বিজয়ের ৫০

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ২০২১

বিশেষ দ্রষ্টব্য
  • লেখক : কথাসাহিত্যিক

৫০টি বছর তো আর কম সময় নয়! পাঁচটি দশক, ১০টি পঞ্চবার্ষিক। এত বছরে মানুষের জীবন প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়। প্রৌঢ়ত্ব বোধ হয় সোনার মতো দামি। এ জন্য ৫০ বছর পূর্তিকে সুবর্ণ জয়ন্তী বলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ সুবর্ণ আভায় সমুজ্জ্বল।

স্বাধীনতা কী? শামসুর রাহমান এই প্রশ্নের উত্তর লিখে গেছেন ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায়। বলেছেন—‘স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা, ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি। মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী। কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা। পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন’ ইত্যাদি। স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে কবি রাঙা পোস্টারের কথা বলেছেন, বলেছেন মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিকের কথা, গৃহিণীর ঘন কালো চুলের কথা, স্লোগানমুখর মিছিলের কথা, বোনের হাতের মেহেদি রঙের কথা। আমার কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে এই লাইনটি—‘স্বাধীনতা তুমি/উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।’ এটি সবচেয়ে মোক্ষম একটি বাক্য। বাঙালির হৃদয়চিত্র যেন এই বাক্যে খোদিত হয়ে আছে। এই পঙক্তিতে স্বাধীনতা, মা এবং মাতৃভূমি একাকার হয়ে গেছে। ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতিতে এ কথাটি বহু আগে লিখিত হয়ে আছে—জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী। জননী আর জন্মভূমির কাছে স্বর্গও অতি তুচ্ছ বস্তু। বাঙালিরাও এটা অক্ষরে অক্ষরে অনুধাবন করতে পেরেছিল যে মায়ের বাড়া নেই, নিজ দেশের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। বাঙালির কাছে মা ও দেশ সমমূল্যের, সমমর্যাদার হয়ে গেছে। তাই তো আমাদের দেশকে আমরা মাতৃভূমি বলি, বাংলাকে আমরা মাতৃভাষা বলি।

মাতৃভূমির সঙ্গে স্বাধীনতা শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাধীনতার মর্যাদা মানে মায়ের মর্যাদা। দেশকে অবহেলা দেখালে স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আজ যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেন, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ঘাটতি কী? সবচেয়ে বেশি অভাব কিসের? আমি বলব, আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় খামতি দেশপ্রেমের।  পৃথিবীর অন্য সব দেশে, সে ধনী হোক বা দরিদ্র, মানুষের জীবনে প্রাচুর্য থাকুক বা অভাব, সে দেশের মানুষের বুকের তলায় দেশপ্রেমের অভাব নেই। আমাদের দেশে তার বড় টানাটানি। নইলে কেন ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েনের জন্য আগ-পিছ না ভেবে আমরা দেশকেই দায়ী করে বসি? নিজের অপরাধ দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে দ্বিধা করি না? দেশপ্রীতি যদি থাকত আমাদের, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের খেলায় বাংলাদেশকে নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতাম না, দিতাম না পাকিস্তানি জার্সি গায়ে। এ কিসের আলামত? এ হলো দেশপ্রেমের ঘাটতির নিদর্শন। এ দেশের আপামর জনগণের বুকের তলায় তাহলে কি দেশপ্রেমের স্রোত বইছে না? যদি বয়ে থাকে, তাহলে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো কিসের সংকেত? অশনিসংকেত? আর বাংলার মাটিতে পাকিস্তান-অনুরাগী এরা কারা? তাদের শুলুকসন্ধান করা দরকার।

আমার বক্তব্য এটা যে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নানা দল ও মত থাকতে পারে। রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে ভিন্ন মত থাকার তো কথা নয়! স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব তো সবাই চায়! যদি তা-ই হয়, তাহলে পাকিস্তানি পতাকাবাহীরা কারা? কোন দলের তারা? এ দেশের জল-হাওয়ায় বড় হয়ে, এ দেশের মাছ-ভাত খেয়ে, এ দেশে পড়াশোনা করে, এ দেশে চাকরি করে পাকিস্তানিদের জয়ধ্বনিতে মুখর হলো কারা? এবং কেন?

ওরা কি জানে না কত গহিনতর লাঞ্ছনার বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি? কত প্রাণ উৎসর্গের বিনিময়ে স্বাধীনতা আমাদের হয়েছে? আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি, তারা তো জানি, এক সমুদ্র রক্ত সাঁতরে স্বাধীনতার কূলে উঠেছি আমরা। চোখের সামনেই আমাদের মা-বোন, কাকি-মাসি, ভাগ্নি-ফুফুকে লাঞ্ছিত-ধর্ষিত হতে দেখেছি। আমাদেরই সামনে আমাদের বাবা-চাচাকে, ফুফা-খালুকে হত্যা করেছে পাকিরা। তাদের দোসর হয়েছে এ দেশের রাজাকার-আলশামসরা। পাকিরা পরাজিত হয়েছে, দেশত্যাগ করে গেছে; কিন্তু রয়ে গেছে সেই স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর-রাজাকাররা। তাদের সন্তানরা আজ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইবে কেন? তারা তো স্বস্তি পাবে ‘পাক সার জমিনে’!

