেলে দেয়া ; শিক্ষাহীন মানব-আকৃতির প্রাণীতে পরিণত করা । যে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থা মানুষকে সর্বাঙ্গীণ বিকাশোপযোগী শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে , সে-সমাজ ও রাষ্ট্র মানবিক হতে পারে না , মনুষ্যত্ব ও সভ্যতা সংরক্ষণের সমাজ হতে পারে না কিংবা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে পারে না । ফলে কোন খোঁড়া যুক্তিতেই একজন মানুষকেও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না । আর এখানেই খুঁজতে হবে আমাদের শিক্ষানীতির রুহানিয়্যাত।

সূত্র
শিক্ষানীতি ও শিক্ষা সংকট প্রসঙ্গে – খালেকুজ্জামান

ঈসা আহমাদ ইসহাক

সহযোগী সম্পাদক : নিউজ বিভাগ এবং প্রধান অনুবাদক: আরবী বিভাগ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button