ই-অরেঞ্জের ব্যাংক হিসাবে থাকা প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি টাকা পারিবারিক ও নিজস্ব চক্রের মাধ্যমে বনানী থানার পরিদর্শক (বরখাস্ত) শেখ সোহেল রানা সরিয়ে নিয়েছেন বলে সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের ধারণা, এই টাকা পাচারের পরই পালিয়েছেন তিনি। ভারতের সীমান্তে ধরা পড়া শেখ সোহেলের লক্ষ্য ছিল নেপাল হয়ে ইউরোপে চলে যাওয়া।
এর আগে ই-অরেঞ্জে জালিয়াতির অভিযোগের পর তাঁর বোন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সোনিয়া মেহজাবিনসহ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও নিজেকে আড়াল করতে সক্রিয় ছিলেন সোহেল। শুক্রবার তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়টি আগেই টের পেয়ে পালিয়ে
যান। এর আগে তিনি বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন বলে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা। লেখাপড়ার কারণে দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে থাকা সোহেল কোন দেশে, কিভাবে টাকা পাচার করেছেন, সে ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেছেন গোয়েন্দারা।
গতকাল রবিবার মামলার পলাতক আসামি সোহেলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তাঁকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। গতকাল তিনি বলেন, ‘যেহেতু ভারতে মামলা হয়েছে, এ কারণে তাঁকে ফিরিয়ে আনা যাবে কি না, সেটি নিশ্চিত নয়। তবে ফিরিয়ে আনার রাস্তা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিএসএফকে চিঠি দিয়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এটি অনেক সময় করা হয়। আমরা চেষ্টা করছি ফিরিয়ে আনার জন্য। যদি এ মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হয় তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁকে ফেরত আনার চেষ্টা করবে।’ তিনি আরো বলেন, তাঁর (সোহেল রানা) ব্যাপারে গুলশান বিভাগ পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। রিপোর্ট পেলে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সোহেল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।’
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অভিযোগ, বোন সোনিয়া ও ভগ্নিপতি মাসুকুর রহমানসহ ঘনিষ্ঠদের দিয়ে সোহেল রানাই ই-অরেঞ্জ চালাচ্ছিলেন। তুলে নেওয়া টাকা সোহেলের নির্দেশনায় পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লন্ডনে পড়তে গিয়ে ডলপিউ নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় সোহেলের। তাঁর হাত ধরে ই-অরেঞ্জের পথচলা। কিছুদিন লন্ডনে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ছিল। পরে বাংলাদেশে স্বজনদের নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন সোহেল। ই-অরেঞ্জের ঠিকানায় খোলা ‘অরেঞ্জ বাংলাদেশ’ নামের প্রতিষ্ঠানের টিআইএন সনদে পরিচালক হিসেবে সোহেল রানার নাম আছে। ব্যবসার সূত্রে ইউরোপে তাঁর নেটওয়ার্ক আছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার চ্যাংরাবান্ধায় নেপাল সীমান্ত থেকে সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। ওই দিনই ই-অরেঞ্জে ৭৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার গুলশান থানায় একটি মামলা করা হয়। গত ৩১ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়ার আদালতে ইসতিয়াক হোসেন টিটু নামের এক ভুক্তভোগী মামলার আবেদনটি করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে গুলশান থানার ওসিকে এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেন। এর আগে ১৭ আগস্ট তাহেরুল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগীর মামলায় সোনিয়া, তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমানসহ চারজন গ্রেপ্তার হয়। মাসুকুর রহমান ই-অরেঞ্জের উপদেষ্টা।
ভুক্তভোগী ও তদন্তকারীদের একাধিক সূত্রে জানা যায়, ওই চারজন গ্রেপ্তার এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে সোহেল তাঁর সহযোগী ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করেন। ই-অরেঞ্জের দুটি ব্যাংক হিসাব বিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ জুলাই পর্যন্ত একটি ব্যাংকের হিসাবে জমা পড়ে ৬২০ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার ৭২৯ টাকা। সেখান থেকে মোট ৬২০ কোটি ৪৪ লাখ ৭১ হাজার ৯৯২ টাকা তুলে নেওয়া হয়। ওই হিসাব নম্বরে এখন ২২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৩৭ টাকা জমা আছে। আরেকটি ব্যাংক হিসাবে ৩০ জুন পর্যন্ত জমা পড়ে ৩৯১ কোটি ৬৭ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৯ টাকা। সেখানে এখন জমা আছে দুই কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৯ টাকা। তুলে নেওয়া হয়েছে বাকি ৩৮৮ কোটি ৭৭ লাখ ৯৬ হাজার ২৫৯ টাকা। দুই হিসাব থেকে ৬৬০ কোটি টাকা পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। দুই হিসাবে স্থিতি আছে তিন কোটি ১২ লাখ ১৪ হাজার ৩৫৬ টাকা। বাকি ৩৪৯ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। সোহেল রানা গত বছরের নভেম্বর থেকে ছয় মাসে একটি হিসাব থেকে তুলেছেন দুই কোটি ৪৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা অদিতি প্রায় তিন কোটি টাকা তুলেছেন। ফজলু নামের একজন প্রায় ১১ কোটি এবং মিলন নামের একজন পাঁচ কোটি টাকা তুলেছেন। সোহেলের বোন সোনিয়া তুলেছেন প্রায় তিন কোটি টাকা। অরেঞ্জ বাংলাদেশের হিসাবে প্রায় চার কোটি টাকা।