অথচ এই সোনার বাংলার জন্য, এই স্বাধীনতার জন্য কী নিদারুণ মূল্য চুকাতে হয়েছে আমাদের! এ দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উচ্চ পদের অফিসার-দিনমজুর, চাষি-মাঝি-ধোপা-ঠেলাওয়ালা-রিকশাওয়ালা কার না অবদান আছে এই স্বাধীনতায়! কবি শামসুর রাহমানের কাছে আবার ফিরে যাই। তিনি লিখেছেন, ‘তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা/সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।’ আমি হরিদাসীকে চিনি না, জানি না জেলেপাড়ার সেই সাহসী কেষ্টদাসকে। আমি চিনি উত্তর পতেঙ্গা জেলেপাড়ার বিজয় জলদাসের বউ রাজবালাকে, আমি জানি কৃষ্ণপদের সহোদরা কৌশল্যাকে। এরাই তো নিজেদের সম্ভ্রম দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা এনে দিয়েছে!

যুদ্ধ শুরু হয়েছে যখন, অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি আমরা। আমাদের পাড়াটি উত্তর পতেঙ্গার একটেরে, সমুদ্রকূল ঘেঁষে। ভদ্র-সুধীসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন আমরা। সংকটে গাঁ ছেড়ে পালাল হিন্দু-মুসলমানরা। একটেরে বলে, বিচ্ছিন্ন বলে আমাদের বাপ-দাদারা তৎক্ষণাৎ জানতে পারল না পালানোর সংবাদটি। জানল যখন, তখন পালানোর পথ নেই আমাদের। আমরা, মানে জেলেপাড়াটি তখন চারদিক থেকে অবরুদ্ধ। মিলিটারিরা ঘিরে ফেলেছে তখন জেলেপাড়া। তাদের পুকুরের মাছ হয়েছি আমরা, তাদের যথেচ্ছ ব্যবহারের সামগ্রী হয়েছে এই জেলেপাড়ার রমণীরা। বারবার লাঞ্ছিত হয়েছে রাজবালা, যশোদা, হাঁইচনি, সোহাগী, মঙ্গলীরা। তাদের বিলাপে-হাহাকারে জেলেপাড়ার বাতাস ভারী হয়েছে। এরা কারা? এরাও মুক্তির যোদ্ধা। অস্ত্র তুলে নেয়নি এরা হাতে, শত্রুকে মেরে বা নিজের অঙ্গ হারিয়ে অথবা প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতার জন্য এরা যুদ্ধ করেনি ঠিক; কিন্তু দেশের জন্য সম্ভ্রম-সতীত্ব তো দিয়েছে! এদের মূল্য কি কম? এদের সম্ভ্রমের মহার্ঘ কি হেলাফেলার?

আমি আজও যখন আমার পাড়ায় যাই রাজবালাকে কাঁদতে দেখি। নীরবে গুনগুন করে কাঁদে রাজবালা। দাওয়ায় বসে গালে হাত দিয়ে উদাস চোখে কেঁদে যায় সে। তার ভরা সংসার। দু-দুটি ছেলে তার। বঙ্গোসাগরে নৌকা ভাসে তাদের। উঠানে নৌকাভর্তি মাছ আসে। ভাত-কাপড়ের অভাব নেই এখন রাজবালার। তবু রাজবালা কাঁদে। প্রাচুর্যের মধ্যেও কাঁদে রাজবালা। কেন কাঁদে? কাঁদে তার একদা হারানো সম্ভ্রমের জন্য। হয়তো এও ভেবে কাঁদে, তার ধর্ষিত জীবনের বিনিময়ে অর্জিত যে বাংলাদেশ, তাতে আজও কিছু মানুষ বিতর্ক করে বাংলাদেশের জনক নিয়ে, কিছু মানুষ পাকিস্তানি পতাকা হাতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধপক্ষ পাকিস্তানের সাপোর্ট করে যায় বলে, যাচ্ছে বলে। এই দেশ থেকে রাজবালাদের কান্না থামবে কবে? জানি না।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর কোন বাংলাদেশ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে এসেছিল? দলিত, মথিত, লাঞ্ছিত, বিধ্বস্ত এক বাংলাদেশ পেয়েছিলেন তিনি। এ দেশের অর্থনীতির কোমর ভেঙে তখন চুরমার, যোগাযোগব্যবস্থার পাঁজর ভেঙে খণ্ড-বিখণ্ড। অভাব আর অসহায়তার বন্ধুর পথে তখন এ দেশের মানুষ হামাগুড়ি দিচ্ছে। এদের টেনে তুলে দাঁড় করানোর শপথ নিয়েছিলেন শেখ মুজিব; কিন্তু তাঁর চারদিকে তখন হায়েনার কিলবিলানি। হায়েনাদের উপেক্ষা করে বাঙালির এবং বাঙালির চেতনার উজ্জীবন ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্তব্ধ করে দেওয়া হলো তাঁকে। দেশজুড়ে ঘনিয়ে এলো অমাবস্যার অন্ধকার। মুকুট বদল হলো, আদর্শ বদল হলো।

আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম—এই বজ্রধ্বনি কোথায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। হারিয়ে গিয়েছিলও প্রায়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত হায়েনাদের অভিপ্রায় সফল হয়নি। ফের ছড়িয়ে পড়েছিল, ‘একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি।’ আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়েছে—জয় বাংলা। এগিয়ে পিছিয়ে, পিছিয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ আজ সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে পৌঁছেছে।

সূত্র
কালের কণ্ঠ

অনলাইন ডেস্ক

সংবাদটি এবং সংযুক্ত মিডিয়া (ছবি-ভিডিও-গ্রাফ) বিভিন্ন দেশীয় অথবা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা হতে সংগ্রহীত অথবা অনুবাদকৃত। এর কোন কৃতিত্ব অথবা কপিরাইট আমাদের নয়।

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button